প্রতীকী চিত্র
ভাইফোঁটা – এক বহতা সংস্কৃতি॥
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা, আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
যমুনার হাতে ফোঁটা খেয়ে যম হল অমর।
আমার হাতে ফোঁটা খেয়ে আমার ভাই হোক অমর॥”
সে বহু পুরনো কথা৷ এক রাজপুরীতে এক ভাই তার বোনের জন্য অপেক্ষা করত আর ভাবত, এই বার সে বাপেরবড়ি আসবে৷ কিন্তু বোন আর আসে না। শেষে ভাইটি আর থাকতে না পেরে দীপাবলির দিনে জগজ্জননী মা-কে স্মরণ করে পথে নেমে পড়েছিল।
বন্ধুর, চড়াই-উতরাই পথে যাত্রা শুরুর দ্বিতীয় দিনে ভাইটি পৌঁছতে পেরেছিল বোনের বাড়ি। বোন তো ভাইকে দেখে আপ্লুত। কপালে ফোঁটা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল ভাইকে। বলেছিল, “চিরকাল যেন প্রত্যেকটা ভাই এমনি করেই এই দিনে বোনেদের কাছে ছুটে আসে। বোনেরাও যেন এমনি করেই সারা দিন উপবাস রেখে ভাইটিকে ফোঁটা দিয়ে সর্বাঙ্গীণ কুশলতার বর প্রার্থনা করতে পারে।” সেই দিনটি থেকেই ভাইবোনের মিলন মুহূর্ত উজ্জ্বল হয়েছিল ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া নামে।
সে দিনের সেই দুই ভাই-বোন ছিলেন যম ও যমুনা। তাঁরা সূর্যদেব ও মাতা সংজ্ঞার সন্তান। রাজৈশ্বর্যে পালিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে তাঁরা পড়েছিলেন বিমাতার কবলে।
সূর্যদেবের প্রথম পত্নী সংজ্ঞা, সূর্যদেবের প্রচণ্ড তাপ সহ্য করতে না পেরে সন্তান-সন্ততিকে তাঁরই যমজ বোন ছায়ার দায়িত্বে দিয়ে নির্জনে নির্বাসন নেন। আর এই সুযোগটিকেই কাজে লাগান ছায়া। একই রূপ হওয়ার দরুণ সূর্যদেবকে আবিষ্ট করে ফেলেন এবং তাঁদের নিজেদের সন্তান আসে। সংজ্ঞার সন্তান-সন্ততিকে চূড়ান্ত অবহেলার শিকার হতে হয়।
এক সময়ে যমুনার বিয়ে হয়ে যায় এবং যমুনা দীর্ঘকাল পরে যেন মুক্তি পান। সেই বিভীষিকাময় বাপের বাড়ীতে আর তিনি ফিরে আসতে চান না। এ দিকে ভাইয়ের মনও যে মানে না। শেষমেষ ভাই-বোনের মিলন হয়। সেই দিন ছিল কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিন। উল্লেখিত ছড়াটি কেটে ফোঁটা দেন যমুনা। অমরত্ব লাভ করেন যম।
সেই পুণ্যতিথিই আজকের ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা নামে পরিচিত। পক্ষান্তরে যমদ্বিতীয়া।
কোথাও ভাইদুজ, কোথাও ভাইফোঁটা, কোথাও বা ভাইটিকা- কিন্তু সার কথা সেই একই।
অন্য কিংবিদন্তি~( নরকাসুর পর্ব)
প্রাগজ্যোতিষ ( অধুনা অসম) ঘোটকপুত্র নরকের জন্মের পরে তার মা শ্রীবিষ্ণুর কাছে পুত্রের দীর্ঘায়ু প্রার্থনা করেন। শ্রীবিষ্ণু সম্মত হন। নরক কামাখ্যা দেবীর পুজো করে। কিন্তু যত দিন যায়, তার মধ্যে অন্ধকার প্রকট হতে থাকে। ভক্তিভাব চলে যায়। শোণিতপুর রাজ্যের বাণাসুর রাজার কুসঙ্গে অধঃপতিত ও অত্যাচারী হয়ে উঠে নরক হয়ে যায় নরকাসুর।
এতই নীচে অধঃপতিত হয় যে আপন আরাধ্যা কামাখ্যা দেবীকে পরিণয় প্রস্তাব দেয় সে।
শক্তি দর্পিত নরকাসুর সকল রাজ্য জয় করার অভিপ্রায় নেয়। এক পর্যায়ে স্বর্গ আক্রমণ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে পালাতে বাধ্য করে। এমনকি দেবী অদিতির কুণ্ডল চুরি করে এবং ষোলো হাজার নারীকে অপহরণ করে আপন রাজ্যে নিয়ে যায় সে।
সকল দেবতারা শ্রীবিষ্ণুর কাছে নরকাসুরের বিনাশ প্রার্থনা করেন। শ্রীবিষ্ণু তাঁর শ্রীকৃষ্ণ অবতারে সেই কাজ সমাপন হবে বলে আশ্বস্ত করেন তাঁদের। কারণ, শ্রীবিষ্ণুর নরকাসুর-মাতা ভূদেবীকে দেওয়া বর অনুসারে নরক দীর্ঘজীবন লাভ করেছে। এত দ্রুত তার বধ অসম্ভব।
পরবর্তীতে কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামাকে (কিংবদন্তি মতে নরকাসুরের মা ভূদেবীর অবতার) দেবী অদিতি নরকাসুরের কুকীর্তির ব্যাপারে অবহিত করেন। সত্যভামা তখন নিজেই কৃষ্ণকে নরকাসুরের বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য রাজি করান। শ্রীকৃষ্ণ গরুড় পৃষ্ঠে নরকাসুরের রাজ্য আক্রমণ করেন।
এই পর্যায়ে কৃষ্ণ নরকাসুরের সেনাপতি মুর-কে বধ করেন ও মুরারী নামে পরিচিত হন। সব শেষে সুদর্শন চক্র দ্বারা তিনি নরকাসুরকে বধ করেন এবং দেবী অদিতির কুণ্ডলের সঙ্গে সেই সমস্ত অপহৃত নারীকেও উদ্ধার করেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের সিংহাসনে নরকাসুরের পুত্র ভগদত্তকে অভিষিক্ত করা হয়। অপহৃত সেই ষোলো হাজার নারীকেই কৃষ্ণ পত্নী রূপে গ্রহণ করেন।
নরকাসুর বধ হন কার্তিকের কৃষ্ণ চতুর্দশীর দিন। পৃথিবীর অন্ধকার সরে গিয়ে নতুন করে আলোকময় হয়ে ওঠে। মানুষ এই দিনে ঘরে ঘরে দীপ জ্বেলে তাকে স্মরণ করে।
শ্রীকৃষ্ণ দ্বিতীয়ার দিন ঘরে ফিরলে বোন সুভদ্রা ভাইয়ের এই মহান কাজে খুশি হয়ে তাঁকে ফোঁটা দিয়ে বরণ করেন। সেই ভাইফোঁটার শুরু।
রীতি~
বোন বা দিদি চন্দন বা দইয়ের লেই বা প্রলেপ করে নিজের কড়ে আঙুল দিয়ে ভাইয়ের কপালে উল্লেখিত মন্ত্রটি পড়তে পড়তে তিন বার ফোঁটা দেন।
দূর্বাঘাস ও ধানের শিষ থাকে আশীর্বাদের জন্য। দাদা বা বোন পরস্পরকে আশীর্বাদ ও প্রণাম করে মিষ্টি মুখে নিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে। দীপশিখার স্পর্শ, শঙ্খ-উলুধ্বনি মহিমান্বিত করে রাখে মুহূর্তটিকে।
শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা~
হাতের পাঁচটি আঙুল যথাক্রমে ক্ষিতি, অপ, তেজ,মরুৎ ও ব্যোম- এই পঞ্চভূতের প্রতীক। তাই কড়ে আঙুলে ফোঁটা দেওয়ার অর্থ হল ভাই-বোনের মধ্যে ভালবাসা ও প্রীতি যেন ব্যোম অর্থাৎ আকাশের মতো বিশাল ও ব্যাপ্ত হয়। পরস্পরের কাছে অদেয় যেন কিছু না থাকে।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy