রাত দেড়টা। জামশেদপুরের ডিমনা লেক থেকে কিছুটা ভিতরে, দলমার সীমানায়, জঙ্গলে আমরা পাঁচ জন দাঁড়িয়ে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। চাঁদের আবছা আলোয় পাশের লোকের অবয়বটুকুই শুধু বোঝা যাচ্ছে। মাস কয়েক আগে এই দলমা পেরিয়েই পুরুলিয়ায় গিয়েছেন দক্ষিণ রায়।
তবু জঙ্গলে গাড়ির জোরালো আলো জ্বেলে রাখা যাবে না। দূর থেকে তা দেখে প্রতিযোগী সচেতন হলেই মুশকিল। তাই অন্ধকারে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। সঙ্গী বলতে জঙ্গলের অজানা বাসিন্দারা, অজস্র জোনাকি আর ঝাড়খণ্ড রাজ্য পুলিশের তিন সশস্ত্র কর্মী।
সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডের ‘রেড করিডোর’-এর কিছুটা অংশ জুড়ে এই প্রথম আয়োজিত হল দিন-রাতের ‘ওয়াইল্ড অ্যাডভেঞ্চার কার র্যালি’। রাঁচী থেকে জামশেদপুর পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কিলোমিটার রাস্তায় ‘টিএসডি’ (টাইম-স্পিড-ডিসট্যান্স) র্যালি। তাই পুলিশি নিরাপত্তা বেশ আঁটোসাঁটো।
ছ’বছর ধরে ‘রাঁচী অ্যাডভেঞ্চার হুইলার্স’ এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। কিন্তু এ বারের বিষয় একদম আলাদা। কর্মকর্তা আশিস বুধিয়া জানালেন, দিন-রাতের এই জাতীয় স্তরের গাড়ি প্রতিযোগিতা দক্ষিণ ভারতে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু পূর্ব ভারতে রাতে জঙ্গলে গাড়ি প্রতিযোগিতা এই প্রথম। মাওবাদী আন্দোলনের পর এই প্রথম রাতে ছোটনাগপুর মালভূমির বুকে ছুটল ২৬টি গাড়ি।
শুধু গতিবেগে প্রথম হওয়া নয়, এই র্যালি আরও অনেক কারণেই আলাদা। দিনের বেলা বইয়ে আঁকা চিহ্ন-সঙ্কেত দেখে রাস্তা চেনা, রাতে আলো না জ্বেলে কাঁচা রাস্তা পার হওয়া, নির্দিষ্ট গতিবেগ এবং অন্যান্য নিয়মকানুন মেনে চলা, দুর্ঘটনা না ঘটানো ইত্যাদি হরেক বিষয়ে সফল হতে হয় গাড়ির চালকদের। কষতে হয় সময়-দূরত্বের পাটিগণিতও।
এই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে কাশ্মীর, ইন্দোর, রাজস্থান, পশ্চিমবঙ্গ, কোয়ম্বত্তূর-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত ৫৫ জন প্রতিযোগী উড়ে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে আট জন মহিলা। হরিয়ানার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল রীনা ঝা বলেন, “ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে রাতে গাড়ি চালানোর রোমাঞ্চ ছাড়ি কী করে!”
এই র্যালির জন্য অন্তত চার-পাঁচ মাস ধরে রাঁচী ও জামশেদপুরের আশপাশের এলাকা ঢুঁড়ে বেশ কিছু দুর্গম রাস্তা খুঁজে বার করেছেন হুইলার্সের সদস্যেরা। এর মধ্যে রাঁচীর সিকিদিরি, ভুসুর, চারো, জামশেদপুরের জোনহা, চৌকা এলাকা, চান্ডিল বাঁধ দিয়ে রাস্তা গিয়েছে। তেমনই এক চিলতে রাস্তার পাশেই আমরা দাঁড়িয়ে প্রতিযোগীদের গাড়ি ছুটিয়ে আসার অপেক্ষায়। তবে কাঁচা রাস্তা দিয়ে বেশি জোরে চালানোর উপায় নেই। গতিবেগও বেঁধে দেওয়া।
পুলিশকর্মীরাও কিছুটা থতমত। বুঝতে পারছেন না, এত রাতে কেন জঙ্গলের রাস্তায় কষ্ট করে গাড়ি চালানো। গাড়ি চালিয়ে আসবেনই বা কারা! এসেই বা কী করবেন!
হঠাৎই জঙ্গলের বাঁ দিকের বুক চিরে এল আলো। ক্রমশ আলোটা সাপের মতো ঘুরে চলে এল সামনে। কিন্তু রাস্তা সমান নয়। একটু জোরে চালিয়ে এসেও থমকে যেতে হল। রাস্তাটা কিছুটা নেমেই আবার উঠে গিয়েছে। পাশ থেকে মোটর স্পোর্টস ক্লাব ফেডারেশনের বিশু বন্দ্যোপাধ্যায় বলে উঠলেন, “গাড়ির কোনও অংশ ধাক্কা না খেয়ে রাস্তায় উঠে যাবে, এতেই বোঝা যাবে চালকের দক্ষতা।”
রাস্তার এই বাঁকটি বেশ জটিল। তাই সব ক’টি গাড়ির নির্বিঘ্নে পার হওয়া পর্যন্ত অন্ধকারে ওখানেই রিকভারি ভ্যান নিয়ে আমাদের অপেক্ষা করতে হল। জিপিএস এখানে কাজ করে না। ফোনের সিগন্যাল নেই। জানার উপায় নেই প্রতিটি গাড়ি পেরোল কি না। কোনও মতে ওয়াকিটকিতে বাকিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এলাকা ছাড়লাম।
এ বার আমাদের কাজ র্যালির রুটে প্রহরায় থাকা পুলিশকর্মীদের রেহাই দেওয়া। কিন্তু তাঁদেরকেই বা এই জঙ্গলে খুঁজব কোথায়! এক মানুষ সমান ঘাসের জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে গাড়ি নিয়ে কিছুটা এগোতেই অন্ধকার থেকে জংলা পোশাকে বেরিয়ে এলেন এক পুলিশকর্মী। তাঁকে ও তাঁর সঙ্গীদের জানিয়ে দেওয়া হল, ওই এলাকায় তৃতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা শেষ।
পর দিন সকালে ফের তোড়জোড় শুরু প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়ের। সবার হাতে একটা করে রোডবুক। সেটাই চালক আর তাঁর সঙ্গী পথপ্রদর্শকের জন্য রাস্তার মানচিত্র। তাতে নেই রাস্তা বা এলাকার নাম। রয়েছে কয়েকটা চিহ্ন, মাধ্যমিকের ভূগোল পরীক্ষায় মানচিত্র আঁকতে যা ব্যবহার হয়। সঙ্গে লেখা আছে কিলোমিটার। ঠিক কত কিলোমিটারে ওই জায়গায় ঠিক কী আছে, পাকা বা কাঁচা রাস্তা, গাছ বা বাড়ি, সবই বিভিন্ন চিহ্ন দিয়ে ওই রোডবুকে আঁকা।
পথপ্রদর্শকের কাজ এখানে বেশ জটিল। বইয়ে আঁকা চিহ্নের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে রাস্তা দেখাতে হয় চালককে। কিন্তু টিএসডি-র বাধা একটাই। গতিবেগ নির্দিষ্ট। গাড়ি ছোটালেই হবে না। সময়-দূরত্বের অঙ্ক কষে কিলোমিটার হিসাব করে গাড়ি ঠিক রাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এতে রাস্তা হারিয়ে ফেলার আশঙ্কাও আছে। প্রতিযোগিতার প্রথম রাতেই যেমন রাঁচীর ভিতরে একটি গ্রামে রাস্তা হারিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা ললিতা গৌড়া ও সঙ্গী চালক ক্ষমতা যাদব। ফোনে কোনও মতে যোগাযোগ করতে পেরে সাহায্য করেন ক্লাবকর্তা মণীশ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “ওই অন্ধকারে, যেখানে ভরসা শুধুই গাড়ির আলো, নাম না জানা একটি জায়গা থেকে মাথা ঠান্ডা করে ঠিক রাস্তাটা বার করাটাও তো চ্যালেঞ্জ!”
সেই জন্যই কি এই প্রতিযোগিতার জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমছে! ফেডারেশন কর্তা জে পৃথ্বীরাজ বলেন, “নতুন প্রজন্ম গতির নেশায় ছোটে। তাই এই প্রতিযোগিতায় নতুন প্রজন্মের যোগদান খুবই কম।” প্রতিযোগীদের বেশির ভাগই বেশ পুরনো ও অভিজ্ঞ।
অথচ এখন অনেকেই দুরন্ত গতির গাড়ি, বাইক নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে যোগ দেন। আশিসের বক্তব্য, “গতিই সব নয়। তার সঙ্গে রাস্তায় গাড়ি চালানোর নিয়ম, দক্ষতা জানা না থাকলে বিপদ অনিবার্য। এই প্রতিযোগিতা তা নিয়েই।”
রাঁচীর রাস্তা ছেড়ে জামশেদপুর যেতে হাইওয়ে ধরতে হয়। প্রতিযোগীদের জন্য সেখানকার নিয়ম আলাদা নয়। বরং হাইওয়েতে বেঁধে দেওয়া গতিবেগ ধরে, নিয়ম মেনেই তাঁকে গন্তব্যে যেতে হবে। দেরি হলে অসুবিধে নেই। কিন্তু চলতে হবে গ্রাম-জঙ্গল-রাস্তার নিয়ম মতে।
এ বারের প্রতিযোগিতা নিজে গাড়ি চালিয়েই শুরু করেছিলেন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন। প্রথম রাতে রাঁচী থেকে কিছুটা ভিতর পর্যন্ত গাড়ি চালিয়ে যান। তিনিও কৌতূহলী ছিলেন দেখার জন্য যে, এই র্যালিতে আলাদা কী হয়!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)