মিষ্টিমুখ: শ্রীরামপুরের গুটকে ও বাঁ দিকে, বেলিয়াতোড়ের মেচা।
বঙ্গীয় মিষ্টান্নজগতে বর্ণভেদের প্রাবল্য দেখা যায়। পৃথিবীর আর কোনও খাবারের জগতে এত বর্ণের ছটা নেই। এই বাক্যের পরে একটা সতর্কীকরণ প্রযোজ্য, যত দূর জানি। কত রকম মাপকাঠিতে যে বাঙালির মিষ্টিজগৎকে ভাগ করা যায়! রসের বিচারে, সরস এবং নীরস। পাক প্রণালীতে, ভাজা, পোড়া এবং ভাপা। বয়সের বিচারে সনাতন এবং সামন্বয়িক। এটা একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে। সনাতন মিষ্টি হল সন্দেশ। কড়া বা নরম, উভয় রকমই। এই সনাতন মিষ্টি যখন গোঁড়ামি ত্যাগ করে ক্যাডবেরিকে আপন করে নেয় তখন তা হয় সামন্বয়িক। অনেকটা সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের মতো। যেমন, সত্যপির এবং তাঁর পুজোয় নিবেদিত শিরনি। উদার বাংলার সকলকে আপন করে নেওয়ার এ এক গর্বিত উদাহরণ।
অবশ্য বয়সের দিক থেকে বিচার করলে বাংলার বেশির ভাগ মিষ্টিই সামন্বয়িক। কারণ একটা মত তর্কযোগ্য কিন্তু প্রচলিত, ছানা নিজেই বিদেশি। বলা হয়ে থাকে, পর্তুগিজদের কাছ থেকে ছানা তৈরি শিখে বাঙালি তা মিষ্টিতে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। এ দিক দিয়ে বিচার করলে মিষ্টির আর একটা ভাগ হয়, প্রাক্-ছানা, ছানা-পরবর্তী।
কিন্তু মিষ্টির কি এমন বর্ণভেদ করা উচিত? আস্বাদ রস অর্থাৎ উপভোগই মিষ্টি বিচারের মাপকাঠি হওয়া দরকার। মুশকিলটা হল, উপভোগের কথা উঠলেও মিষ্টির ভাগ-যোগ হয়ে যায়। মানে বর্ণভেদ। বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের দেশে ভাগাভাগিটা বড়ই প্রবল। খাবারও বাদ যায় না। দেশ-কাল বড়ই প্রভাবশালী। সুতরাং উপভোগের বিচারে মিষ্টিমহলেও বেড়া তোলা। যদিও এ সরস বেড়া। আবার এটাও ঠিক, খাবার কোনও বেড়া মানে না।
অনেক ভেবে দেখা গেল, উপভোগের বিচারে বাংলার মিষ্টির বর্ণভেদ দু’প্রকারের— রাজভোগ এবং দেবভোগ। রাজভোগ অর্থে রসগোল্লার বড়দা বা জেঠু নয়। রাজার ভোগ্য। ভাগাভাগিকে প্রতিষ্ঠা করতে ‘রাজা’ শব্দটির কিঞ্চিৎ বিস্তার প্রয়োজন। রাজা অর্থে শাসক। এই শাসক হতে পারেন ব্রিটিশ পদাধিকারী। হতে পারেন দেশীয় রাজা। আবার রাজার ক্ষুদ্র সংস্করণে জমিদারও হতে পারেন।
কয়েকটি রাজভোগের উদাহরণ। যেমন, লেডিকেনি। এ হল ব্রিটিশ রাজভোগ। বঙ্গেশ্বর লর্ড ক্যানিংয়ের স্ত্রীর সম্মানে তৈরি মিষ্টি-কাহিনি তো কিংবদন্তি। আর একটি ব্রিটিশ রাজভোগের উদাহরণ পশ্চিম মেদিনীপুরের ক্ষীরপাইয়ের বাবরশা। শোনা যায়, এডোয়ার্ড বাবর নামে এক ইংরেজ রেসিডেন্টের সম্মানে এই মিষ্টান্নটি তৈরি করেছিলেন পরাণ আটা নামে এক মোদক। দেশীয় রাজভোগের উদাহরণ অনেক। অনেকে বলে থাকেন, বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের মেচা সৃষ্টির সঙ্গে মল্লরাজাদের যোগ রয়েছে। সীতাভোগ তৈরি হয়েছিল বর্ধমানের মহারাজার অনুরোধ বা আদেশে। আবার কিছু মিষ্টি আছে যেগুলো ব্রিটিশ এবং দেশীয়, উভয়ত রাজভোগ। যেমন, মুর্শিদাবাদের ছানাবড়া। সৃষ্টিতত্ত্বে মতান্তর রয়েছে। তবুও একটি মত বলে, বহরমপুরের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কোনও এক ইংরেজকে তুষ্ট করতে পটল ওস্তাদ নামে এক মোদককে ছানাবড়া তৈরির বরাত দেন। বর্ধমানের বিখ্যাত মিহিদানা তৈরি হয়েছিল রাজার আদেশে। কিন্তু তিনি নাকি বাংলার গভর্নর এবং কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতিকে আপ্যায়নে এই মিষ্টান্ন তৈরি করিয়েছিলেন।
দেবভোগের উদাহরণও কম নয়। যেমন, শ্রীরামপুরের গুটকে সন্দেশ। জনশ্রুতি, এই এলাকার প্রাচীন মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতা রাধাবল্লভের প্রিয় ছিল গুটকে সন্দেশ। ভোগে দিতে হত। এক দিন পুরোহিত কোনও কারণে গুটকে সন্দেশ দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। রাধাবল্লভ বালকের ছদ্মবেশে দোকানে বালা বন্ধক দিয়ে গুটকে সন্দেশ খান। এই জন্য একে বালা সন্দেশও বলা হয়। এই কিংবদন্তির সঙ্গে অনেকে বৃন্দাবনের বাঁকেবিহারীর মিল পাবেন। বাঁকেবিহারী দইবড়া খাওয়ার জন্য হাতের বালা বন্ধক রেখেছিলেন। যদিও দইবড়াকে মিষ্টির পর্যায়ে ফেলা যায় না।
চেষ্টা করলে মিষ্টির আর একটা ভাগ করা যায়। সেটা হল লেখকভোগ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের নামে আশুভোগ সন্দেশ, মোতিলাল নেহরুর নামে নেহরু সন্দেশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু লেখকদের জন্য কোনও মিষ্টি তৈরির কথা শোনা যায় না। তবে লেখকেরা কী মিষ্টি খেতে ভালবাসেন বা ভালবাসতেন তা নিয়ে আগ্রহ থাকে। কিছু মিষ্টি তাঁদের কল্যাণে চর্চিত হয়। যেমন, শিবরাম চক্রবর্তীর রাবড়ি-প্রীতি। শিবরাম-কৃত একটি মিষ্টি অবশ্য রয়েছে। রাবড়ি-চূর্ণ। পাকপ্রণালী হল, গুঁড়ো দুধ আর চিনির মিশ্রণ। শিবরামের মতোই সরল পাক।
ঘটনা হল, রাজভোগ এবং দেবভোগের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্কিত লেখকভোগ। মালপোয়ার কথা বলা যায়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় পুরী গিয়েছেন, সঙ্গী গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং সুমথনাথ ঘোষ। বিভূতিভূষণ মালপোয়া খেতে চাইলেন। তখন রাত। মালপোয়া পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমন সময় পান্ডার ছড়িদার পৌঁছে দিলেন মালপোয়া। জানালেন, জগন্নাথ দেবের শৃঙ্গারভোগ নেমেছে। পান্ডা পাঠিয়েছেন। রাজভোগ-লেখকভোগ সম্পর্কও রয়েছে। কৃষ্ণধন দে ছিলেন কবি। বাংলার প্রথম কথা-বলা সিনেমার অনেক গান লিখেছিলেন ইনি। বর্ধমানে কোনও সাহিত্যসভায় যাওয়ার সময়ে দুর্ঘটনা ঘটল। বর্ধমান হাসপাতালে ভর্তি তিনি। নার্স কৃষ্ণধনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “খাবেন কিছু? কী দেব?” কৃষ্ণধন নার্সকে জানিয়ে দিলেন, এক সের মিহিদানা খাবেন। বর্ধমান হাসপাতাল শুনে তাঁর মিহিদানার কথাই মনে হয়েছে।
লেখকভোগের কথা উঠলে বইপাড়ায় নববর্ষ পালনের প্রসঙ্গ এসে পড়া স্বাভাবিক। লেখকসমাগম, আড্ডা, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। পয়লা বৈশাখে লেখকদের নিয়ে আড্ডা, সাহিত্যপাঠের এই রীতির প্রবর্তক ‘গুপ্তকবি’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। অন্তত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাই বলছেন। তাঁর লেখা অনুযায়ী, “সন ১২৫৭ সাল হইতে ঈশ্বরচন্দ্র একটী নূতন অনুষ্ঠান করেন। নববর্ষে অর্থাৎ প্রতিবর্ষের ১লা বৈশাখে তিনি স্বীয় যন্ত্রালয়ে একটী মহতী সভা সমাহূত করিতে আরম্ভ করেন।” সেই সভাকে মহাজন মণ্ডলী বলা যায়। সভায় নগর, উপনগর এবং মফস্সলের প্রায় সমস্ত সম্ভ্রান্ত লোক এবং সে সময়ের সমস্ত বিদ্বান ও ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা আমন্ত্রিত থাকতেন। কলকাতার সম্ভ্রান্ত পরিবার যেমন ঠাকুরবংশ, মল্লিকবংশ, দত্তবংশ, শোভাবাজারের দেববংশের গণ্যমান্যরা সভায় যোগ দিতেন। সভায় প্রবন্ধ, কবিতা পাঠ হত। আর সভা শেষে থাকত মহাভোজ। শ’পাঁচেক আমন্ত্রিত খেতেন। বঙ্কিমচন্দ্র লেখেননি, কিন্তু ‘গুপ্তকবি’র ভোজে নানা মিষ্টি থাকত অবধারিত। বাঙালির শেষ পাতে মিষ্টি থাকবে না!
পয়লা বৈশাখে সাহিত্যিক সমাবেশের রীতি এখনও রয়েছে। খাওয়াদাওয়াও হয়। তবে বইপাড়ায় এক সময় বিশাল জাঁক হত পয়লা বৈশাখে হালখাতা উপলক্ষে। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার কাগজওয়ালা, প্রকাশক, বই বিক্রেতা নতুন খাতা করতেন। দুই বড় কাগজ ব্যবসায়ীর বাড়িতে তো ভিয়েন বসানো হত। হালুইকর রান্না করতেন। ভিয়েন বসা মানেই নানা মিষ্টির আয়োজন। হালখাতার দিনে ‘দাদাঠাকুর’ অর্থাৎ শরৎচন্দ্র পণ্ডিতকে নিয়ে একটি গল্প রয়েছে। তিনি এক কাগজ ব্যবসায়ীর দোকানে গিয়েছিলেন হালখাতা উপলক্ষে। জঙ্গিপুরে নিজের প্রেসের জন্য কেনা কাগজপত্রের বিল মিটিয়ে তাড়াতাড়ি আদায় উসুল করে দিতে বললেন। কারণ তাঁকে সে দিনই জঙ্গিপুরে ফিরতে হবে। এই ব্যবসায়ীর বাড়িতে এলাহি আয়োজন হত। কাউন্টারে থাকা মালিকপক্ষকে দাদাঠাকুর বলেছিলেন, “ও মিষ্টি-ফিষ্টি খাবো না, ছাঁদা বেঁধে দে।”
দুঃখের কথা, ‘গুপ্তকবি’ এবং ‘দাদাঠাকুর’ উভয়ের ভোজেই মিষ্টির নামগুলো জানা যায় না। জানতে পারলে মজা হত আরও সরস। লেখকভোগের তালিকা সমৃদ্ধ হত।
তথ্যসূত্র: কবিতা সংগ্রহ- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা; কলেজস্ট্রিটের সত্তর বছর (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড)— সবিতেন্দ্রনাথ রায়; বাংলার খাবার— প্রণব রায়; ‘বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি’— এককড়ি চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy