ফাস্ট রেডিও বার্স্ট বা এফআরবি। -ফাইল ছবি।
‘ভিনগ্রহী’দের আরও আরও আলো দেখার অপেক্ষায় দিন গুণছেন এক বাঙালি। মার্কিন মুলুকে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী শমী চট্টোপাধ্যায়। তাঁর আশা, ‘‘আর মাসছয়েকের মধ্যে সেই রহস্যময় আলোর হদিশ মিলবে আরও অন্তত শ’খানেক।’’ জানিয়েছেন, তার তথ্য ইতিমধ্যেই তাঁদের হাতে আসতে শুরু করেছে।
প্রতি দিনই এমন আলোর বিচ্ছুরণ হয় কম করে ৫ থেকে ১০ হাজারটি। এক সেকেন্ডের ১০ হাজার ভাগেরও কম সময়ে তারা দপ্ করে জ্বলে ওঠে। হঠাৎ। তার পর নিশব্দে উধাও হয়ে যায়। সকলের অজান্তে।
এই আলো ব্রহ্মাণ্ডের ঠিক কোথা থেকে আসছে, তা জ্বলছে আমাদের থেকে কতটা দূরে, তা এখনও পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেননি। জানতে পারেননি সেই ভিনগ্রহীদের আলো কেন জ্বলছে? কারা জ্বালাচ্ছে বা তা জ্বলছে কীসের জন্য? জানা যায়নি, সেই আলোর বেশির ভাগই কেন জ্বলে ওঠার এক সেকেন্ডের ১০ হাজার ভাগেরও কম সময়ের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে? কেনই বা তার মধ্যে দু’-একটি বার বার জ্বলছে আর নিভছে। টুনি বাল্বের মতো!
অথচ সেই আলোর হাতেই ধরা আছে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-রহস্যের বীজ। কোনও উন্নততর সভ্যতা রয়েছে কি না, সেই অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো প্রশ্নের উত্তরটাও।
সেই আলোর প্রথম হদিশ ১২ বছর আগে
সেই ভিনগ্রহীদের আলোর প্রথম হদিশ মিলেছিল আজ থেকে ১২ বছর আগে। ২০০৭-এ। দপ্ করে জ্বলে উঠতে দেখা গিয়েছিল একটি রেডিও বিস্ফোরণকে। আর তা এক সেকেন্ডের ১০ হাজার ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। যার দেখা মেলেনি আর। বিজ্ঞানের ভাষায়, এই ভিনগ্রহীদের আলোকেই বলা হয় ‘ফাস্ট রেডিও বার্স্ট (এফআরবি)’।
কানাডায় চালু সেই ‘চাইম’ রেডিও টেলিস্কোপ।
গত ১২ বছরে এমন রহস্যময় আলোর হদিশ মিলেছে মাত্র ৭৫টি। তার মধ্যে মাত্র দু’টিকে দেখা গিয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে জ্বলছে আর নিভছে। যেগুলিকে বলা হচ্ছে রিপিটিং ফাস্ট রেডিও বার্স্ট।
টুনি বাল্বের মতো জ্বলছে আর নিভছে, এমন ভিনগ্রহীদের আলো বা রিপিটিং ফাস্ট রেডিও বার্স্টের হদিশ বিশ্বে প্রথম দিয়েছিলেন শমীই। ২০১৬-য়। এও বলে দিতে পেরেছিলেন তা ঠিক কতটা দূরে জ্বলছে আর নিভছে আমাদের পৃথিবী থেকে। তা রয়েছে ঠিক কোন গ্যালাক্সিতে। ৩০০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের সেই গ্যালাক্সিটা আবার আমাদের ‘মিল্কি ওয়ে’র মতো পুরোদস্তুর গ্যালাক্সি নয়। সে আক্ষরিক অর্থে, গ্যালাক্সি হয়ে উঠতে পারেনি বলে তা আদতে ডোয়ার্ফ গ্যালাক্সি বা বামন ছায়াপথ।
তার পর এমন ঝিকমিক করা আলো আর এক বার ধরা পড়ল এই বছরের গোড়ায়। কানাডায় বসানো ‘চাইম’ রেডিও টেলিস্কোপে। কিন্তু শমীর দেখা আগেরটির মতো সেই আলো কোন মুলুক থেকে আসছে, জানা যায়নি।
আনন্দবাজার ডিজিটালকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে শমী বললেন, ‘‘অনুমান, এই ঝিকমিক করা আলো এসেছে বড়জোর দেড়শো কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনও মুলুক থেকে। তবে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। হতে পারে, এটিও এসেছিল কোনও বামন গ্যালাক্সি থেকে। তা যদি হয়, তা হলে এই ধারণাটা জোরালো হতে পারে, এমন রহস্য়ময় আলোর জন্ম হয় বামন ছায়াপথেই। তবে সেটাও যে নিশ্চিত, তা কিন্তু নয়।’’
আরও পড়ুন- কোথা থেকে এল, কোথায় উধাও হয়ে গেল এই ‘ভিনগ্রহীদের আলো’?
আরও পড়ুন- কোথা থেকে আসে রেডিও তরঙ্গ, ধাঁধার জট খুললেন কলকাতার শমী
‘ভিনগ্রহী’দের এমন আলোর হদিশ আরও মিলবে শীঘ্রই, জোর বিশ্বাসে বললেন শমী।
কী ভাবে?
গত ১২ বছরে যেখানে এমন আলোর হদিশ মিলেছে মাত্র ৭৫টি, সেখানে কোন আশায় শমী বলছেন, আগামী ৬ মাসে এই রহস্যময় আলোর দেখা মিলবে আরও অন্তত শ’খানেক?
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী শমী চট্টোপাধ্যায়
শমী জানালেন, কানাডায় ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ। যার নাম- ‘চাইম’। যা নতুন বছর পড়তে না পড়তেই ১৩টি ফাস্ট রেডিও বিস্ফোরণের দেখা পেয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে অ্যারেসিবো অবজারভেটরির শক্তিশালী রেডেও টেলিস্কোপ। যার মাধ্যমে শমী প্রথম টুনি বাল্বের মতো জ্বলা আর নেভা রিপিটিং ফাস্ট রেডিও বার্স্ট দেখতে পেয়েছিলেন। রয়েছে ভেরি লার্জ এরিয়া টেলিস্কোপও। ফলে, আকাশের অনেক বেশি অংশকে অনেক বেশি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এখন পরীক্ষা করা যাচ্ছে। আর তার ফলে, সেই আলোর তথ্য দ্রুত আসতে শুরু করেছে বিজ্ঞানীদের হাতে।
পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্যও সেটাই বলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘এই রহস্যময় আলোর অনেক রহস্যেরই জট খোলেনি এখনও। তার কারণ একটাই, সেই আলোকে আমার খুব অল্প সময়ের জন্য দেখতে পাই। তা খুব দূর থেকে আসে বলে তা অত্যন্ত ক্ষীণ। এখনও আমাদের অনেক দূর যেতে হবে এই আলোর রহস্যের জট খুলতে গেলে। আরও আরও পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন। তবে ৬ মাসে এমন আরও শ’খানেক রহস্যময় আলোর ঝলক দেখা যাবে কি না, তা বলতে পারছি না।’’
সেই আলোর কেউ জ্বলে হারিয়ে যাচ্ছে, কেউবা জ্বলছে- নিভছে। কেন?
অ্যারেসিবো অবজারভেটরির সেই শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ
এখানেও রয়েছে মস্ত ধাঁধা। যার কারণ এখনও জানতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। শমী বলছেন, ‘‘কারও ধারণা, এই রহস্যময় আলো হয়তো দু’ধরনের। একটা জ্বলে উঠে নিমেষে হারিয়ে যায়। অন্যটা, জ্বলে আর নেভে একটি নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে। টুনি বাল্বের মতো। বিজ্ঞানীদের অন্য একটি অংশ অবশ্য তা মনে করেন না। তাঁরা বলছেন, ওই রহস্যময় আলোর সবগুলিই টুনি বাল্বের মতো। জ্বলে আর নেভে। যদিও আমাদের চোখে এমন আলো গত ১২ বছরে ধরা পড়েছে মাত্র দু’টি।’’
তবে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, এমন প্রতি ২৫/৩০টা রহস্যময় আলোর মধ্যে মাত্র একটি হতে পারে টুনি বাল্বের মতো, জানাচ্ছেন শমী।
শমীর কথায়, ‘‘অনেকে এটাকে এক্সোটিক বা ভিনগ্রহীদের আলো বলছেন। হতেও পারে তা। আবার নাও হতে পারে। হতে পারে সেই আলো কোনও নিউট্রন নক্ষত্রের। তবে সেটাও নিশ্চিত নয়।’’
এমন আলোর দেখা মেলেনি কেন আমাদের গ্যালাক্সিতে?
শমী জানাচ্ছেন, আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে এমন রহস্যময় আলো নেই বলেই ধারণা বিজ্ঞানীদের। কারণ, এই আলো এতটাই জোরালো যে তা যদি আমাদের মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সিতে থাকত, তা হলে তাদের দেখা তো দূরের কথা, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসানো রয়েছে যতগুলি শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ, তার সবগুলিই সেই আলোর ঝল্সানিতে ঝল্সে যেত এত দিনে। শুধু মিল্কি ওয়ে কেন, অ্যান্ড্রোমিডার মতো কাছেপিঠের ছোট-বড় কোনও গ্যালাস্কিতেও এই রহস্যময় আলোর হদিশ পাবেন বলে মনে করেন না বিজ্ঞানীরা। কারণ, আমাদের মিল্কি ওয়ের মতো কাছেপিঠে থাকা সব গ্যালাক্সিরই জন্ম হয়েছে অনেক অনেক পরে। সেই অর্থে, এই গ্যালাক্সিগুলি এখনও ‘শিশু’ বা ‘যুবক’ মাত্র। কিন্তু এখনও পর্যন্ত যে রহস্যময় আলোগুলিকে দেখা গিয়েছে, পৃথিবীতে পৌঁছনো তাদের আলোর পরিমাণ বলছে, সেই সবক’টিই রয়েছে বহু বহু দূরে। তারা যেখানে রয়েছে ব্রহ্মাণ্ডের সেই অংশের সৃষ্টি হয়েছে মিল্কি ওয়ে বা কাছেপিঠের গ্যালাক্সিগুলির চেয়ে বহু বহু কোটি বছর আগে।
শক্তিশালী ভেরি লার্জ অ্যারে রেডিও টেলিস্কোপ
‘‘ব্রহ্মাণ্ডে এখনও পর্যন্ত আমরা যে উজ্জ্বল মহাজাগতিক বস্তুগুলির হদিশ পেয়েছি, তাদের চেয়ে অন্তত ১০০ কোটি গুণ বেশি উজ্জ্বল এই সদ্য আবিষ্কৃত ভিনগ্রহীদের আলো!’’, বলছেন শমী।
কোথা থেকে আসছে সেই রহস্যময় আলো?
শমী বলছেন, সেই জায়গাটা আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে অনেকটাই দূরে। যেখানে পদার্থ বা কণা বা গ্যাস প্রায় নেই বললেই হয়। অসম্ভব রকমের কোনও শূন্যতা। বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এফআরবি’র হদিশ মিলবে আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছাকাছি। প্রচুর পরিমাণে পদার্থ, কণা বা গ্যাস থাকায় যে জায়গাটার ঘনত্ব খুব বেশি।
রাস্তায় খুব যানজট থাকলে যা হয়, গাড়িকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য রাস্তায় ঢুকে পড়তে হয়, ঠিক তেমনই যে কোনও তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকেই ওই কণা, পদার্থ, গ্যাসে ঘন জায়গা দিয়ে বেরতে গেলে তার পথ বদলাতে হয়। তার তল বা সারফেস বদলাতে হয়। কতটা বদলাচ্ছে, তা মাপার একটা ‘দাঁড়িপাল্লা’ আছে। যার নাম- ‘রোটেশন মেজার’ (আরএম)। কণা, পদার্থ, গ্যাসে ভরা কোনও জায়গা দিয়ে আলোকে বেরতে গেলে তার পথটা বেশি বদলাবে। কারণ, সেই কণা, পদার্থগুলির নিজেদের চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। তারা সেই আলোর চলার পথে রুখে দাঁড়াবে। তাকে ঠেলেঠুলে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে। ফলে তার ‘আরএম’ অনেক বেশি হবে।
যে ভাবে পৃথিবীতে পৌঁছয় সেই ‘ভিনগ্রহীদের আলো’
কিন্তু এই সদ্য আবিষ্কৃত ভিনগ্রহীদের আলোর সেই ‘আরএম’ একেবারে শূন্য। যার অর্থ, সেই ভুতুড়ে আলো আমাদের গ্যালাক্সির এমন একটা জায়গা থেকে এসেছে, যেখানে কণা, পদার্থ বা গ্যাস প্রায় নেই বললেই চলে। অদ্ভুত রকমের শূন্যতা সেখানে।
আতসবাজি ফাটানো হলে যেমন হয়, তেমনই খুব শক্তিশালী, অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোর ঝলক হয় এই ফাস্ট রেডিও বার্স্টে। যাকে বলা হয়, ‘লাইট ফ্ল্যাশেস’। প্রতি দিন ব্রহ্মাণ্ডে এমন আলোর ঝলসানির ঘটনা ঘটে গড়ে ৫ হাজার থেকে ১০ হাজারটি।
টুনি বাল্বের মতো জ্বলা-নেভা কোন ইঙ্গিত দিচ্ছে?
শমীর কথায়, আলোর ঝলসানিটা যখন ‘রিপিটেড’ হচ্ছে, তখন আমরা নিশ্চিত হচ্ছি, সেটা কোনও বিস্ফোরণ থেকে হচ্ছে না। কারণ, কোনও বিস্ফোরণ থেকে আলোর ঝলসানি হলে তা কখনও ‘রিপিটেড’ হতে পারে না। এক বার সেই আলোর ঝলসানি দেখতে পাওয়ার পরেই তা হারিয়ে যাবে। উধাও, হাপিস হয়ে যাবে। আর সেই আলোর প্রতিটি ঝলসানিই খুব বেশি হলে এক মিলি-সেকেন্ডের চেয়ে স্থায়ী হয় না। এত কম সময় স্থায়ী হয় বলেই এই রেডিও বার্স্ট বা রেডিও তরঙ্গকে অত সহজে আমরা দেখতে পাই না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy