অলঙ্করণ: অমিতাভ চন্দ্র (গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির অনুপ্রেরণায়)।
গরমের দুপুরে দিদিমা শুয়ে শুয়ে আমাদের ছেলেবেলাকার গল্প শোনাত। বাইরে কাঁঠাল গাছে ঘুঘু ডাকত এক টানা, দিদিমা ছাদের দিকে চেয়ে কী সব যেন ভাবত, মনে মনে খানিক হাতড়াত, তার পর ক্লান্ত, ঘোর-লাগা গলায় বলত, ‘কী সুন্দর যে রোদ উঠত সেখেনে, আশ্বিন মাসে কচি কাশের চারার মাথায় মেঘভাঙা নরম আলো পড়ে হিরের আংটির মতো ঝকঝক করত, পাশ দিয়ে বইত মেঘনা নদী…’ আমরা অবশ্য এ সব কথার মাঝেই দিদাকে থামিয়ে দিতাম। দিদার এই ছিল বিচ্ছিরি স্বভাব, বলার কথা ভূতের গল্প, তা নয়, কোত্থেকে এসে পড়ত মেঘনা নদী আর কাশফুলের গল্প।
‘আরে এটা নয়, সেই ঘোষালদের বাড়ির ভূতের গল্পটা বলো...’
আবার মিনিট দুই সব চুপচাপ, হঠাৎ খেই ধরত দিদা, ‘গেলবারে দাঙ্গার আগে ঘোষালরা সব্বাই তো ইন্ডিয়া চলে গেল, আমরা ক’ঘর পাড়ায় তখনও টিমটিম করছি। এ দিকে সন্ধে হলেই মা বেজায় ভয় পেতেন। ঘোষালদের ফাঁকা বাড়িটায় কারা যেন কথাবার্তা বলত, মাঝেমধ্যে শাঁখ বাজত, ধূপ-ধুনো-গুগ্গুলের গন্ধ পাওয়া যেত। অথচ নজর করে দেখলে দেখবে কোথায় কী? খালি বাড়ির উঠোনে তুলসীমঞ্চ একা একাই বৃষ্টিতে ভিজত, ইটের পাঁজায় তক্ষক ডাকত, দোফলা আমগাছের রস-টুসটুসে আমগুলো মিছিমিছিই পড়ে থাকত উঠোন জুড়ে। কেউ আসত না সে সব কুড়োতে, পাড়াটা খালি হয়ে যাচ্ছিল একে একে। মেঘনা নদীর পাড় জুড়ে খাঁ-খাঁ করত বিশাল বাড়িগুলো। কেউ নেই, অথচ রাত বাড়লেই গমগম করত, আলো জ্বলত, নাচগান হত। মানুষ থাক আর না থাক, ভাঙা বাড়িগুলোয় তাদের পুরনো জীবনটা থেকে গেছিল। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই সেই কবেকার গল্পগাছা, সুখদুঃখ, হাসিকান্না ফিরে আসত আপনা-আপনিই। দাঙ্গা মানুষ মারতে পারে, দেশ, পরিবার, ঘর-দুয়ার উপড়ে ফেলতে পারে, কিন্তু তার ভিতরের অনুভূতিগুলোকে তো আর নিঃস্ব করে দিতে পারে না! সেই লুকোনো মনখারাপকে সঙ্গী করে বাড়িগুলো রোজ রাতে জাগত। আমরা ভয়ে বালিশের নিচে লোহার সাঁড়াশি নিয়ে শুতাম!”
২০১৪ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর রোববারের পাতায় নতুন বই সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিপিকা পেলহাম এই ভূতের গল্পটি শোনান। তাঁর আটপৌরে, সহজ-সরল দিদা সারা জীবনে সংসার সামলে খুব বেশি দূর বেড়াতে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু একই জীবনে তিন-তিনটি দেশের ঠিকানা বদলেছিলেন! ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তান, আবার পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ— নড়বড়ে রাজনীতির মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে রোজকার ভয়, আশঙ্কা আর অসম্ভব দোটানায় জেরবার হতে হতে দিদার সত্যি-মিথ্যে গুলিয়ে যেত। সেই কবেকার ছেড়ে আসা মেঘনার ধারের গ্রাম, সেখানে কাটানো বড় আদরের শৈশবটি, ঘোষালবাড়ির ভূতের গল্প, নদীর ধারের সাতমহলা বাড়ির লুকোনো কান্না— এ সবও সত্যি বলে মনে হত। বেলা পড়ে আসত, লেবুফুলের গন্ধ বেরোত, আর দিদা একটানা বলেই যেত শান্ত, মায়াবতী সেই বৌটির কথা, যে খিড়কির বাগানে লেবুগাছের চারা পুঁতেছিল। বাড়িতে অতিথি এলে লেবুপাতা ভিজিয়ে সুগন্ধি চা করে খাওয়াবে, এই ছিল তার ইচ্ছে! আর তার পর হঠাৎই দেশের ওঠাপড়ার গল্পে কেমন করে যেন সে এক দিন ‘নেই’ হয়ে গেছিল! শুধু দিদার গল্পেই ফিরে আসত সে, আমরা দেখতাম তার চোখের নির্বাক, গাঢ় কষ্ট কী করে যেন দিদার চোখেও মিশে যেত। দু’জনেই কাঁদত, অথচ শব্দ হত না এতটুকু। কল্পনার মেঘনা নদীর রুপোলি রোদে মানুষ আর ভূতের দিব্যি বনিবনা হয়ে যেত সেই দুপুরগুলোয়!
পার্টিশন, যুদ্ধ আর ট্রমা-স্টাডিজ়ের দফতরে এ রকম ভূতের গল্পের উনিশ-বিশ মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ত। পরিচিত চৌহদ্দি আর কাছের মানুষগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার দারুণ যন্ত্রণা আর পুরনো সময়টাকে আরও এক বার ফিরে দেখার চেষ্টাটাই অনেক সময় ভূতের গল্পগুলোকে বছরের পর বছর ধরে জ্যান্ত রাখত। ঘর-দুয়ার বদলে গেলেও কষ্ট তো আর কমত না, তাই গল্পও ফুরোত না। তবে সে সব গল্পের ভূতেরা ভয় দেখাত না। চল্লিশের সমাজের অমানুষি ওঠাপড়ার বিপরীতে ক্রমাগত ভয় পেতে পেতে ভূতগুলোও বোধহয় তাদের সহজাত প্রবৃত্তি হারিয়ে ফেলেছিল। ‘স্ক্রোল’-এর ভার্চুয়াল পত্রিকায় আভিনা কোহলি ইন্দরলালের বাড়ির যে গল্পটি লিখেছিলেন ২০২০ সালের অগস্ট মাসে, সেই গল্পের ভূত ইসমাইলও চুপচাপ কুয়োর ধারে বসে সাধের বাড়িটির দিকে চেয়ে থাকত। ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তাকে কেটে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল এক দল ভীষণ রাগী অচেনা মানুষ, ইসমাইল তার পরেও ছোট্ট বাড়িটি ছেড়ে যেতে পারেনি। তার বাড়িতে তত দিনে রিফিউজি ক্যাম্প খুলেছে, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অসহায় কিছু মানুষ সে বাড়িতে থাকে। ইসমাইলের সে সব দেখে কেমন লাগত কে জানে? তবে সে তো আর মানুষ ছিল না! তার
চোখে বাষ্প জমত, খানিক কষ্টও মিশে থাকত, কিন্তু রাগ হত না।
আসলে গল্পের বিচারে মানুষ আর ভূতের অবস্থান বড়ই দ্বান্দ্বিক। আঠারো শতকে এনলাইটেনমেন্ট হল, আর ‘সভ্য’ মানুষ তার সভ্যতার ব্যাখ্যান দিতে বিপরীতে ‘অসভ্য’, ‘আদিম’ বা ‘খাপছাড়ার’ যে রূপকল্পটি তৈরি করল, বা তার বিদঘুটে যে সব হাবভাবের কথা মনে মনে ভাবল, গল্প-কল্পনায় সে সব এক্কেবারে নির্দ্বিধায় চাপিয়ে দিলে ভূতের উপর। মরা মানুষ তো কথা কইবে না, ঝগড়া করতেও আসবে না; তাই ভূত বরং হোক অদ্ভুতুড়ে, তার চেহারাপত্তর, রকমসকম সবটুকুই হোক অতিমানবিক, ভয় ধরানো। সেই কোন কালে জার্মানিক আদিবাসীদের (গথ) সৃষ্টিছাড়া আচারবিচার, আজগুবি ভাষা— এ সব কিছু ‘সভ্য’ সমাজ থেকে এক্কেবারে দূরে ঠেলে রাখতেই না তারা তৈরি করেছিল নতুন গপ্পো লেখার ধারা— গথিক! ওয়ালপোল ১৭৬৫ সালে বসে ওটরান্টোর দুর্গের গা ছমছমে গল্প শোনালেন, আর ‘সভ্য-অসভ্য’ বিভেদের আখ্যানের সঙ্গে বাঁচা-মরার সাদাকালো গল্পের টাকনা মিশিয়ে কালে কালে কত যে ভূতের গল্প এল-গেল, তার লেখাজোখা নেই! লোকে অবশ্য প্রথমটায় বেশ ভয়টয় পেল, তার পর ছেলেমানুষি ভ্রম আর কুশিক্ষার দোহাই দিয়ে সেগুলোকে বিশ্বাসের পরিধির বাইরে পাঠিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেউ গল্পগুলোর খবর তেমন রাখল না, তাই দেখতেও পেল না যে, গল্পের ভূত নেহাত মানুষের চেয়ে আলাদা, বেআক্কেলে জুজুগোত্রের জন্তুবিশেষ নয়, রীতিমতো জমকালো একটি সমাজচিহ্ন, ধারে এবং ভারে যার জুড়ি মেলা ভার!
হালে অবশ্য সমাজতত্ত্বই হোক বা সাহিত্য কিংবা সাংস্কৃতিক চর্চা, ভূতের গল্পের সামাজিকতা প্রসঙ্গটি নানা ভাবে আলোচনা হয়েছে। হ্যাঁ, এ কথা তো সকলেই জানে, যে ‘ভূত’ মানেই ফেরা। কিন্তু সব ফিরে আসা মোটেই অমন ভূতুড়ে নয়! জীবনে তো কত কিছুই ফেরে! মেঘলা দিনে প্রথম ভালবাসা ফিরে আসে, ভোরের স্বপ্নে অঙ্কের ভীষণ খারাপ নম্বর ফিরে আসে, এমনকি চোখ বেঁধে বেপাড়ায় ছেড়ে দিয়ে এলে বাড়ির হুলো বেড়ালটাও ফিরে আসে, তাতে কেউ মাথা ঘামায় না। কিন্তু রোজ রাতে একই কষ্ট, একই প্রশ্ন আর একই নৃশংসতা নিয়ে ১৯২০-র দশকে ‘নসফেরাটু’, ‘ড্রাকুলা’ এ সব যখন সিনেমায় ফিরতে শুরু করল, তখন তাকে দেখে ভয় পেল মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে সবে শেষ হয়েছে। তখন যে দিকে তাকাবে, সে দিকেই ভূতের গল্প! ভয়ঙ্কর, হাড় কাঁপিয়ে দেওয়া সে সব গল্পে কেবলই ফিরে আসে মরা মানুষগুলো! তাদের মায়াদয়া নেই, দেহগুলো যুদ্ধের তাপে পচতে শুরু করেছে, শরীরটা কবেই মরে গেছে, আর ফাঁপা ভেতরটা জুড়ে রয়ে গেছে ধ্বংসের আনন্দ! সিনেমায় হোক কি সাহিত্যে, ভূতের গল্পের এই অমানুষি জৈবিকতা নিয়ে কথাবার্তা তখন বাড়ছিল, নতুন করে ভাবাচ্ছিল তার ফিরে আসার গূঢ় কারণটিও। আর এহেন ফিরে আসার কারণ দর্শাতে সমাজ আর মানুষের অন্ধকার অন্দরটাই বেরিয়ে পড়ছিল বার বার!
শেষে অনেক হন্টোলজি আর দেরিদার চর্চা-টর্চা করে তাত্ত্বিকেরা ঠাউরালেন যে, মরা ব্যাপারটা নেহাতই আবহসঙ্গীতের মতো, ওতে বিশেষ কিছু বাড়ে-কমে না, কনটেক্সটের ধারণাটা আর একটু জোরালো হয় মাত্র! ভূত আসলে চলতি সমাজের ঠাসবুনট আখ্যানটির বদল বা নিদেনপক্ষে তাকে প্রশ্ন করতে চাওয়ার ইচ্ছেটাকেই জব্বর একখানা ছায়াশরীর দেয়। যখনই সমাজ একমাত্রিক হয়ে গেছে, ভালমন্দ নিয়মনীতির দোহাই দিয়ে ছড়িয়েছিটিয়ে বসে ভেবেছে সবটুকুই বুঝি তার দখলে, অমনি গুটিগুটি শুরু হয়ে গেছে ভূতের আসা-যাওয়া! বার বার, রোজ রোজ ফিরে এসেছে তারা। বেশ দাঁত-নখওয়ালা ধারালো প্রতিবাদ করে, সময়বিশেষে রক্ত-টক্ত খেয়ে, আয়নায় হাসাহাসি করে সমাজের সেই সব অন্ধকার টেনে খুঁড়ে বের করেছে, যেগুলো সাদা চোখে ধরা পড়ে কম, তাই বদল করার গরজও দেখায় না কেউ! আর সে প্রশ্নের উল্টো পিঠে দাঁড়িয়ে কেবলই ভয় পেয়েছে মানুষ! আতঙ্কে নীল হতে হতে ভেবেছে, এই মৃত্যু পেরোনো না-মানুষগুলো কি তার বানানো ক্ষমতার গল্পটাই বদলে দেবে? তাদের নিঃশ্বাসের হিম-হিম স্পর্শ তো ‘অ-সভ্য’, ‘অ-মানুষ’-এর খাপছাড়া দেখনদারি নয়, ছেলে-ভোলানো গল্পের আকাশকুসুমও নয়, এ তো তারই তৈরি করা সমাজের অন্দরে বেড়ে ওঠা সেই লুকোনো নেমেসিস, যার দেহ নেই, তাই সামাজিক নীতিনিষ্ঠার তোয়াক্কাও সে করে না, শুধু মাঝরাত্রির নিস্তব্ধতায় সে ফিরে আসে প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়ে! মানুষের ঠিক সামনেটিতে দাঁড়ায়, আর প্রশ্ন করে তার বানানো সমাজের গল্পে এতখানি ফাঁক থেকে গেল কী ভাবে! কী অসহ্য ঠান্ডা তার নিঃশ্বাস, যেন বুকের ভেতর থেকে হৃৎপিণ্ড উপড়ে নিতে চায়! মৃত্যুযন্ত্রণায় স্থির তার চোখগুলো মনে করিয়ে দেয় কতখানি যন্ত্রণা আর রাগে তার না-জীবনটাও থমকে গেছে বাঁচা-মরার মাঝখানে, তার নির্বাক ছায়াছবি প্রত্যুত্তর দাবি করে। সে অন্ধকার-অস্তিত্ব একে একে ঘিরে ফেলে মানুষ আর তার সমাজের সারটুকু, উল্টেপাল্টে যায় সময়, শুরু হয় ফিরে দেখার নতুন গল্প!
বাংলা ভূতের গল্পেও সেই চাওয়া-পাওয়ার অভিঘাত বড় প্রবল। তবে সে অভিঘাত তার সুকঠিন উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করেছে মূলত রবিঠাকুরের গল্প থেকে। তার আগে আগে ভূতের গল্প অবিশ্যি ছিল, তবে সে গল্পে সমাজের ছোঁয়া থাকলেও প্রশ্নের তীক্ষ্ণতা ছিল না। লেখা গল্পই বা সে রকম কই তখন? বেশিটাই লোকের মুখে মুখে ফেরা, চলতি গল্প। সে গল্পের বেশিটা জুড়েই খালি সাহেবপাড়ার ভূতেদের গল্প, আর নতুন শহর-বাজার এলাকায় ঘুপচি ঘরে নতুন জীবনের মুখশুদ্ধির মতো কুয়োভূতের গল্প, গলায়-দড়ের গল্প, বাচ্চাদের ভয় পাওয়ানো পেঁচোভূতের গল্প! লেখা গল্পের মধ্যে ছিল এক ত্রৈলোক্যনাথের ভূতেরা— তারা সাহেবসুবোর রাজত্বে প্রশ্ন করবে কী, ভয় দেখানোর আগেও দু’বার ভাবত। একে তো তারা হল গিয়ে কালোকুলো দিশি ভূত, জ্যান্ত কি মরা কোনও সাহেবই তাদের পুঁছত না! রাতবিরেতে পথেঘাটে ঘুরতে ঘুরতে সাহেবপাড়ার দিকে বেড়াতে গেলে দিশি ভূতেরা শুনত, হেস্টিংসের সাহেব ভূত বেলভেডিয়ারের ঘরে ঘ্যানঘেনে বাজনা বাজাচ্ছে। বুঝত, সেই মরার আগে কোন এক রোগাপানা মেমের সঙ্গে ভাব জমাতে গিয়ে সায়েব এ সব শিখেছিল, মরেও তার সে স্বভাব যায়নি! কিন্তু সাহেব তো কোন ছার, জ্যান্ত নেটিভগুলোও তাদের ভয় পেত না! তারা যতই কানে ফিসফিস আর ঘাড়ে ফোঁসফোঁস করে একটুআধটু ভয় দেখানোর চেষ্টা করত, ততই বাত্তিওয়ালা বেয়াদব মানুষগুলো ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিত, এ সব মিথ্যে। তার পর ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’ টবন্ধ লিখে বলত, ‘অযথা ভূতপ্রেত, কবন্ধের গল্প বলিয়া শিশুচিত্তে চাঞ্চল্য সৃষ্টি না করিতে’; আর তাতে ভূতেদের ভারী লজ্জা হত।
পেতনিও অবশ্য ছিল এক-দু’ ডজন। কিন্তু তারা প্রশ্ন করবে কি, কেঁদেই আকুল। কাকে বর খুন করলে, কাকে ভাগিয়ে দিয়ে বর বোশেখ মাসে সতিন ঘরে আনলে, পেতনিগুলো কাঁদতে বসল! একটু সন্ধে হয়েছে কি হয়নি, কুয়োতলায় যশোদা পেতনি, আশশেওড়া গাছের মাথায় সাদা কাপড় পরা শাঁকচুন্নি সবাই তৈরিই থাকত, আর মশার বিনবিনানির চেয়েও নাকিসুরে কেঁদেকেটে পথচলতি লোকজনকে নারীজন্মের দুঃখের সাতকাহন শোনাত। কিন্তু লোকে তাতে ভয় তো পেলই না, বরং উল্টে রেগেমেগে কুয়োতলায় যাওয়াই বন্ধ করে দিল আর ঘনঘোর থিয়সফির চর্চা আরম্ভ করল। এমনকি তেপায়া টেবিল সাজিয়ে আঁকশি দিয়ে স্বর্গ থেকে ভূত নামানোর তোড়জোড়ও শুরু করল! ভূতেরা কত বোঝাল, তাদের হয়ে শেষে রাজশেখর বসু অবধি বললেন, আরে বাবা, হিন্দু ভূতেদের তো আর তাড়া নেই বিশেষ, জন্ম নিতে দু’-দশ দিন তো লাগবেই! এর মধ্যে কেউ একটু প্ল্যানচেট করল, হিন্দুভূত চট করে হাজিরা দিল, মরা ইস্তক চা খেতে পায়নি বলে একটু সহানুভূতি পেল, এমনটা না-হয় সহজ, তাই বলে সায়েব ভূতেদের প্ল্যানচেট করে কেন ডাকা বাপু? তাদের তো মরার পরে স্বর্গ, নরক, কাশীধাম— এ রকম হাজারো যাওয়ার জায়গা নেই, ডাকলে সেই স্বর্গ থেকে এক-কাপড়ে দৌড়ে আসতে হবে! শরীর নেই বলে কি আর হাঁটুর ব্যথাট্যথাও নেই! কথাখানা মানুষের তো ভাবা উচিত, না কি?
তাই ভূতেরা ঠিক করেছিল, ‘আর কোথাও যাইব না, আর কাহাকেও পাইব না…’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। শুধু লুল্লু ভূত তখনও আশা ছাড়েনি। আমিরের খুপসুরাত জেনানাকে রূপে ভোলাতে তখনও সে দু’টি বেলা গায়ে সাবান মাখত, ঘষতে-ঘষতে হাড়ের পরত খসে যেত, রক্ত নেহাত নেই, তাই বেরোত না! তাও লুল্লুর মরা শরীরের সাচ্চা প্রেম দেখে গোটা পাড়া তখন থ! সেই ১৮৭০ থেকে লুল্লুর প্রেমের গপ্প শুনতে শুনতে শেষে রবিঠাকুর যখন ১৮৯০-এর দশকে ‘কঙ্কাল’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’— এই সব লিখলেন, তখন সবাই একটু চমকে থমকে গেল! সতীসাধ্বী পেতনিরা ভাবলে, কী দজ্জাল মেয়েমানুষ রে বাবা, ভূত হয়ে সদর পেরিয়ে ঘরে ঢোকে, পরপুরুষের সামনে দাঁড়িয়ে সোজা গলায় প্রশ্ন করে, এমনকি সতিন দেখেও চোখের জল না ফেলে শক্ত গলায় জানতে চায়, ‘ও কে, ও কে গো?’ আর ভূতেরা একটু ধন্দ লেগে চুপ করে রইল! মরা মেয়েগুলো চায় কী? কী অসম্ভব ক্ষমতায় মেয়েমানুষ হয়েও তারা পেরিয়ে যায় চৌকাঠ, স্বামীর চোখের সামনে মৃত চোখ দুটো লজ্জায় নিচু হয় না, বরং দারুণ রাগে ঝলসে উঠে বলে, আর কত দিন? উত্তর দাও! সে চোখ দেখে ভয় পায় পুরুষও! সত্যি তো সে ভুলেই গেছিল বন্ধ ঘরের দরজার ও পারেও কী ভাবে জীবন কাটে, ক্ষোভ জন্মায়, আর সেই ক্ষোভ কী ভাবেই বা মৃত্যুতে নতুন প্রাণ পায়? পাগল মেহের আলি কি কোনও দিনও হিসেব করতে পেরেছিল সত্যি আর মিথ্যের সূক্ষ্মতম ফারাকটা, যার আড়ালে অনেকখানি কষ্ট মিশে সন্ধে ঘনাত রোজ, আর কবেই মরে যাওয়া ইরানি মেয়েটা ফিরে আসত শা-মামুদের ভাঙাচোরা প্রাসাদে! বরীচের শ্বেতপাথরের একলা প্রাসাদ শুধু জানত কতখানি রাগে সে প্রতি রাতে তার নরম শরীরটাকে আঘাতে চূর্ণ করত, কতখানি প্রত্যাশায় ভাবত তার মতো সাধারণ, ঘুণ ধরা, ভুলে যাওয়া জীবনে ব্যর্থতাটাই শেষ নয়, সে জীবনেও দাবি থাকতে পারে, আনন্দ চাওয়ার ইচ্ছেটুকুও থাকতে পারে! তার গল্পে রক্ত ছিল না, দেহ ছিল না, কিছুই তো ছিল না, ছিল শুধু গুমোট ভাঙা এক রাশ দমকা হাওয়া, আর শেষ হতে না-পারা আড়াইশো বছরের পুরনো ছেঁড়াখোঁড়া স্বপ্ন, যা কিনা কবেই জোর করে মিথ্যে করে দিয়েছিল মেহের আলি— ‘তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়’! সত্যিই কি সব মিথ্যে? বসন্তের হাওয়ায় সে দিনও নেশা ছিল ঠিকই, কিন্তু সে নেশায় যখন একটু একটু করে সে পাষাণ-প্রাসাদ জাগছে অমানুষী খিদেয়, তখন গোটা সমাজ, গোটা জীবন জুড়েই চারিয়ে যাচ্ছিল শিরশিরে ভয় আর ঠান্ডা কঠিন অন্ধকার। ভয়ে বিহ্বল হতে হতে মানুষগুলো ভাবছিল, এই বুঝি ফিরে দেখার শুরু। এখনও আরও এক সহস্র রাত্রির অপেক্ষা বাকি!
গোড়ায় অবিশ্যি তারা ভেবেছিল, এ অন্ধকার নেহাতই মনগড়া, এক্কেবারে ছেলে-ভোলানো! ‘বঙ্গবাসী’ পত্রিকায় ‘গদখালির হাত’ বলে সাড়া জাগানো গল্পটি ছেপে বেরোল বিশ শতকের শুরুর দিকে, আর তার পরে যখন গল্পের পর গল্পে শহরের ছেলে গ্রামে ফিরত, শহরের ডাক্তার ভেঙে পড়া জমিদারবাড়িতে রোগী দেখতে যেত, তখন বোধ হয় মানুষ প্রথম ভাবলে যে এহেন আষাঢ়ে গল্পেও সত্যি-মিথ্যে থাকতে পারে! নইলে উনিশ শতক থেকেই যখন খাতায়-কলমে গ্রাম তার দেশ-তৈরির পুণ্যভূমি, সেই গ্রামেই কিনা মশা আর ম্যালেরিয়ার মোচ্ছবে রমরমিয়ে বাড়ছিল মৃত্যু! দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাবা কার্তিকেয়চন্দ্র নৌকোয় যেতে যেতে দেখতেন, দু’পাশে সার দেওয়া মুর্শিদাবাদ, মালদা, হালিশহরের গ্রামগুলোয় রাতে আলো জ্বলত না, সকালে হাটবাজার বসত না, আদ্ধেক লোক মরে গিয়েছিল, আর বাকিরা ঠাঁই নিয়েছিল শহরে! গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছিল দূরে, অনেক দূরে। আর সেই দূরত্ব পাড়ি দিয়ে এক দিন হঠাৎই গ্রামে ফিরত ছেলে। অবাক হয়ে দেখত চার দিকে অন্ধকার, স্টেশনঘরে কলাবাদুড় আর বিছুটির রাজত্ব, মশার উপদ্রবে পথ চলা দায়! তবে তার মা সে দিনও অপেক্ষা করত, থালা সাজিয়ে ভাত বাড়ত, আসন পেতে জলছড়া দিত, তার পর নিবে যাওয়া গলায় বলত, ‘খাবি কি দিয়ে? দুটো লেবু পাড়ি?’ শীর্ণ, কঙ্কালসার তার মা— যে কিনা কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে, তার ওষুধ জোটেনি, পথ্যি জোটেনি, কী অদ্ভুত রহস্যে সেই হিম-হিম রাতেও দু’দণ্ড মৃত বাড়িটাকে বাঁচিয়ে তুলত, আর প্রবল ভয়ে দৌড়তে দৌড়তে পিছন ফিরে ছেলে দেখত, অনেক দূরে ঠান্ডা চাঁদের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে তার মরে-যাওয়া মা, আরও অনেক দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে তার ফেলে-আসা গ্রাম। যে গ্রামে আর ফেরা হবে না কক্ষনও!
শুধু কি ছেলেটা? বনফুলের গল্পের পসারওলা যদুডাক্তার— জমিদারবাড়ি থেকে রাতদুপুরে জরুরি ডাক এল, রোগী প্রায় যায় যায়! তা সাদা টাট্টুতে চেপে ডাক্তার চলেছেন তো চলেছেন, শেষে রাত তিনপহরে যখন ঘোড়া পৌঁছল, তত ক্ষণে রোগিণীর বাকরোধ হয়ে গিয়েছে। সাবধানে বাঁ-হাতখানা তুলে নাড়ি দেখতে গিয়ে ডাক্তার তো ভয়ে ঠান্ডা! সর্বনাশ, হাত কোথায়? এ তো একখানা কঙ্কাল। জ্ঞান হারানোর আগেও ডাক্তার শুনেছিলেন, ওরা ডাকছে, ব্যাকুল ভাবে বলছে, ‘ও ডাক্তার, ওষুধ দিলে না? ও ভালো হবে কী ভাবে?’ এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেয়ে চট করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ঢের সোজা ছিল। ডাক্তারও তা-ই করেছিল। রাত পেরোলে দেখেছিল কোথায় জমিদারবাড়ি, কোথায় কি? ধু-ধু মাঠের মধ্যে একলা শুয়ে, টাট্টুঘোড়াটা অবধি কাছেপিঠে নেই! দারুণ ভয় পেয়েছিল ডাক্তার। মনে পড়েছিল, গ্রামের পর গ্রাম তো কবেই মিলিয়ে গেছে দারুণ অন্ধকারে! মানুষগুলো সরকারি অনুদান পায়নি, খাবার পায়নি, ওষুধ পায়নি, শুধু নিত্যিদিনের জ্বরজারিতে পুড়তে পুড়তে তারা প্রাণে বাঁচতে চেয়েছিল। সেটুকু পাওয়ার অধিকার জানাতেই বুঝি ফিরে আসত তারা। নইলে প্রতি রাতে দূরের শহরে যখন আলো জ্বলত, কলের গান বাজত, লোকজন ভালমন্দ খেয়ে সুখেস্বচ্ছন্দে ঘুমোনোর কথা ভাবত, তখনই কেন দুর্দান্ত অভিমানে জেগে উঠত গ্রামগুলো? শহরের ডাক্তার ডেকে, বিলিতি মালগাড়ির পথ আটকে, প্রবাসী ছেলের অনভ্যস্ত চোখে তারা কি জোর করেই প্রমাণ করতে চাইত তাদের হতদরিদ্র, ক্লান্ত, অসুস্থ, অন্ধকার অস্তিত্বের সারটুকু? পশ্চিমি আধুনিকতার উচ্ছ্বাস আর উদ্যাপনের বিপরীতে টিকে থাকার রোজকার লড়াইয়ে যতই তারা একটু একটু করে গুটিয়ে যেত, ততই বুঝি রঙিন হত তাদের নিশুত রাতের রূপকথা? বিভ্রান্ত পথিকের চোখের সামনে জেগে উঠত রাজার ভাঙা প্রাসাদ, সারেঙ্গিতে বাজত মালকোষ, দমকা হাওয়ায় পাক খেত অনেক দিনের জমাট-বাঁধা আকাঙ্ক্ষা, অপ্রাপ্তি, অভিমান আর সাদা ঘোড়ার খুরের শব্দ। ভেঙে পড়া, নিঃস্ব অতীতের মাথার উপর জ্বলজ্বল করত ত্রয়োদশীর রূপসী চাঁদ, সে আলোয় ধ্বস্ত অতীতটাকেও যে কি অপরূপ মায়াময় লাগত!
তখনও কিছু মায়া রয়ে গিয়েছিল যে! তাই ভূতগুলো মরে গিয়েও মানুষের পাশে পাশেই থাকত। নইলে কিনা ১৯২০-র পড়ন্ত বেলায় যখন মানুষগুলো চোখকান বুজে দিব্যি যুদ্ধ বাধায়, যখন বোকা জোলা, নাপিত, আর আমলকী গ্রামের ভালমানুষ বেসুরো গাইয়েটার পাশে দাঁড়ানোর মতো জ্যান্ত লোক একখানিও থাকে না। সবাই তাদের গালমন্দ করে, গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়, তখন তাদের পাশে দাঁড়াল এক দল ভূত! উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের সেই ভূতেদের রাজা পরম মমতায় তাদের কাছে ডেকে জানতে চাইত, জীবনে কী চায় তারা? কী জোরালো অথচ কী সাধারণ একটা প্রশ্ন, যেটা করার সাহস জ্যান্ত মানুষ দেখিয়েছে কোনও দিন? কখনও সমাজ তার সামনে ছোট-বড়র ভাগাভাগির মস্ত বড় নোটিস ঝুলিয়েছে, আর কখনও তাকে পিছু ডেকেছে তার ভয়! ভদ্দরলোকে কি আর গরিব গাইয়ে-বাজিয়ের সুখদুঃখের খবর জানতে পারে? ভূতগুলোর অবশ্য সে সব ভয়-টয় ছিল না। ভয় করলে তার চলবেই বা কী করে? দারুণ যুদ্ধে তখন খুদকুঁড়োর মতো উড়ছে মানুষ, বুলেটে ঝাঁঝরা হচ্ছে তার দেহ, নাইট্রোজেন বাষ্পের বিষে ভরছে তার মন, তখন সেই ‘মানব-দানব’-এর সঙ্গে যুঝতে তো হত তাকেই! সেই ১৯৪০-এর শুরুতে হেমেন রায় লিখেছিলেন না, ‘অন্ধকারে ভুগিতেছে কলিকাতা নগরী!’ সে অন্ধকার এতই বিষম যে বিজলিবাতিতে ফিকে হয় না, মোমের আলোয় দিশা পায় না। সে অন্ধকার যে বড় কাছের, তাই বুঝি এত গভীর! আর শহরের সেই ‘বিভীষিকাময় ছায়া-মায়ার মধ্যে’ জেগে ওঠে ‘রাত্রির যাত্রীরা!’ মানুষই তো সস্নেহে তার শরীরে ঢেলে দেয় ফরমালিন, দেহ মুড়ে দেয় পুরনো মিশরীয় ব্যান্ডেজে! মানুষের মনের অন্ধকারের জোগান দিতে রোজ রাতে পথে নামে তারা, মানুষ মারে। আর দু’-চার জন পথচারী যারা বেঁচে ফেরে, অবাক হয়ে দেখে, চাঁদের আলোয় হাওয়ার বেগে ছুটে চলেছে জমাট-বাঁধা খানিকটা অন্ধকার। আর তার পর?
‘অন্ধকারে’ দিশা পাচ্ছিল না মানুষটা। তাকে পথ চিনে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল তো ভূতটাই! শরদিন্দুর গল্পের ভূতটাকে কেউ কখনও চোখে দেখেনি, অন্ধকারে শুধু শুকতারার মতো ফুটেছিল তার এক চিলতে হাসি, গলায় অনেকখানি যন্ত্রণা নিয়ে সে বলেছিল, ‘হয়ত বিপদে পড়লে আবার দেখা হবে’! সে-ও তো মানুষ ছিল না, তাই কথা রেখেছিল! নইলে পাহাড়ের উপর ‘লাল টিনের ছাদের বাড়িটা’ তো কবেই বোমারু হানায় উড়ে গেছিল! তাও কুসুমকুমারী রোজ আসত সেখানে। আহত সেনাদের আশ্রয় দিত। অন্ধকার পেরিয়ে তার বাগানে ফুটফুট করত চাঁদের আলো, আর সেই আলোয় দিশি মুরগির ডিমের ঝোল দিয়ে কুসুমকুমারী গরম গরম ভাত বেড়ে দিত অতিথিদের। তার পর, সেই রোগাপ্যাংলা রিফিউজি ভূতগুলো? একপেট খিদে, মৃত্যু আর ‘তেপান্তরের পারের বাড়ির’ মনখারাপ করা অন্ধকারেও তারা এক গাল হেসে বলেছিল, আগে কথা দাও, এ বাড়িতে লোক আসবে, দু’বেলা ভাত রান্না হবে, ছোটরা পেট ভরে খাবে, তবেই যাব আমরা! লীলা মজুমদারের ভাল ভূতেরা পঞ্চাশের দশকে কত যে বন্ধু পাতিয়েছিল, কত ভাঙা ঘর জোড়া লাগিয়েছিল, কত বিষণ্ণ জীবনে গোলাপি বাতাসার মতো ভিজে ভিজে ফুরফুরে আনন্দ এনে দিয়েছিল, তার শেষ নেই।
তবে প্রশ্নটা কিন্তু রয়েই গিয়েছিল। আর সে প্রশ্নে মানুষ ভয় পেত বার বার! সন্দেহ নেই, মানুষই তো তার সহজ-সরল পুরনো আমিটাকে তুলোট কাগজে মুড়ে স্মৃতির কোন খুপরিতে পুরে দিয়ে ভুলে গেছিল! সত্যজিতের গল্পের মানুষ আর ভূত তাই এক জনই। মরে যাওয়া ছেলেবেলাটা ডাগর চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে দেখছিল বড়বেলাকে, নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছিল, সে এতখানি অচেনা হল কী ভাবে! আর বড়বেলাটা ভয় পাচ্ছিল তারই নির্মল ছেলেবেলাটাকে! ইচ্ছে করলে কি আর এক বার ও রকম হতে পারে না সে? কিসের ভয় তার? এই কথাই তো শুধিয়েছিল শীর্ষেন্দুর গল্পের রোগা কালো ছেলেটাও। ছোড়দা একা একা ভয় পেত বলে, কলঘরের সামনে নিয়ম করে ছেলেটা দাঁড়াত! তার পর কাজ মিটে গেলে জিজ্ঞেস করত, ‘তা, তোমার এত ভয় কিসে?’
সত্যি তো, কিসের এত ভয়? যে দ্বন্দ্বের গল্প মানুষই সাজিয়েছে আজীবন, যে সমাজটাকে ছোট্ট থেকে দ্বন্দ্বের নিয়মকানুন শিখিয়ে বড়টি করেছে, সেই সমাজের নিয়মগুলো ভাঙতে দেখে, তাদের যুক্তির উপর যুক্তি সাজাতে দেখে আজ কেন এত ভয় হয় তার? সে কি ভাবে— এই দ্বন্দ্বটুকু না থাকলে, সাদাকালোর এই বিরোধটুকু না থাকলে সমাজের নিয়ামক হিসেবে তার গল্পও ফুরোবে এক দিন? সে কি ভয় পায় সেই দিনটাকে, যে দিন সত্যিই মানুষ আর ভূতে একাকার হয়ে এক সঙ্গে দেশভাগের কষ্টের হিসাব চাইবে? সমাজে, জাতিতে, ছেলেতে-মেয়েতে এত যে কাটাছেঁড়া করে নিয়মনীতির কাঠামোগুলো এত কাল জিইয়ে রেখেছে মানুষ, ভূতগুলো কি সেই গল্পটাই বদলে দেবে? কেমন হবে সেই নিয়ম-ভাঙার সমাজ? সেখানে কি সবটাই ভাসা-ভাসা আর স্বপ্ন-স্বপ্ন? যে স্বপ্নে এক সঙ্গে খেলা করবে ভূতের ছানা আর মানুষছানা? খেলতে খেলতে মাটিতে পড়ে যাবে মানুষছানা, ভূতছানা তাকে টেনে তুলবে আর এক সঙ্গে দু’জনে মিলেই দৌড়ে আসবে মায়েদের দিকে? বিকেলের পড়ন্ত রোদে তাদের হাসি ঝকঝক করবে? বোঝাই যাবে না যে কে মানুষ আর কে ভূত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy