আইএফএ শিল্ড জয়ের উচ্ছ্বাসে শ্যাম থাপাকে আদর
ভারতীয় দলের রাশিয়া সফরে মহম্মদ হাবিবের একটা অতুলনীয় দাপটের কথা হচ্ছিল। ’৭১-এর সেই ট্যুরে আমি কোচ। ম্যাচটা ছিল মস্কো ডায়নামোর সঙ্গে।
তখন দ্বিতীয়ার্ধের খেলা চলছে। আমরা দু’গোলে ডাউন। ম্যাচ মোটামুটি কব্জা করে নিয়েছে মস্কো ডায়নামো। সে জন্যই হয়তো আরও বেশি করে নিজেদের মধ্যে বল দেওয়া-নেওয়া করে খেলছিল রাশিয়ানরা। আর সেটা করতে করতেই ওদের মাথায় ওই দুষ্টু বুদ্ধিটা খেলে গেল!
হাবিবের বরাবরের অভ্যেস, ম্যাচে হারুক বা জিতুক, প্রতিটা বলের পিছনে তাড়া করবেই। সে দিনও করছিল। আর সেটা করতে করতেই একটা সময় নিজেকে আবিষ্কার করল মস্কোর আট জন ফুটবলারের মধ্যে কার্যত ও একা। সেটাও ভারতের ডিফেন্সিভ থার্ডে। আমার পঞ্চপাণ্ডবের অর্জুন তখন ঠিক যেন মহাভারতের অভিমন্যু! চক্রব্যুহে বন্দি।! কী করবে?
হাবিব করল কী, বিপক্ষের আট জনের মধ্যে যার পায়েই বল, এক বার করে তার কাছে দৌড়ে বলটা কাড়তে যাচ্ছে, আর সেই ফুটবলার বাকি সাত সতীর্থের কাউকে পাস করে দিচ্ছে। হাবিব পরক্ষণে আবার সেই ফুটবলারের দিকে তাড়া করছে।
এই ভাবে চলল..দশ সেকেন্ড... কুড়ি সেকেন্ড.... তিরিশ সেকেন্ড..... পঞ্চাশ সেকেন্ড......! হাবিবের মুখে ফেনা উঠে আসছে! কিন্তু কিছুতেই ছাড়ার পাত্র নয়। এমনই অবিশ্বাস্য রকমের টেনাসিটি।
পাগলের মতো চেঁচিয়ে সতীর্থদের ডাকছে ওর পাশে আসার জন্য...‘শালা তুম লোগ কাঁহা মর পড়া? আরে ভাই, খুদা কসম! মেরা পাস আও!”
চেঁচাচ্ছে আর ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে বিপক্ষের আট ফুটবলারের প্রত্যেকের পায়ে ডাইভ মারছে বলটা কেড়ে নেওয়ার জন্য।
এই করতে করতে বিশ্বাস করুন, এগারো বারের চেষ্টায় হাবিব সত্যিই মস্কোর ফুটবলারদের থেকে বলটা কেড়ে নিল! সে এক অসাধারণ দৃশ্য! দশ বারের পর এগারো নম্বর পাসটা যে-ই এক জন রাশিয়ান ফুটবলার তার সতীর্থকে দিতে গিয়ে সামান্যতম দেরি করে ফেলেছে, হাবিব চিতা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে ছোঁ মেরে সেই বল কেড়ে নিয়ে ক্লিয়ার করেই মাটিতে চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আর গোটা স্টেডিয়াম হাততালিতে ফেটে পড়ছে।
গোটা ব্যাপারটা এখনও আমার কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে লাগে! আর ওই মুভমেন্টটার সময়ের হাবিবকে ভাবলে মনে হয় আধিদৈবিক কোনও কিছু! সবাই ম্যাচের পর বলাবলি করেছিল, ভারত দু’গোলে হারলেও হাবিবের ওই একটা মরণপণ লড়াইয়ের জন্য দিনের শেষে বিজিত ভারতীয় দলকেই মনে রাখতে হবে। বিজয়ী মস্কো ডায়নামোকে নয়।
এর পর আসবে আমার সবচেয়ে বিচ্ছু ছাত্র গৌতম সরকার।
হাবিবের থেকেই মারাত্মক টেনাসিটিটা শিখেছিল গৌতম। গরিব পরিবারের ডাহা বাঙাল ছেলে। চাটগাঁয়ের বাঙালের টিপিক্যাল জোশটা ছিল গৌতমের খেলার ভেতর!
খিদিরপুরে খেলার সময় গৌতম বরাহনগরে যেখানে সন্ধের দিকে আড্ডা দিত, সেখানে ওর কিছু সাঙ্গপাঙ্গ নকশাল ছিল। ভুতোদা’র (খিদিরপুরের সর্বেসর্বা কর্তা ভূতনাথ বিশ্বাস) কাছে শুনেছিলাম, গৌতমও নাকি একটা সময় নকশাল বনে গিয়েছিল। ফুটবলের টানে তার পরেও মাঠে ফিরে আসতে পেরেছে।
গৌতমের ট্যাকল ছিল একটা দেখার জিনিস! ওরও শরীরের ভরকেন্দ্র নীচের দিকে। ফলে মাঠে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম ছিল। গৌতম সরকার মাটিতে পড়ে আছে আর পাশ দিয়ে বিপক্ষের কেউ বল নিয়ে চলে যাচ্ছে—এমন দৃশ্য কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে করতে পারবেন না। গ্যারান্টি। কারণ ব্যাপারটা যতটা অকল্পনীয়, ততটাই অবিশ্বাস্য ছিল!
দু’পায়েই সমান কড়া আর নিঁখুত ট্যাকল করতে পারত গৌতম। আর কী ভয়ঙ্কর সেই ট্যাকল। জামশেদপুরে ছোটবেলায় আমাকে খুব ডেঁয়ো পিঁপড়ে কামড়াত। আর আমি হাতের ঝটকায় সেগুলোকে গা-হাত-পা থেকে ছাড়াতাম। মাঝে-মধ্যে দেখতাম, আমার হাতের ঝটকায় পিঁপড়েটার ধড়টা মাথা থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে, সেটা মরেও গিয়েছে, কিন্তু মাথার শুঁড়টা তখনও আমার যেখানটা কামড়েছে, কামড়েই রয়েছে। এতটাই মোক্ষম সেই কাপড়। আমৃত্যু কামড় যাকে বলে!
গৌতমের ট্যাকলও ছিল অনেকটা সে রকমই। বিপক্ষের যাকে ট্যাকল করবে, গৌতম বল নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও সেই প্লেয়ারের শরীরে ট্যাকলের দাগ থেকে যেত। বাঘ যেমন এক কামড়ে শিকারকে খাবলে নিজের মুখে তুলে নেয়, গৌতম ঠিক যেন সে ভাবেই খাবলে ট্যাকল করত। আর অদ্ভুত ভাবে সেটা একই জায়গায় দাড়িয়ে-দাঁড়িয়ে করত। অসাধারণ শরীরের ব্যালান্স।
যার দাপটে এক বার ডান পায়ের ওপর শরীরের ব্যালান্স রেখে বাঁ-পায়ে ট্যাকল করেই পরের মুহূর্তেই আবার বাঁপায়ের ওপর শরীরের ব্যালান্স রেখে ডান পায়ে ট্যাকল। আর সেই মুহুর্মুহু জোড়া ট্যাকলে দশ বারের মধ্যে সাড়ে ন’বার বিপক্ষের ধরাশায়ী হওয়া ছিল অনিবার্য। পিয়ং ইয়ং ম্যাচে একাই তিরিশটা ট্যাকল করেছিল কোরিয়ানদের। সাধারণত একটা ম্যাচে অত বেশি বার বল কোনও দলের ডিফেন্সিভ এরিয়ায় আসেই না। সেখানে গৌতম একাই তিরিশ বার ট্যাকল করেছিল!
সে রকমই দুর্দান্ত অ্যাটাকিং কোয়ালিটি ছিল গৌতমের। ছোট পাস-বড় পাস দুটোতেই সমান দক্ষ। আর ছিল অসম্ভব পাওয়ারফুল শু্যটিং। এক বার মোহনবাগান জার্সিতে ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে মাঝমাঠে বল কেড়ে নিয়ে আচমকা অসাধারণ ভাবে স্পিড তুলে একেবারে সেন্টার ফরোয়ার্ডের মতো বক্সের মাথা থেকে দুরন্ত শটে গোল করে জিতিয়েছিল।
হাবিব না গৌতম, কে বেশি লড়াকু আজও আমি ঠিক হিসেব কষতে পারিনি। তবে গৌতম যেন ছিল আমৃত্যু লড়াকু। আবার সেটা ওর হাবিবের থেকেই শেখা। তা হলে কে বেশি লড়াকু? আপনারাই সিদ্ধান্ত নিন!
পঞ্চপাণ্ডবের শেষ জন অনেক ভেবেচিন্তে শ্যাম থাপাকে বাছলাম।
শ্যামকে আমি যখন পঁচাত্তরে মুম্বই থেকে ইস্টবেঙ্গলে আমার টিমে আনলাম, তখন ও মফতলালে লেফটব্যাকে খেলছে। আমাকে বলেছিল, “প্রদীপদা, আমি ডিফেন্স থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ড খেলতে পারব কি?” আমি ওকে লেফট ব্যাক, লেফট হাফ, লেফট উইং খেলিয়ে-খেলিয়ে শেষমেশ সেন্টার ফরোয়ার্ড করেছিলাম। আমার সাতাত্তরের মোহনবাগানে আসার পর কয়েক বছর কী সব গোলই না করেছিল শ্যাম! এক-একটা স্বপ্নের গোল।
পাহাড়ি ছেলেদের টিপিক্যাল নমনীয় শরীর ওর। হাড়গুলো তুলতুলে, কিন্তু পেশি শক্তিশালী। ফলে কী মাটিতে আর কী হাওয়ায় শরীরটাকে ইচ্ছে মতো বেঁকিয়েচুরিয়ে বলে পা লাগাত। শট মারত। ব্যাকভলি নিত।
পঁচাত্তরের লিগে মোহনবাগানের সুব্রত, বিজয় দিগপতি-সহ পাঁচ জনকে কাটিয়ে শেষমেশ গোলকিপারকেও কাটিয়ে গোল করেছিল শ্যাম। আবার মোহনবাগানের জার্সিতে ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে সেই অসাধারণ ব্যাকভলি গোল! সেটাও শ্যাম। ওকে আমি মজা করে বলতাম, কী স্থলে আর কী অন্তরীক্ষে— আমার টিমে শ্যাম নারায়ণ আছে!
আবার হাবিবের মতোই সেন্টার ফরোয়ার্ড হলেও শ্যামের অসাধারণ ডিফেন্সিভ কোয়ালিটি ছিল। বড়-বড় ম্যাচে শ্যাম যে কত বার গোল করার পাশপাশি নিজেদের ডিফেন্সে নেমে এসে বিপক্ষের আক্রমণ সামলেছে! বিপজ্জনক সব বল ক্লিয়ার করেছে! সেরা উদাহরণ আটাত্তরে মোহনবাগান বনাম আরারাত শিল্ড ফাইনাল। ২-২ ম্যাচটায় দুটো গোল হাবিব আর শ্যামেরই। আবার দু’জনই ওই অসাধারণ উঁচু মানের লড়াইয়ে অনেক বার একজন পাক্কা ডিফেন্ডারের মতোই বল ক্লিয়ার করেছে।
শ্যাম আমার কোচিংয়ে দেখা সবচেয়ে সুযোগসন্ধানী সেন্টার ফরোয়ার্ড। এক বার লিগের একটা ম্যাচে বিপক্ষ গোলকিপার বল ধরে ড্রপ দিচ্ছে— তার ফাঁকেই শ্যাম ফলো করে গোলকিপারের ড্রপ খাওয়া বল জালে ঠেলে দিয়েছিল! ভাবা যায়! (চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy