Advertisement
২৬ অক্টোবর ২০২৪

উৎসবের মেজাজ হেঁসেলেও

শুধু গান-পাঠ-কবিতা নয়। নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সবচেয়ে লোভনীয় বাঙালি-খানাও। দেখে এলেন বিপ্লবকুমার ঘোষ।এক বা দুই নয়, হাজার হাজার বাঙালি। তাও শুধু কলকাতার নয়, দেশের সব প্রান্ত থেকে আসা। এখন আন্দামানও বাদ যায় না। বাঙালি যেখানে, খানাপিনাও সেখানে। সকাল থেকে দুপুর, সন্ধে থেকে রাত। জটলা, আড্ডা। কিন্তু ঘুরে-ফিরে প্রশ্ন একটাই, আজকের মেনুটা কী? প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন।

অলঙ্করণ: দেবাশিস দেব

অলঙ্করণ: দেবাশিস দেব

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

এক বা দুই নয়, হাজার হাজার বাঙালি। তাও শুধু কলকাতার নয়, দেশের সব প্রান্ত থেকে আসা। এখন আন্দামানও বাদ যায় না। বাঙালি যেখানে, খানাপিনাও সেখানে। সকাল থেকে দুপুর, সন্ধে থেকে রাত। জটলা, আড্ডা। কিন্তু ঘুরে-ফিরে প্রশ্ন একটাই, আজকের মেনুটা কী?

প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। আর তাতেই এই বিশাল বাঙালির পদার্পণ। নেতা, মন্ত্রী থেকে রাষ্ট্রপতি-কে না সেই আসরে সামিল হন। কলকাতা থেকে কন্যাকুমারী, লখনউ, কানপুর, এলাহাবাদ থেকে চাইবাসা-দেশের যে কোনও বড় শহরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত এই উৎসবে সবাই আমন্ত্রিত। লেখক সাহিত্যিক থেকে কণ্ঠশিল্পী, দুঁদে রাজনৈতিক নেতা থেকে হাল আমলের ফিল্মস্টার। যেই হোন, বাঙালি খানায় সবাই একসঙ্গে, একই সামিয়ানার তলে। ‘মিলেছি বাঙালি সবাই মিলে, হাত মেলাবো গরম ভাত আর ডালে’।

তিন দিনের অনুষ্ঠান জমজমাট। কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই খাওয়ার চিন্তা। নানা কৌতূহল জনে জনে। বাঙালি খেতে জানে। খাওয়াতে জানে। কিন্তু এত লোকের আয়োজন কী ভাবে সম্ভব? এমনকী যে রাজ্যে বাঙালি খানার চলনই নেই সেখানেও মুখরোচক বাঙালি খানা। এমনকী কেরলের শেষ প্রান্তেও মাছে বা ডালে সম্বর বা নারকেল তেলের গন্ধ নেই। ভাবা যায়? ‘‘সবই সম্ভব। হাঁড়ি-কুড়ি, ডেকচি, থালা-গ্লাস থেকে বাঁশের মতো লম্বা সব খুন্তি নিয়ে পঁয়ষট্টি জনের (রাঁধুনি সহ) বিশাল বাঙালি টিম দেশের যে কোনও প্রান্তে হাজির হয়ে যান। খানা-পিনাতেই বিশাল টাকার বাজেট।’’ বলছিলেন নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক জয়ন্ত ঘোষ।

সত্যিই অবাক হওয়ার মতো সব কিছুই। তাঁবু গেঁড়ে বসা হেঁসেলে দাউ-দাউ আগুন জ্বলছে বড় বড় কড়াই চাপিয়ে। মাছের মাথা দিয়ে মুগডাল। কাতলার কালিয়া থেকে চিতল-মুইঠ্যা। আবার হালকা চিকেন কষা থেকে কচি পাঁঠার ঝোল।

বাঙালি নিজের ঘরে স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে রেডমিট এড়িয়ে চলে। কিন্তু ভিন রাজ্যে গিয়ে তাই খেতে চায় বেশি করে। বেপরোয়া মনোভাব হামলে পড়ে কচিপাঁঠার লম্বা লাইনে। কর্তৃপক্ষ তাই দু’ বছর দেখছি নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন, ‘পাতে মাটন নেওয়া যাবে একবারই। তবে মাংসের ঝোল ও আলু নেওয়া যাবে যত খুশি।’ কিন্তু এই ছোট্ট নিয়মে অতিথিদের যাতে কোনও অভিমান কাজে না লাগে তাই ক্যাটারারদের প্রতি অলিখিত নির্দেশ, ‘বাঙালি খুশি ভূরি ভোজে। আর তাতে কলঙ্কের ছায়া না থাকে।’

কলঙ্কের কালি দূর অস্ত। যে বাঙালি খাওয়ার শেষে কিছু না কিছু মন্তব্য করতে পিছপা হয় না, বাংলার বাইরে পা রেখে তাঁরাই কত সংযত সাহসী হয়ে যান। চাটনিতে কেন শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দেয়নি, মাছের মাথার মুগডালে ঘি দেয়নি, পান্তুয়ার সাইজ এত ছোট কেন-এ রকম কোনও মন্তব্য যেন উধাও ওই কয়েক দিন। কর্তৃপক্ষের একজন এ রকমই বাঙালি মানসিকতার পরিবর্তন দেখে বেশ সরস মন্তব্য করলেন, ‘‘বছরে একবার এই সম্মেলনের আমন্ত্রণে আসা। তাও সপরিবারে। টেনশন ফ্রি তিন দিন। বাজারে ব্যাগ নিয়ে ছোটাছুটি নেই। বউয়ের মুখ-ঝামটা নেই। ঘড়ি ধরে গরম খাওয়া। আবার ঘুম থেকে উঠতেই ফুলকো লুচির প্লেট।’ কে না খুশি হবে। সাহিত্যের সঙ্গে মহা ভূরিভোজ। ‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না’।

রসিক কবির আরও মন্তব্য, ‘‘গিন্নির মুখে এই তিনদিনই হাসি দেখতে পাই। ঝগড়াও করেন না। সাহিত্যের ছোঁয়ায় সবারই স্বভাব বদল।’’ আহা, এমনটা যদি সবারই জীবনে ঘটত!

এ বছর রাঁচিতে বসেছিল এই মহা সম্মেলন। রাষ্ট্রপতি আসবেন তাই কয়েক দিন ধরেই শহর ছিল কড়া নিরাপত্তায় মোড়া। তিন দিন আগে থেকেই বিভিন্ন রাজ্য থেকে অতিথিরা শহরে এসে পৌঁছে যান। হোটেল, গেস্ট হাউসেও জায়গা কুলোয়নি। রাঁচি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের বিশাল চত্বর ছেড়ে দিয়েছেন ঝাড়খণ্ড রাজ্য সরকার। এত অতিথিদের জন্য সব সৌজন্যই দেখিয়েছেন তাঁরা। সেই রাজ্যে কেমন হল এই বাঙালির ‘মিনি কুম্ভমেলার’ খানাপিনা?

চিত্র ১। কনকনে ঠান্ডার রাতে বিকট শব্দে খুলে গেল রাঁচি শহর সংলগ্ন স্পোর্টস্ কমপ্লেক্সের বিশাল লোহার কপাট। কড়া নিরাপত্তায় মোড়া সদা সতর্ক রক্ষীরা একে একে চারটি মালবোঝাই লরিকে ভিতরে ঢোকার অনুমতি দিলেন। খাচায় বন্দি অর্ধভুক্ত মুরগির পাল বিকট চিৎকারে জানান দিচ্ছিল তাদের উপস্থিতি। এই মুহূর্তে এরাও অতিথি।

তবে এরা মঞ্চে উঠবে না। জবাই হয়ে কাল দুপুরে যে সব বাঙালির পাতে উঠবে। পেছনেই আরও তিন লরি এসে হাজির। হাওড়া থেকে এসে পড়েছে কয়েক টন মাছ। রুই কাতলা থেকে ভেটকি।

চিত্র ২। রাত দুটো। হেঁসেলের প্রথম শিফটের বিরাম। দ্বিতীয় শিফটের কাজ বুঝে নিচ্ছেন পঁয়ত্রিশ জনের দল। এমনই সময় এক কর্মকর্তা জানিয়ে গেলেন হিং ছাড়া বড়ি দিয়ে লাউঘণ্ট করতে হবে। মাথায় হাত রাতের ম্যানেজারবাবুর। সকালের মধ্যে দেড়শো লাউ যোগার করতে হবে। ম্যাটাডর চেপে কোথায় বেরিয়ে গেলেন লাউয়ের খোঁজে কে জানে।

জানি না, এমন অনুরোধ কার। তবে মনে পড়ে গেল অন্য একটি ঘটনা। তখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে ছিলেন। রাত দুপুরে আমায় ডেকে পাঠালেন। তাঁর রুমে ওই গভীর রাতেও লেখক-কবি-শিল্পীর ভিড়। তিনি কর্মকর্তা কাউকেই ফোনে পাচ্ছেন না। খোঁজ নিচ্ছিলেন, কালকের মেনুতে পটল পোস্তর অনুরোধ রাখা যাবে কিনা।

কর্মকর্তা জয়ন্ত ঘোষ আমার সঙ্গেই ছিলেন। অন্য রুমে, গভীর আড্ডায়। তাঁর অনুরোধ রাখতে হেঁসেলে ফোন। তড়িঘড়ি কাজ। তবে সেই পটল পোস্ত শুধু সুনীলদাই পেয়েছিলেন নাকি বাকিরাও, জানি না। তবে পশ্চিমবাংলার এক রাজনৈতিক নেতা চারাপোনার ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। নাগপুর থেকে প্রায় কুড়ি কিমি দূরের এক গ্রাম থেকে সেই চারাপোনা এনে সেই অনুরোধ রক্ষা করা হয়েছিল। শোনা যায়, উত্তরপ্রদেশে আয়োজিত এক সেমিনারে ওখানকার এক মন্ত্রীর বদান্যতায় বর্ধমান থেকে চল্লিশ টিন রসগোল্লা রীতিমতো পার্সেল ভ্যানে পাঠানো হয়েছিল। সে বার পাতে এমন রসগোল্লা পেয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন সব অতিথিরা। শেষ পাতে যত খুশি রসগোল্লা, ভাবা যায়?

এমনই সব চিত্র ওই ক’দিন ঘিরে। সকাল থেকেই অবশ্য এই শহরের উন্মাদনা ছিল অন্যরকম। উদ্বোধন করে গেছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

সঙ্গে ছিলেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল থেকে নেতা মন্ত্রীরা। সেই থেকেই শুরু হয়ে গেছে গান-বাজনা-সাহিত্যের আসর। কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই-য়ের প্রচুর পরিচিত মুখ। একই সঙ্গে নবীনের দল। যাঁরা কিছু করে দেখাতে চান। কেউ বা বছরের সেরা কবিতা লিখে এনে পাঠ করেছেন। কেউ বা সারা বছর চর্চা করে তিনটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনালেন। লিটল ম্যাগের ছড়াছড়ি। সঙ্গে লেখক-লেখিকারাও। কানপুরের বাপি চক্রবর্তী, বরেন সরকার, এলাহাবাদের প্রদ্যোৎ রায়, লখনউয়ের অমলেন্দু দত্ত থেকে অসম থেকে আসা নবারুণ রায়ের হাতে সদ্য প্রকাশিত লিটল ম্যাগ। যথেষ্ট পরিশ্রমের ফসল প্রায় প্রতিটি লেখা ও কবিতায়। বাংলার বাইরে বসেও প্রবাসীদের কী অক্লান্ত প্রচেষ্টা। বাংলাকে ধরে রাখতে, বাংলা ভাষাকে উজ্জীবিত করতে এ যেন এক সাহিত্যের মহাযজ্ঞ। প্রতিভার ছড়াছড়ি।

সুনীলদা নেই বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর ছায়া এখনও গর্বিত করে বাঙালিদের অন্তঃসত্তাকে। দেশের কত দূর থেকে আসা কোনও কবি যখন সবার মাঝে কোনও কবিতাকে উৎসর্গ করতে সুনীলদাকেই বেছে নেন, তখন সত্যিই চোখে জল আসে। ওই নাম না জানা কবি অকপটে বলতে পারেন, ওই মানুষটার উৎসাহেই আজ তিনি কবিতা লিখতে পেরেছেন। স্মৃতি-বিস্মৃতির জালে কত ঘটনা, কত রটনা। কত লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রত্যাশা, শিল্পী হব, কবি হব বা লেখক হব। হচ্ছেও। বাঙালিয়ানাও মজবুত হচ্ছে। ক্ষোভও বাড়ছে। তাই কেউ কেউ মঞ্চে দাঁড়িয়েই বলতে পারেন, ‘কলকাতার কাগজগুলোতে আমরা প্রাধান্য পাই না। আমাদেরও আরও সুযোগ দেওয়া হোক।’

ক্ষোভ না হোক, বড় অভিমানী কথা। শুনিয়ে দিলেন সদ্য লেখা তাঁর কবিতার দুটি লাইনও। ‘কাল সারাদিন কেঁদেছি বড় অভিমানে, ক্ষমা করো মোরে। আমাদের ভুলে গিয়েও পড়বে মনে....’।

কখন কার মনে পড়বে কে জানে। তবু প্রত্যাশায় বুক বাঁধা। কেউ কেউ রাঁচির কালী মন্দিরে গিয়ে ঘটা করে পুজোও দিয়ে এসেছেন। সঙ্গে কবিতা বা নতুন গল্পের বই। সেই বইতেও লম্বা সিন্দুর আর টাটকা জবার স্পর্শ।

ঘন্টি বেজে গেল। হেঁসেলের সামনে বাড়তে থাকবে লম্বা লাইন। আজ বাঙালি খানায় নতুন কোনও সারপ্রাইজ আছে নাকি? লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কিছুটা কৌতূহলও। দূর থেকে ভেসে আসছে কোনও প্রবাসীর গায়ক হয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা। যতটা সম্ভব প্রাণ খুলে গাইছেন, ‘মিলন হবে কত দিনে’। একটু পরেই দেখা যাবে সেই শিল্পী নিজের বায়োডাটা ছাপিয়ে বিলি করছেন সেই হেঁসেলে এসেই। এই হেঁসেলও যে অনেক বড় মিলন-তীর্থ।

বড় মজারও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE