Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

ওঁর হাতের রান্নাতেও যেন জাদু ছিল

বলছেন বেগম আখতারের একনিষ্ঠ ছাত্রী প্রভাতী মুখোপাধ্যায়বেগম আখতার আমার কাছে ছিলেন আম্মিজি। শুধু আমার বলাটা ভুল, গানের জগতের প্রায় সবারই উনি তাই। আম্মিজির গান যখন প্রথম রেডিয়োতে শুনি, তখন আমার কী বা বয়স! শুনতাম আর কাঁদতাম। আর থেকে থেকেই বাড়ির সকলকে জিজ্ঞেস করতাম, “কখন উনি রেডিয়ো থেকে বেরোবেন?” একলব্যর মতো আমিও ওঁকে ‘গুরু’ মেনেছিলাম। একবার বালিগঞ্জ মিউজিক কনফারেন্সে আমি ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো’ গানটা গাই।

অনুলিখন: স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

বেগম আখতার আমার কাছে ছিলেন আম্মিজি। শুধু আমার বলাটা ভুল, গানের জগতের প্রায় সবারই উনি তাই। আম্মিজির গান যখন প্রথম রেডিয়োতে শুনি, তখন আমার কী বা বয়স! শুনতাম আর কাঁদতাম। আর থেকে থেকেই বাড়ির সকলকে জিজ্ঞেস করতাম, “কখন উনি রেডিয়ো থেকে বেরোবেন?” একলব্যর মতো আমিও ওঁকে ‘গুরু’ মেনেছিলাম।

একবার বালিগঞ্জ মিউজিক কনফারেন্সে আমি ‘দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো’ গানটা গাই। ওই অনুষ্ঠানে আম্মিজিরও গাওয়ার কথা। আমি সে কথা জানতাম না, উল্টে যে গানটা গেয়েছিলাম সেটাও যে বেগম আখতারের, তা’ও না! গাইলাম। উনি শুনলেন! শেষে আমার গলায় একটা মেডেল পরিয়ে বললেন, “শোন আজকে তোর সঙ্গে আমার মালা বদল হল।” আমি সেদিন গ্রিনরুমে ওঁর পায়ের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কেঁদেছিলাম। তখনই কোনওক্রমে বলি, ওঁর কাছে গান শিখতে চাই। উনি আমার মাথায় হাত রাখলেন। সেই যে ওঁর হাতের ছোঁওয়া পেলাম...আজও সেই ছোঁওয়া পাই সুরের মধ্যে, এমনকী জীবনের মধ্যেও।

কী অপরূপ যে সুন্দরী ছিলেন আম্মিজি! ভাবা যায় না। নাকে হিরে, কানে হিরে, হিরে রঙের সাদা গাউনে প্রথম দেখি ওঁকে— আহা! কী রূপের ছটা! সে বার লখনউতে আমার বাবা ব্রিজ খেলতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে যান আমাকেও। সে-ই আমার প্রথম ‘সরস্বতী’ দর্শন।

একবার মনে আছে, বিয়ের পর আমার স্বামীকে নিয়ে প্রথম আম্মিজির কাছে গিয়েছি। কিছুক্ষণ পর আম্মিজি আমায় ভেতরের ঘরে ডেকে নিলেন। আমার স্বামী বাইরের ঘরে বসে রইলেন। আম্মিজি গান ধরলেন, “অ্যায় মহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া।” শুনতে শুনতে আমি পুরো বাহ্যজ্ঞান শূন্য হয়ে গেলাম। মোহিত হয়ে শুধু ওঁর গান শুনে চলেছি।

এ দিকে আমার স্বামী তো বসে থাকতে থাকতে ধৈর্য হারাচ্ছেন।

এক সময় গান শেষ হল। বেরিয়ে এসে দেখি, আমার স্বামী খুব রেগে গিয়েছেন। দেখা মাত্র বললেন, “একটা গান তুলতে অ্যাত্তো সময় লাগে! কী করো?” আম্মিজির সামনেই উনি দুম করে কথাটা বলে দিলেন। মুচকি হেসে আম্মিজি তখন বললেন, “আমি গান গেয়ে ওকে আটকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছিলাম। বুঝলে?” এরপর তাঁর নবাবি খাতিরদারিতে সে দিন আমার স্বামীকে শান্ত করলেন উনি। নিজে হাতে মেটে চচ্চড়ি আর পরোটা রেঁধে খাওয়ালেন। আম্মিজির রান্নাতেও যেন জাদু ছিল! সেই স্বাদ আজও ভুলতে পারি না।

ওঁর কাছে গান শেখাটা অদ্ভুত রকমের ছিল। আমি তো উর্দু ভাল জানতাম না। এদিকে তখন গানের খাতা, গান লিখে শেখার কোনও চলই ছিল না। আম্মিজি গেয়ে যেতেন। আমাদের শুনে শুনে তুলে নিতে হত। আর যতক্ষণ না আম্মিজি বলতেন, ‘আ বেটি আওয়াজ লাগা,’ ততক্ষণ কারও গলা দিয়ে সুর বেরোতো না!

এমনিতে দারুণ মজার মানুষ ছিলেন আম্মজি। খুব জোকস্ বলতেন। শেষে একটা কথা বলি, আম্মিজি কেবল গান শিখিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। জীবনকে দেখতে শিখিয়েছেন স্বভাবে, অনুভূতিতে, ভাবের প্রকাশে। কাছে বসলে আমি আম্মিজির শরীর জুড়ে ‘গান’ দেখতে পেতাম। চোখ বুজলে আজও আম্মিজিকে স্পষ্ট দেখতে পাই।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE