রঙ্গপটের নতুন নাটক ধর্মাশোক অনেকটা হৃতিক-ঐশ্বর্যার ‘জোধা-আকবর’ ছবির মতো। আড়ম্বর আছে, ইতিহাস নেই। অভিনয়ের চমৎকারিত্ব আছে, গল্পের বিশ্বস্ততা নেই।
আগ্রা, ফতেপুর সিক্রির মুঘল প্রাসাদের গাইডরাই শুধু জানেন, কোথায় ছিল জোধাবাইয়ের মহল, কী ভাবে আকবরের সঙ্গে সেই রাজকন্যার প্রেম হল ইত্যাদি। সেই কাহিনিতে উপকথার রোমাঞ্চ আছে, ইতিহাস ছিটেফোঁটাও নেই। সম্রাট অশোক, তাঁর ছোট বৌ তিষ্যা বা তিষ্যরক্ষিতা এবং পুত্র কুণালের গল্পটাও সে রকম। টিপিক্যাল বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যার কাহিনি। বৃদ্ধ অশোক তাঁর ছোট বৌ, যুবতী তিষ্যার শারীরিক কামনা মেটাতে পারেননি। তখন তিষ্যা সৎ ছেলে কুণালের প্রেমে পড়েন। কিন্তু কুণাল প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর প্রতিশোধলিপ্সু তিষ্যার চক্রান্তে জল্লাদ এসে কুণালের চোখ উপড়ে নেয়। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে রূপবান সৎ ছেলের অঙ্কশায়িনী হতে চাওয়া যুবতী মায়েদের পক্ষে ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। আথেনীয় সভ্যতাতেও ফিদ্রা নামে এক রানি একই ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, সৎ ছেলে হিপ্পোলিটাস তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। এ নিয়ে গ্রিক ইউরিপিদিস থেকে ফরাসি রাসিন অনেকেই নানা নাটক লিখেছেন।
কিন্তু অমিত মৈত্রের লেখা আর তপনজ্যোতির প্রয়োগে ঋদ্ধ নাটক তো পুরনো দুনিয়ায় আবদ্ধ নয়। সেখানে ‘পরিবর্তন’ শব্দটা বারংবার এসেছে। রাজা ধর্ম পরিবর্তন করে বৌদ্ধ হয়েছেন, প্রজারাও সকলে রাজধর্ম অনুসরণ করছে। ধান্ধাবাজরা বৌদ্ধ হয়ে হিন্দুদের জমি কেড়ে নিচ্ছে, বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ না করলে থাবড়া-টাবড়াও মারা হচ্ছে। হলে প্রবল হাতাতলি ঠিকই, কিন্তু বারংবার জোর করে এই সমকালীনতা ঢোকানোর চেষ্টা বিরক্তির উদ্রেক করে। যে রাজা বৌদ্ধ-হিন্দু-জৈন বিভেদ না করে ‘সবে মুনিসে পজা মমা (সব মানুষই আমার প্রজা)’ বলে শিলালিপি লিখলেন, মানুষ এবং ক্লান্ত পশুদের জন্যও রাস্তার ধারে জলাশয়, বাগিচা, হাসপাতাল নির্মাণের আদেশ দিলেন, তাঁকে নিয়ে এই ছেলেখেলা না করলেই ভাল হত। নাটকের মাঝে যৌগন্ধরায়ণের সংলাপে ‘হীনযান’ শব্দটিও কানে বিসদৃশ ঠেকে। প্রথমত, অশোকের আমলে বৌদ্ধদের হীনযান-মহাযান ভাগটাই হয়নি, ওটি বহু পরে গুপ্তযুগে তৈরি। দ্বিতীয়ত, হীনযান শব্দটাই ছিল না। সৌত্রান্তিক, সর্বাস্তিবাদী ইত্যাদি বলা হত। কুণালবেশী দেবশঙ্কর হালদার শেষ দৃশ্যে অন্ধ হয়ে ন্যাড়া মাথায় মনিচক্র ঘোরাতে ঘোরাতে কেনই বা মঞ্চের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলেন বোঝা গেল না। ওই যন্ত্রটি তিব্বতি বৌদ্ধদের ধর্মীয় উপকরণ, অশোকের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।
অনেকেই বলতে পারেন, ইতিহাসের সত্য এবং নাটকের সত্য আলাদা। অবশ্যই! নাটকের সত্য কী ভাবে আলো ছড়ায়, তার প্রমাণ ছিল রঙ্গপটের বিগত প্রযোজনা ‘তথাগত’ নাটকেই। মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের সেটিই ছিল শেষ রচনা। সেখানে জোর করে সুগতকে সমকালে ফেলা হয়নি। কিন্তু রাহুলমাতাবেশী সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়ের মোক্ষম একটি জিজ্ঞাসা ছিল। যার মর্মার্থ: উনি যদি এত সম্মান, এত শিষ্য পরিবৃত হয়েই থাকবেন, তা হলে কপিলাবস্তু ত্যাগের কী দরকার ছিল? ‘ধর্মাশোক’-এর নাট্যকার খেয়াল করেননি, সমকালীন রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, এই ছোট্ট প্রশ্নটিই আধুনিকতা!
এ নাটকে তাই শোক, অশোক কিছুই নেই। আছে সৌমিক-পিয়ালির মঞ্চ এবং জয় সেনের চমৎকার আলো। কলিঙ্গ যুদ্ধের শেষে অশোক যখন দয়া নদীর ধার দিয়ে হাঁটেন, স্বজনহারাদের আর্তি নিয়ে স্রোতে ভেসে যায় অজস্র প্রদীপ, সেই জায়গাটি চমৎকার। উৎসবমুখর রাতে মকরিকার (অরুণা মুখোপাধ্যায়) নাচ, সেখানে ভিড়ের মাঝে মুখ ঢেকে কুণালবেশী দেবশঙ্করের আগমনের কম্পোজিশনও দাগ কাটার মতো। জমকালো পোশাকে লম্বা চুলের কুণাল, পাগড়ি-পরা দাড়িওয়ালা অশোক, সবুজ মেখলায় তিষ্যা...মহম্মদ আলির রূপসজ্জা এবং কেশবিন্যাস আলাদা ভাবে উল্লেখ না করলেই নয়। অশোকের চরিত্রে তপনজ্যোতি রাহুল দ্রাবিড়ের মতো খেলার জন্য প্রশংসনীয়। প্রত্যাখ্যাত অভিমানিনী হিসেবে সেঁজুতি এবং প্রেমিকাকে মাতৃ আবাহনে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো চরিত্রে দেবশঙ্কর হালদার ছক্কা হাঁকাবেন, প্রত্যাশিতই ছিল। এঁদের পাশে ঠুকঠুক করে খেলাটা ধরার যে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেব্ল’ দরকার ছিল, তপনজ্যোতি সেটি পূরণ করেছেন। যৌগন্ধরায়ণ সঞ্জীব সরকার কখনও কখনও অতি-অভিনয় করেছেন, কিন্তু খলনায়কের চরিত্রে সেটিই প্রত্যাশিত ছিল।
কিন্তু নাটকটা? মহাবস্তু অবদানের রাতে ভিক্ষু উপগুপ্ত কুণালকে বললেন, তার প্রিয় জিনিস দান করতে, কুণাল নিজের চোখ উপড়ে বাক্সে ভরে দিলেন। নাটকে কুণাল এক বারও জানায়নি, নাক বা কান নয়, নিজের চোখ দুটোই তার সবচেয়ে প্রিয়। আর চক্ষুহীন কুণালের মুখে মা ডাক শুনে তিষ্যার মতো সম্ভোগী নারী নিমেষে ভিক্ষুণী বনে গেল? বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রী এবং অন্ধ পুত্রকে দেখে চণ্ডাশোক মুহূর্তে হয়ে উঠলেন ধর্মাশোক?
মূল উপকথায় এই ফাঁকগুলি ছিল না। অশোক, কুণাল এবং তিষ্যার এই গল্পটা পাওয়া যায় পালি ‘অশোকাবদান’ গ্রন্থে। নাটকে দেখানো হয়েছে, তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন করে পাটলিপুত্রে ফেরার পর তিষ্যার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন কুণাল। উপকথা একেবারেই উল্টো। তিষ্যার গোপন প্রেম কুণাল প্রত্যাখ্যান করেন, তার পর অশোক তাঁকে তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমনে পাঠান। বিদ্রোহীরা কুণালের কাছে নতিস্বীকার করে। ইতিমধ্যে প্রত্যাখ্যাতা তিষ্যা অশোকের নামে একটি জাল চিঠি তক্ষশীলায় পাঠিয়ে কুণালের চোখ উপড়ে নিতে বলেন। তার পর অন্ধ কুণাল বৌকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বীণা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে পাটলিপুত্রে পৌঁছান। অশোক সব জানতে পেরে তিষ্যার চোখ উপড়ে তার জিভ কেটে নেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু কুণাল তিষ্যাকে ক্ষমা করার কথা বলেন: ‘বাবা, চোখ দেখার কাজ করে। আমি এই সংসারের অনিত্যতা এবং শূন্যতা স্পষ্ট দেখতে পাই। তাই চোখ না থাকলেও আমার কোনও ক্ষোভ বা যন্ত্রণা নেই। মায়ের ওপর প্রতিশোধের কথাই বা ভাবছেন কেন? মৈত্রী, করুণা এবং ক্ষমার কোনও বিকল্প নেই, বাবা।’
কুণাল এবং তিষ্যা তাই আধুনিক প্রেম এবং প্রায়শ্চিত্তের গল্প নয়। তিথি অনুযায়ী দানদক্ষিণার হিন্দুত্বও নয়। শূন্যতা এবং করুণার বৌদ্ধ উপাখ্যান। এত জাঁকজমক নিয়েও এ নাটক সেটা ধরতে পারেনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy