কোভিড-১৯ ভাইরাস। ছবি- আইস্টকের সৌজন্যে।
করোনাভাইরাস বেশ কয়েক বছর ধরেই সভ্যতার নানা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক ধরনের করোনাভাইরাসের জন্য আমাদের কফের কষ্টে ভুগতে হয়। তবে দু’ধরনের করোনাভাইরাস গত কয়েক বছরে আমাদের পক্ষে রীতিমতো ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে। কারণ, সেগুলি প্রাণঘাতী হয়ে উঠেছে। এদের একটি- ‘সার্স’। অন্যটি ‘মার্স’। কিন্তু তারাও কোভিড-১৯ ভাইরাসের মতো সভ্যতার পক্ষে এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারেনি। গত ৫ মাসেই এই ভাইরাসের জন্য বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ। মৃতের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩৬ হাজার।
মাত্র ৫ মাস আগে আমরা প্রথম জানতে পারি কোভিড-১৯ ভাইরাসের কথা। আর তার পর থেকেই বিশ্ব জুড়ে এই ভাইরাসকে নিয়ে শুরু হয়েছে গবেষণা। তাকে চিনে, বুঝে ওঠার জন্য। তার ভয়াবহ সংক্রমণ রুখতে ওষুধ ও টিকা আবিষ্কারের জন্য।
দেখে নেওয়া যাক, গত ৫ মাসে কোভিড-১৯ ভাইরাস সম্পর্কে আমরা কী কী জানতে পেরেছি? ব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে।
১) এরা কোথা থেকে এসেছে? কী ভাবে মানুষকে সংক্রমিত করল?
এদের উৎপত্তি বাদুরদের মধ্যে। গবেষকরা দেখেছেন, বাদুড় আর কোভিড-১৯-এর হানাদারিতে মরে না। কারণ, তাদের শরীরের প্রতিরোধক্ষমতা এই ভাইরাসকে অনায়াসে রুখে দিতে পারে। তার ফলে, বাদুড়ের শরীরে এরা আরও দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে। যাতে তারা বাদুড়ের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে পারে। তাই বাদুড়ের শরীর এখন ভরে উঠছে খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে পারে এমন কোভিড-১৯ ভাইরাসে। তার ফলে বাদুড় থেকে যদি এই ভাইরাস অন্য স্তন্যপায়ীদের শরীরে ঢোকে, যাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, তা হলে সেখানে তারা আরও দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি ঘটাতে পারে। বহু প্রমাণ মিলেছে, বাদুড় থেকে মানুষের শরীরে ঢোকার আগে কোভিড-১৯ প্যাঙ্গোলিনের মতো স্তন্যপায়ীর দেহে ঢোকে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট এডওয়ার্ড হোমস বলছেন, ‘‘কোভিড-১৯ বাদুর থেকে অন্য কোনও প্রাণীর দেহে ঢুকেছিল। যে প্রাণী প্রজাতিগত ভাবে মানুষের খুব কাছাকাছি। তাদের হয়তো বাজারেও পাওয়া যায়। ফলে বাজারে আমরা সেই প্রাণীর সংস্পর্শে আসায় আমরাও সংক্রমিত হয়েছি। তার পর বাড়িতে ফিরে গিয়ে আমরা অন্যদের সংক্রমিত করেছি।’’
দেখা গিয়েছে, কেউ হাঁচলে বা কাশলে নাক দিয়ে জলের কণা (‘ড্রপলেটস’) বেরিয়ে আসে তাতেই থাকে কোভিড-১৯ ভাইরাস।
২) এই ভাইরাস কী ভাবে ছড়ায়? তাতে মানুষ কী ভাবে সংক্রমিত হয়?
শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে এই ভাইরাস আটকে থাকা কণাগুলি আমাদের দেহে ঢোকে। আর তা আমাদের গলা ও ল্যারিঙ্গসের বাইরের দিকের কোষগুলির গায়ে আটকে থাকে। এই কোষগুলির বাইরের দিকে থাকে প্রচুর পরিমাণে রিসেপ্টর কোষ। যাদের নাম ‘এসি-টু রিসেপ্টর্স’। এই রিসেপ্টরগুলি কোনও রাসায়নিককে বাইরে থেকে কোষের মধ্যে ঢুকতে সাহায্য করে। আর সেই রাসায়নিক ঢোকার বার্তা অন্য কোষগুলিকেও জানিয়ে দিতে পারে।
নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাইরোলজিস্ট জোনাথন বল বলছেন, ‘‘কোভিড-১৯ ভাইরাসের পৃষ্ঠতলে (সারফেস) থাকে এক ধরনের প্রোটিন। যার মাধ্যমে কোষের রিসেপ্টরগুলিকে ধোঁকা দিয়ে ভাইরাস তারা আরএনএ-কে কোষের ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে পারে। দেহে প্রতিরোধী কোষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ানোর জন্য আমাদের কোষের কিছু কলাকৌশল আছে। ভাইরাসের আরএনএ-গুলি আমাদের কোষে ঢোকার পর সেই কলাকৌশলগুলি নিয়েই কোষের মধ্যে কোভিড-১৯ ভাইরাসের দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটায়। তাতে কোষের মধ্যে ভাইরাসের সংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে কোষের প্রাচীর ফেটে যায়। তখন সেই ভাইরাসগুলি দেহে ছড়িয়ে পড়ে।
কোভিড-১৯ ভাইরাস। ছবি- আইস্টকের সৌজন্যে।
তবে গবেষকরা দেখেছেন, ‘সার্স’ ভাইরাসে রোগী অনেক বেশি কাহিল হয়ে পড়েন কোভিড-১৯ ভাইরাসের হানাদারির চেয়ে। সার্স ভাইরাসে প্রতি ১০ জন আক্রান্তের মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয়। কিন্তু কোভিডের ক্ষেত্রে সেই মৃত্যুর হার কম। আবার কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত অনেক সময় বুঝেই উঠতে পারেন না তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। এটা সার্স বা মার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে হয় না।
৩) কোভিড-১৯ ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যু হয় কেন?
সাধারণত, এই ভাইরাস আমাদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা তৈরি করে। সেটা তখনই হয় যখন এই ভাইরাস শ্বাসনালী ধরে নেমে ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়। সাধারণ কোষের তুলনায় ফুসফুসের কোষে এসি-২ রিসেপ্টর কোষের সংখ্যা বেশি। কোভিড-১৯-এর জন্য ফুসফুসের অনেক কোষ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক কোষ ভেঙে যায়। ফলে, ফুসফুস ভরে যায় ভাঙা কোষে। তখন আক্রান্তকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখতে হয়।
আরও পড়ুন- আর শুধু হুমকি নয়, 'হু'কে অর্থ সাহায্য বন্ধ করল আমেরিকা
আরও পড়ুন- কিছু ছাড় মিললেও, ৩ মে পর্যন্ত ঘরেই বন্দি গোটা দেশ
কখনও কখনও অবস্থা আরও খারাপ দিকে যায়। আমাদের দেহের প্রতিরোধী ব্যবস্থা ফুসফুসের কোষগুলিকে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়তে উৎসাহিত করে। তার ফলে, প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এই কাজে দেহের প্রতিরোধ কোষগুলি আরও বেশি সংখ্যায় জড়িয়ে পড়লে প্রদাহ আরও বেড়ে যায়। এটাকেই বলা হয়, ‘সাইটোকাইন স্টর্ম’।
তবে এই সাইটোকাইন স্টর্ম কেন সব আক্রান্তের না হয়ে কারও কারও ক্ষেত্রে হয়, তার কারণ জানা যায়নি।
৪) কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে আমাদের জীবন কী সুরক্ষিত?
কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর যাঁরা পরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে তাঁদের শরীরে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরালো হয়ে উঠেছে। তার ফলে, রক্তে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। যারা শরীরে ঢোকা ভাইরাসকে রুখে দিতে পারছে বা তার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারছে। তাতে ভাইরাসগুলি আর কোষকে ভেঙে দিতে পারছে না।
তবে ভাইরোলজিস্টদের কেউ কেউ মনে করেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে আমাদের দেহের প্রতিরোধক্ষমতার মেয়াদ বড়জোর এক বা দু’বছর। তাঁদের বক্তব্য, কোভিড-১৯-ও অন্য করোনাভাইরাসের মতোই। ফলে, আগামী দিনে বহু মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে তা ফের মহামারীর চেহারা নিতে পারে। ‘‘তবে সে ক্ষেত্রে হয়তো এই ভাইরাস এতটা ভয়ের কারণ হয়ে উঠবে না’’, বলছেন লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের ভাইরোলজিস্ট মাইক স্কিনার।
৫) কোভিড-১৯-এর টিকা বেরবে কত দিনে?
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় জানানো হয়েছে, এই মুহূর্তে বিশ্বে মোট ৭৮টি টিকা নিয়ে হিউম্যান ট্রায়াল শুরুর কথা ভাবা হয়েছে। আরও ৩৭টি টিকা বেরনোর অপেক্ষায়। এমনই একটি টিকা নিয়ে এখন ফেজ-ওয়ান ট্রায়াল শুরু করেছেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। এমন ট্রায়াল চলছে মার্কিন বায়োটেকনোলজি কর্পোরেশনের বানানো দু’টি টিকা নিয়ে। চিনা গবেষকরাও এমন তিনটি টিকা নিয়ে ফেজ-ওয়ান ট্রায়াল শুরু করেছেন। তবে তাতেও আগামী বছরের আগে কোভিড-১৯-এর টিকা বাজারে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেই মনে করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, টিকা বাজারে আনার আগে নানা দফায় প্রচুর মানুষের উপর তার হিউম্যান ট্রায়াল চলে। সেটা যত বেশি সম্ভব মানুষের উপর চালানো যায়, ততই মঙ্গল। কিন্তু এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সকলকে চলতে হচ্ছে বলে সেটা করার ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy