‘‘আমাদের জমিটা কি পড়েই থাকবে?’’
টিভিতে তখন পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনিতে জিন্দল গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের শিলান্যাস করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কুড়ি বছর ধরে যে আশা জিইয়ে রেখেছেন এনটিপিসির প্রস্তাবিত কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জমিদাতারা, তা আক্ষেপ হয়ে ঝরছে তাঁদের কথায়। যদিও অনেকেই মনে করেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সদিচ্ছা হলে এখনও তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে পারে ওই জমিতে। নাহলে প্রায় আটশো একর জমি ফেলে না রেখে শিল্প পার্ক বা অন্য কোনও শিল্প গড়ারও দাবি করেছেন তাঁরা। তাতে কর্মসংস্থানের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নও ঘটবে।
জমিদাতাদের দাবি, ২০১৮ সাল পর্যন্ত কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়া নিয়ে সদর্থক মনোভাবই ছিল কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের। কিন্তু ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে দুই সরকারের তিক্ততার প্রভাব পড়ে ওই প্রকল্পেও। দু’বার বিশ্বব্যাপী দরপত্র ডাকা হয়। জাপান ও উত্তর কোরিয়ার সংস্থা এগিয়ে আসে। কিন্তু রাজনৈতিক-টানাপড়েনে কাজের বরাত দেয়নি এনটিপিসি। অথচ শিবির করে জমি কেনা হয়েই গিয়েছিল। এই সংস্থার প্রাক্তন কর্তা অভিজিৎ সেন বলেন, “কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে উঠলে ভাল হত। কম খরচে বিদ্যুৎ তৈরি করা যেত।”
বাম আমলে জমি-অধিগ্রহণ নিয়ে রাজ্য যখন উত্তাল, সে সময় কাটোয়ার জমিদাতারা প্রায় নির্বিঘ্নে সরকারের হাতে ৫৫৬ একর জমি তুলে দেন। সেখানে রাজ্যের বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগম (পিডিসিএল) তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়বে বলে ঠিক ছিল। পরে এনটিপিসি সেই দায়িত্ব নেয়। সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্ত মেনে বাড়তি ১৯৭ একর জমি কিনতে রাজি হয় তারা। প্রায় ১৫০ একর জমি কিনে ফেলে। শুধু গঙ্গা থেকে জল আনার প্রায় চার কিলোমিটার রাস্তায় পাইপ লাইন বসানোর জমি আর মূল জমির ভিতর কিছু দেবত্তর সম্পতি আর কয়েক জনের চাষির আপত্তিতে ৫০-৬০ একর জমি কেনা বাকি ছিল।
এনটিপিসির এক কর্তার কথায়, “মহারাষ্ট্রের শোলাপুরে ২৫০ কিলোমিটার দূর থেকে মূল বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত রেল লাইন পাততে হয়েছে। জল আসে ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে। জমি সমান করতেও কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে। আর কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের থেকে রেল লাইন ৫০০ মিটার দূরে, জলের জন্য ১২ কিলোমিটার পর্যন্ত পাইপ লাইন বসাতে হত। কয়লা পাওয়াটাও সমস্যার ছিল না। জমি সমান করার জন্যও খরচ হয়নি। কিন্তু তাও প্রকল্পও করা গেল না।”
আর এক কর্তারও দাবি, “কাটোয়ার সঙ্গে পূর্ব ভারত, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ লাইনের যোগাযোগ রয়েছে। বিদ্যুৎ বিক্রিটাও সমস্যা ছিল না।”
তাহলে সমস্যা কোথায়? সবারই এক কথা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে কিছুটা কাঁটাতার, কিছুটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা দিগন্ত বিস্তৃত্ব জমি ধূ ধূ করছে। জল জমছে। অথচ মুখ্যমন্ত্রী ২০২৩ সালের মে মাসেও কাটোয়ার জমিতে শিল্প গড়ার কথা বলেছিলেন। জমি ফেরত নিতে চেয়ে রাজ্য সরকার চিঠি দেয়। পাল্টা জমির দাম ও অন্য বিনিয়োগের খরচ বাবদ ৩৭২ কোটি টাকা দাবি করে চিঠি দেয় এনটিপিসি। দু’বছরেও সেই জট কাটেনি।
এ দিন জমিদাতা উৎপল গুপ্ত, সোমেশ গুপ্তদের কথায়, “কর্মসংস্থানের আশায় জমি দিয়েছিলাম। যুবক থেকে বুড়ো হয়ে গেলাম। পরের প্রজন্ম কলেজে পড়ছে। তাঁদেরও কাজ প্রয়োজন। বলে না, আশায় বাঁচে চাষা...।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)