দেখি, থোড়া জিভ বার করিয়ে।
চোখ দিখাইয়ে থোড়া!
লম্বা লম্বা শ্বাস লিজিয়ে।
কিছুক্ষণ পরপর এই তিনটি ডাক্তারি বাক্য যার, তিনি বসে রয়েছেন সামনের সিটে, ট্যাক্সিচালকের পাশেই। এবং নির্দেশগুলো খোদ চালককে উদ্দেশ করেই দেওয়া।
রাত পৌনে একটা মতো বাজে, হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সুনীলদার বাড়িতে সান্ধ্য আড্ডাকে টেনে হিঁচড়ে চরম নৈশ করে ফেলার পর আমরা তিনমূর্তি বাড়ি ফেরার জন্যে বহুক্ষণ ধরে ট্যাক্সি খুঁজে শেষে অবতারের মতো এই ভদ্রলোককে পেয়েছি। আমি ফিরব সেলিমপুর, পাপড়ি বেহালা কবরডাঙ্গা এবং এই গল্পের নায়ক শ্রী চিরঞ্জীব বসু সিধে এয়ারপোর্ট এক নম্বর গেট।
এই রুটম্যাপে ধবধবে দিনের বেলাতেই ট্যাক্সি পাওয়া প্রায় অসম্ভব, রাতে চালকমশাই যে রাজি হবেন না, তাতে আশ্চর্য কী?
আশ্চর্য হল কবি চিরঞ্জীব বসু’র স্কিল, যা কোনও দিন খালি হাতে ফেরে না। কবি হিসেবে তিনি নিও-ক্লাসিক্যাল হতে পারেন, কিন্তু তাঁর দুষ্টুমিগুলো বরাবরই পানীয়-ক্লাসিক্যাল।
রুট শুনে প্রথমেই চালক সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘‘হাম কিসি এক জগাহ যায়েগা।’’
নির্বিরোধী চিরঞ্জীবদা তাতেই রাজি হয়ে সেলিমপুর যাবার কথা বললেন। আর তার দু’মিনিটের মধ্যেই এই কনফিডেন্ট ডাক্তারি নির্দেশ। অবাক কাণ্ড এই যে, চালকও কথামতো ট্যাক্সি চালাতে চালাতেই চোখ, জিভ, হাত, সব দেখিয়ে গেলেন।
সব শেষ হলে চিরঞ্জীবদা বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘‘আপকো তো পরিষ্কার ক্যান্সার হ্যায়।’’ পরিস্থিতি এবং হিন্দি, দুটোই সাংঘাতিক।
পেছনের সিটে আমি আর পাপড়ি পেটে কিল মেরে চূড়ান্ত গাম্ভীর্য বজায় রেখেছি। এই কথা শোনার পর স্বাভাবিক ভাবেই ট্যাক্সির গতি এবং চালকের মনোভাব পুরো পাল্টে গেল। পৃথিবীর বুকে তাঁর সাধের ট্যাক্সি আর কত দিন চলবে, এই রকম একটা ভাব চলে এল মুখে।
‘‘ক্যা বোল রহে হ্যাঁয় সাহাব? আপকো ক্যায়সে পতা?’’ তাঁর করুণ জিজ্ঞাসা।
এইখানে আমি একটা ছোট্ট ভূমিকায় এন্ট্রি নিয়ে চিরঞ্জীবদার প্রাণঘাতী হিন্দির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বললাম, ‘‘সাহাব তো বিশাল বড়া ডক্টর হ্যায়। উনকো সব পতা।’’ ব্যস, কাজ হাসিল। চিরঞ্জীবদা তাঁর পাশে বসে ক্যান্সার বিষয়ক অসামান্য ভুলভাল তথ্য দিয়ে গেলেন এবং ভদ্রলোক আমাদের তিনজনকেই বাড়ির দরজায় নামিয়ে দিয়ে কলকাতা পরিক্রমা সেরে মোটামুটি ভোরের দিকে গ্যারাজ করলেন।
সেই রাতের মতো তাঁর ঘুম গায়েব করা ছাড়া এই মস্করায় আর কোনও ক্ষতি হয়নি। কারণ ডক্টর বাসু’র নির্দেশ অনুযায়ী তিনি নিশ্চয়ই স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাবেন এবং যারপরনাই নিশ্চিন্ত হবেন। সে-রাতে চালকমশাই ভাড়া নিতে অস্বীকার করলেও শ্রীবসু সামান্য বেশিই তাঁর কম্পিত মুঠোয় গুঁজে দিয়েছিলেন, সম্ভবত নির্মল এক অপরাধবোধ থেকেই।
এই হলেন চিরঞ্জীব বসু (পরে যিনি স্বাভাবিক ভাবেই মঞ্চসফল অভিনেতা হন, যা আমাদের সেই রাতেই প্রেডিক্ট করা উচিত ছিল), এবং এই হল রাজকীয় দুষ্টুমির আদর্শ উদাহরণ। সুনীলদার বাড়ির নিয়মিত আড্ডায় আমরা যারা থাকতাম, তারা প্রত্যেকেই অল্পবিস্তর এ-বিদ্যায় পারদর্শী। চিরঞ্জীবদার মতো স্টেট লেভেল চ্যাম্পিয়ন না হলেও, দুষ্টুমির একটা নিষ্পাপ চক্রান্ত তৈরি হচ্ছে দেখলে সব সময় সমর্থন করেছি।
আসলে আমাদের ছোটবেলা থেকে যৌবনের অলিগলি ভরা ছিল এমনই সব দুষ্টু কর্মযজ্ঞে। দুষ্টুমি ছাড়া পেটের ভাত হজম হত, এমন ছেলেমেয়ে তখন খুঁজলেও পাওয়া যেত না।
ক্রিকেট খেলতে গিয়ে টিপ করে শানুদের বাড়ির কাচ ভাঙা (কারণ শানু জন্মদিনে নতুন উইকেট পেয়েও খেলতে ডাকে না, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী কর্মকাণ্ড যাকে বলে!) থেকে শুরু করে বুবলি’র জেঠু’র মেলে-রাখা সাদা পাজামাকে কালিমালিপ্ত করা (কারণ একদিন তাঁর বাগানে চোর-পুলিশ খেলতে ঢোকায় দেদার ঝেড়েছিলেন), এই ছিল আমাদের সারাক্ষণের কাজ।
নিরামিষ খেলাধুলোর পাশাপাশি এট্টু আধটু এইসব না হলে পড়ায় কারও মন বসত না। এর ওর বাড়িতে ঘুরে ফিরে কমপ্লেন আসত, জবর ধোলাই হত, কিন্তু শিক্ষা হত না। পরদিন আবার মৌচাকে ঢিল।
পিন্টুদার পিসিমার ছিল আচারের অসামান্য হাত। বড় বড় লেবুর টক আচার থেকে ভাজা মশলা দিয়ে কাঁচা আমের আচারে গোটা তল্লাটে পিসিমার জুড়ি ছিল না। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা এবং ঘুম লেগেই থাকত, সেই মওকায় গরম দুপুরবেলা ছাদে উঠে বয়ামে হাত চুবিয়ে হরির লুট একেবারে!
কিংবা ধরা যাক হরি ঘোষের আমবাগান। লম্বা পাঁচিল, একটি গেট, তাতে ইয়া তালা। কিন্তু দস্যি ছেলেমেয়েরা ওসবে ঘাবড়াবে কেন? ঠিক এর ঘাড়ে ও উঠে একটা ব্যবস্থা হয়েই যেত, তারপর কোঁচড় ভরে কাচা-মিঠের সুস্বাদু নকশা। এক আধ দিন যে হরি ঘোষের মালি বা স্বয়ং হরি ঘোষ তাড়া করেননি তা নয়, কিন্তু যে কোনও বড় কাজে রিস্ক তো থাকেই, ওসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলে?
আরেক চিরকালীন নিরামিষ দুষ্টুমি ছিল দুপুর-বিকেল নাগাদ অল্প ঝিমিয়ে পড়া রিকশা অগোচরে তাঁর রিকশাটি নিয়ে চম্পট। শুধু নিয়েই নয়, রীতিমতো সিটে জনা তিন-চারেক কচি মুখের কলকাকলি এবং জনা দুয়েক সে-রিকশা চালাচ্ছে দিব্যি। তারপর যথারীতি রিকশাকাকু’র তাড়া খাওয়া এবং হ্যান্ড ওভার। সামান্যই ব্যাপার হয়তো, কিন্তু কী অপার্থিব আনন্দ যে লুকিয়ে ছিল এতে!
তবে কিনা, দুষ্টুমির স্বর্গীয় পীঠস্থান অবশ্যই স্কুল। ক্লাসের ফাঁকে (অনেক সময়ে ক্লাস চলাকালীনও) দুষ্টুবুদ্ধিতে শান দেওয়ার যে কী মোহ, তা স্কুল পড়ুয়া ছেলেরাই জানে। হ্যাঁ, এই কৃতিত্ব থেকে মেয়েদের সটান বাদ দিচ্ছি, এই শিল্পে তাদের কোনও অবদান কখনও দেখিনি। আমাদের ক্ষেত্রে বয়েস যেন বাড়তেই চাইত না। দুষ্টুমির ধরন হয়তো পাল্টাত, কিন্তু ক্লাস ইলেভেনেও মনটা সারাক্ষণ ছুকছুক করত, ছোটবেলার মতোই।
আমাদের সঙ্গে পড়ত সঞ্জিদা, ভারী শান্ত আর মিষ্টি মেয়ে। একদিন টিফিনে ওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে একবার চোখ কচলেছি, ব্যস। প্রায় হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিল, দু’চোখ দেখাতেই হবে, নইলে নাকি ওর দিন খারাপ যাবে।
সঞ্জিদার ছোট্ট হাতব্যাগে বেশ কয়েকটা কড়কড়ে দশ টাকার নোট দেখেছি, সঙ্গে প্রচুর খুচরো। পরিষ্কার বললাম, ‘‘দু’চোখ দেখাতে দু’টাকা করে নিই।’’ ও মা! ওমনি দিয়ে দিল! তারপর থেকে কতবার যে এই পদ্ধতিতে আচার-চানাচুর-আলুকাবলি ইত্যাদি পেটস্থ করেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
এই সেদিন অনেক বছর পর সঞ্জিদা’র সঙ্গে দেখা, এখন সিঙ্গাপুরে থাকে। সবচেয়ে ভাল লাগল এইটা দেখে যে, ও এই গোটা ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছে। নইলে নির্ঘাত এই মাঝবয়সে পিটুনি খেতে হত।
দজ্জাল শিক্ষকদের হাস্যকর ঝামেলায় ফেলার ঘটনা কোন স্কুলেই বা ঘটেনি? স্যারের চশমা গায়েব করে দেওয়া থেকে চেয়ারে চেউইং গাম সাঁটিয়ে রাখার সৃষ্টিশীলতা কমবেশি সব ছাত্রেরই থাকে। স্কুল পাস করে বেরনোর পর অবশ্য শিক্ষকরা বন্ধুর মতোই হয়ে ওঠেন, তখন সেসব দস্যিপনার কথা ভেবে কী লজ্জাই না লাগে!
তবে কলেজই বা কম যায় কীসে। ফার্স্ট ইয়ার, লম্বা সিলিং ঘর, সাদা রং। যে-দেওয়ালে ব্ল্যাকবোর্ড, সে-দেওয়ালের একেবারে টপ-এ, সিলিং ঘেঁষে কী যেন লেখা। পেন্সিলে। সে এক অদম্য কৌতূহল আমাদের সকলের।
নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠার অবস্থা। কী লেখা আছে ওখানে, না-পড়া পর্যন্ত শান্তি নেই। শেষমেশ মই জোগাড় হল একখানা, ক্লাসের সবচাইতে ডাকাবুকো ছেলেটি উঠল, পড়ল, কিচ্ছু না-বলে নেমে এল। তাকে ধরে সক্কলে ঝাঁকিয়েও উত্তর মিলল না। শেষে আরেকজন উঠল, এবং সম্মানের মাথা খুইয়ে পেন্সিলে লিখে রাখা বাক্যটি পড়ে শোনাল, - ‘‘ওরে পাগল, এখানে কী করছিস? নীচে নাম!’’ সেইদিন মেনে নিয়েছিলাম, এই হচ্ছে শিল্প।
এই রকম শিল্পসম্মত দুষ্টুমি আমাদের সকলের জীবন ভরিয়ে রেখেছিল অনেক দিন। শুধু আমাদের কেন, আমাদের আগের কী তারও আগের প্রজন্মেও রসবোধে চুবিয়ে রাখা এইসব দুষ্টুমি মানুষজন উপভোগ করতেন।
আগের প্রজন্ম বলতে মনে পড়ল, এ-গল্পটা মায়ের মুখে শোনা এবং মাকে বলেছিলেন এই গল্পেরই কুশীলবদের একজন স্বয়ং। যিনি বলেছিলেন, তিনি তবলাবাদক। তাঁর এক বন্ধুও আছেন গল্পে, তিনি সেতারি।
দু’জন একসঙ্গে যখনই ট্যাক্সি চড়েন, একটা ব্যাপার ঘটে। গন্তব্য আসার একটু আগে থাকতেই সেতারি ভদ্রলোক গুনগুন করে চোখ বুজে গত ভাঁজতে থাকেন। এমন শৈল্পিক সময়ে তো আর ভাড়ার ভাগের কথা বলা যায় না, অগত্যা তবলিয়া ভদ্রলোকই ভাড়া মেটান।
এটা পরপর বেশ কয়েক দিন হয়েছে, এমন সময়ে তবলিয়া মানুষটি জবর ফন্দি আঁটলেন। পরদিন দু’জনে ট্যাক্সি করে যাচ্ছেন, গন্তব্য আসার বেশ আগে থেকেই তবলিয়া ভদ্রলোক ‘ধাতি ধাগি না ধাতি ধাগি না ক্রেধাতেটে’ বোল মুখে তুলে হাতে তাল দিয়ে-টিয়ে একাকার কাণ্ড ঘটালেন। সেতারি বন্ধু হতবাক।
তাঁর নিয়মমাফিক গত ধরার আগেই বন্ধু উঠান-টুকরা-পরণ নিয়ে মৌতাতে মগ্ন। এ-অবস্থায় তো আর ভাড়ার কথাটা বলা চলে না। অতএব নিজের ছকে নিজেই জব্দ হয়ে সেতারি বন্ধু মনের দুঃখে ভাড়া মেটালেন। তবে হ্যাঁ, আর কখনও ট্যাক্সিতে তাকে গুনগুন করে গত ভাঁজতে শোনা যায়নি। তবলিয়া বন্ধুও বোল তুলে বিব্রত করেননি আর।
গল্প আছে অনেক, আজকের মতো শেষ করব সেই চিরঞ্জীব বসুর আশ্চর্য প্রতিভা দিয়েই। সবাই মিলে সেবার কাজিরাঙ্গা, নেতৃত্বে খোদ সুনীলদা। সন্ধে নাগাদ জঙ্গলের মধ্যে রিসোর্টে পৌঁছে দেখা গেল, খামোকা মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে একটু দূরের আরেকটি রিসোর্টে। তারা আমাদের বন্ধু, আলাদা থাকতেই বা যাবে কেন?
স্রেফ বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারা বলল, ফ্রেশ হয়ে নিয়ে এখানেই ফিরে আসছে, কিছু একটা ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যাবে, আমরা যেন দারোয়ান তথা চৌকিদারকে বলে রাখি এই নিয়ে ঝামেলা না-পাকাতে।
মেয়েরা সরল, কারণ দায়িত্বটি তারা দিয়ে গেল চিরঞ্জীবদাকেই। আমি তখন পাশেই ছিলাম, কারণ সব অপরাধেরই সাক্ষী থাকতে হয়।
বিশাল চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কটেজ, সকলেই যার যার রুমে আড্ডার আগে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে, কেবল চান-টান সেরে নিজের বারান্দায় এসে বসে রয়েছেন কবি প্রবালকুমার বসু, আমাদের প্রবালদা।
চিরঞ্জীবদা এগিয়ে গেলেন অহমিয়া সদ্যযুবা চৌকিদারের দিকে, সঙ্গে আমি। গিয়ে আবার সেই হিন্দিতে বললেন (দূরে বারান্দায় বসে থাকা প্রবালদাকে দেখিয়ে, যার মুখে তখন একটা প্রিন্স দ্বারকানাথ ও ঋষি অরবিন্দের মিলিত ভাব এসেছে), ‘‘ওই সাহেবকো দেখতা হ্যায়? উসকো লেড়কিকা বহুত দোষ হ্যায়।’’
আমি তখনও বুঝিনি ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে। তারপর চিরঞ্জীবদা বললেন, ‘‘একটু বাদ কয়েকঠো লেড়কি ইধার আয়েগা, ইয়ে সাহেব বুলায়া হ্যায় ফুর্তি করনে কে লিয়ে। তুম কিন্তু ঘুসনে মত দেনা, কেমন?’’
চৌকিদার জিভ কেটে একবার জঘন্য দৃষ্টিতে নিশ্চিন্ত প্রবালদার দিকে তাকিয়ে আমাদের কথা দিল, মরে গেলেও মেয়েদের সে ঢুকতে দেবে না। গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত, কিন্তু যে কোনও শিল্পে ফিনিশিং টাচ বলে একটা ব্যাপার থাকে।
ফিরে যেতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রসেনজিৎ ও ব্রুস উইলিস মিশিয়ে চিরঞ্জীবদা চৌকিদারকে বললেন, ‘‘কোই পুছে কে কিসনে বারণ কিয়া হ্যায়, তো বোলনা ম্যায়নে। মেরা নাম হ্যায় বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।’’
এর পর যা যা হতে পারে, তার সব কিছুই হয়েছিল এবং সবশেষে সুনীলদা সহ আমরা প্রত্যেকে প্রচুর হেসে ছিলাম গভীর রাত পর্যন্ত। সেসব অরণ্যের দিনরাত্রি ভোলার নয়।
এমন সব অসামান্য দুষ্টুমির দিনগুলো কি আমরা হারিয়ে ফেললাম? দুষ্টুমির জন্যে আলাদা করে যেটুকু সময় তোলা থাকত, সেটুকুও কি এখনকার ছেলেমেয়েদের নেই আজ? নাকি এটাই সত্যি যে আজকের বাবা মায়েরা নানা প্রতিযোগিতার দৌড়ে বাচ্চাদের দুষ্টুমির দুপুরগুলো কেড়ে নিয়েছেন? নাকি এমন দুষ্টুমির জন্যে যে মন-মেধা-রসবোধ দরকার হয়, তা আমরা হারিয়ে ফেলেছি? উত্তরটা সহজ নয়।
লোকজন সব শান্ত হয়ে গিয়েছে, এমনটাও নয়, তবে কিনা দুষ্টু আর দুষ্ট’র মধ্যে একটা বিরাট ফারাক আছে। সেইসব নির্মল দুষ্টুমির গায়ে এখন ছোপ ছোপ দাগ, কিছু ঘৃণার, কিছু প্রতিহিংসার, কিছু নিছক লোককে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পাবার।
ইন্টারনেট হয়ে এ জিনিস বেড়েছে কি না, তা তর্কের বিষয়। তবে ফেক প্রোফাইল তৈরি করে অচেনা লোকের দেওয়াল নোংরা করা এখন রোজকার ঘটনা। যেমন রোজকার ঘটনা অপ্রয়োজনীয় ভাবে কারও কারওকে নিয়ে লাগাতার অসম্মানজনক কথা পাবলিক ফোরামে বলে যাওয়া। জিনিসটা ইদানীং আরও বেড়েছে, কারণ সৌজন্য বলে গুণটি এখন নেহাত হাস্যকর। পাশাপাশি মেয়েদের আরেকরকম ভাবে উত্ত্যক্ত করার পথ খুলে দিয়েছে ইন্টারনেট, সে-ও আমাদের জানা। কোথাও কি মানুষ হিসেবে আগের চাইতে ছোট হয়ে যাচ্ছি আমরা? প্রশ্নটা ক্লিশে হলেও, জরুরি। দুষ্টুমি কি কেবলই ছোটবেলার সম্পদ? তাও তো নয়। এই যে এতগুলো ঘটনায় প্রাপ্তবয়স্কদের মুখের আড়াল থেকে একটা দস্যি বাচ্চা ফিক করে হেসে উঠল, সেই কি কম পাওয়া? সেই পাওয়াটুকু হারিয়ে ফেললে কিন্তু আমরা অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলব একসঙ্গে। আজকাল মনে হয়, রিকশাচালকের দুপুরের ঘুম উড়িয়ে দেওয়া বাচ্চাগুলো কি চিরকালের মতো বড় হয়ে গেল? কে জানে...
পুনশ্চ: মায়ের কাছে শোনা গল্পটির দুই চরিত্রের নাম বলতে ভুলে গিয়েছি। সেই তবলিয়া পণ্ডিত কানাই দত্ত এবং সেতারি বন্ধু স্বয়ং পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
অলংকরণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy