স্টিলের থালায় সয়াবিন-আলুর ঝোল মাখা ভাত। এক থালা থেকেই হাসিমুখে তা খাচ্ছে দুই বালক, সন্দীপ সাহা ও সোলেমান শেখ। মালদহের মোথাবাড়ির অলিটোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিডডে মিলের সেই পুরনো ছবি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে সমাজ মাধ্যমে। নিখাদ, নির্মল, নিষ্পাপ। ধর্ম, জাত বা পরিচয়ের জটিলতা ছাপিয়ে উঠে এসেছে এক সরল মানবিক ছবি— ‘ভাগ করে খাওয়া, ভাগ করে থাকা’।
এই ছবি আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে শুধুই মমতাময় নয়, প্রাসঙ্গিকও। কারণ আমরা এমন এক সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি, যেখানে বিভাজনের ভাষা হয়ে উঠছে উচ্চারিত সত্য। আর সহাবস্থানের চর্চা কেমন যেন ইতিহাসের পাতায় গচ্ছিত। সে তুলনায় এই দু’টি শিশুর এক থালা থেকে খাওয়ার দৃশ্য যেন এক অবিনাশী প্রশ্ন তুলে দেয়— ‘‘আমরা কি বড় হয়েছি, নাকি ছোট হয়ে পড়েছি?’’
এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত একটি স্মৃতি মনে পড়ে। আমার স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে বহু বন্ধু পেয়েছি, যাঁরা হিন্দু। কেউ এখন শিক্ষক, কেউ চিকিৎসক, কেউ বা ব্যবসায়ী। এক সময় আমরা এক ঘরে থাকতাম, একসঙ্গে খেতাম, বিকেলে হাতে ব্যাট-বল নিয়ে মাঠে ছুটতাম। রোজার মাসে আমার বন্ধুরা ইফতারের আয়োজন করত। আবার দুর্গাপুজোয় আমি অংশ নিতাম আনন্দ করে। তখন আমাদের মধ্যে কোনও দেওয়াল ছিল না, ছিল না ‘তুই-আমি’-র হিসেব। এই সম্পর্কগুলি ছিল বিশ্বাসের, ভরসার, একান্ত আপন হয়ে ওঠার।
কিন্তু আজ?
আজ দেশের নানা প্রান্তে ধর্মের নামে সংঘাত, চিন্তার নামে শিবির বিভাজন, মতের নামে ‘অন্যতা’-র প্রতি আক্রমণ। সামাজিক পরিসরে তৈরি হচ্ছে এক অদৃশ্য সংকোচ— কাকে কী বলব, কার সঙ্গে কোথায় যাব, কতটা প্রকাশ করব নিজের অনুভব? এই সংকোচ নিছক মানসিক নয়, অনেক সময় তা আকার নেয় হিংসা, বিদ্বেষে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সন্দীপ আর সোলেমানের এক থালা ভাত খাওয়ার ছবি হয়ে ওঠে প্রতিরোধের প্রতীক। এ ছবি মনে করিয়ে দেয় সহাবস্থান ও সহমর্মিতা এখনও শিকড় ছড়ানো এক চেতনা—যা হয়তো আগুনে পোড়া মাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু এক বার বৃষ্টি এলেই আবার প্রস্ফুটিত হবে।
আমরা প্রাপ্তবয়স্কেরা যেটুকু হারিয়েছি, শিশুদের মধ্যে তার স্পষ্ট প্রতিফলন এখনও রয়েছে। হয়তো এই জন্যই বড়দের আজ শেখার রয়েছে শিশুদের কাছ থেকেও। সহজ করে ভাবতে শেখা, ধর্ম নয়, মানুষ দেখে ভালবাসতে শেখা। রাষ্ট্র, রাজনীতি বা সমাজ যতই বিভাজনের রাজনীতি করুক, প্রকৃত শিক্ষা যদি মানবতার হয়, তবে সেই বিভাজন কখনও চূড়ান্ত হতে পারে না। এই মুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন এক ধরনের আত্মসমীক্ষার। কোনও রাজনৈতিক পর্যালোচনা নয়, নিছক নাগরিক দায়বোধ থেকে আমরা যদি প্রশ্ন করি, আমরা কোথায় যাচ্ছি? কী চাইছি? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কেমন সমাজ রেখে যেতে চাইছি? তা হলে হয়তো উত্তর পাওয়া যাবে সন্দীপ-সোলেমানদের নির্দ্বিধায় ভাগ করে খাওয়ার মধ্যে।
এক থালার ভাতে যেমন সব দানা মিশে যায়, তেমনই সমাজও হতে পারে বৈচিত্র্যের সমাহার। দরকার শুধু চোখে দেখার মতো দৃষ্টি আর মনে রাখার মতো মন। বিভাজন নয়, সংযোগই হোক আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)