পৌরাণিক: সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তর একক প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।
দেওয়ালে টাঙানো বিরাট আয়তাকার চিত্র ‘সন্তবৃন্দ’। ঘন আলট্রামেরিন, প্রুশিয়ান ও গ্রিনিশ ব্লু সমন্বিত জলরঙের প্রলেপ। ফ্রেমের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয়েছে পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী শ্বেতশুভ্র টেবিলে দু’হাত রাখা মধ্যমণি জিশু। দু’পাশে যুগের পরিত্রাতারা। পিছনে আশীর্বাদকের ভঙ্গিতে দাঁড়ানো ভারমিলিয়ান পোশাকে সাঁইবাবা। উপরে কেন্দ্রে রয়েছে শান্তির দূত এক পরি। সন্তদের সামনে রাখা ভক্তদের দেওয়া অমৃতপানের বাটি। ছবিটির কম্পোজ়িশনে চোখে ভাসে লিওনার্দোর বিখ্যাত পেন্টিং ‘দ্য লাস্ট সাপার’ ছবির দৃশ্য। যদিও এখানে কোনও আশঙ্কার আবহ নেই। শুদ্ধ বাতাবরণ তৈরির প্রচেষ্টায় ছবিটিকে প্রদর্শনীর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ বলা যেতে পারে।
সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী সিদ্ধার্থ সেনগুপ্তের একক প্রদর্শনী সম্প্রতি আয়োজিত হয়েছিল চারুবাসনার চিত্তপ্রসাদ আর্ট গ্যালারিতে। বিষয় নির্বাচন ও প্রয়োগের দিক থেকে ভারতীয় ভাবরীতির ধারক হিসেবে শিল্পী ইতিমধ্যেই স্বাক্ষর রেখেছেন শিল্পজগতে। ন্যূনতম রং ও মোলায়েম রেখার অভিব্যক্তি, চোখ ও মনের পরিমণ্ডলে আরাম এনে দেয়।
প্রদর্শনীতে শিল্পী সিদ্ধার্থর ‘রেখা রঙের যুগলবন্দি’ নামাঙ্কিত তেত্রিশটি ছবি ছিল আধ্যাত্মিক প্রশান্তির বার্তা নিয়ে। ব্যক্তিগত জীবনে মারণব্যাধির প্রতিকূলতাকে জয় করে, প্রাত্যহিক অভ্যাসে চিত্র রচনা করেন তিনি— রং, রেখার শিল্প উত্তাপে। মূলত পুরাণধর্মী বিষয় ও দেবদেবীর মহিমাকে একনিষ্ঠ সাধনায় প্রতিষ্ঠা করে, সম্মুখের পরিবেশকে আলোর প্রার্থনায় মগ্ন করেন।
শিল্পীর ছবি আঁকা শুরু শিশু অবস্থা থেকেই। ওড়িশায় থাকাকালীন উল্টো দিকের বাড়িতে এক চিত্রকর ছবি আঁকতেন। সেই শিল্প তাঁর চোখ তৈরি করতে সাহায্য করে। বাবার চাকরিসূত্রে সাঁতরাগাছি চলে আসতে হয় সিদ্ধার্থকে। স্কুলে গেলেও, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল কম। মায়ের শেখানো পুতুল করা, ঠাকুর গড়া, ছবি আঁকায় মন ছিল বেশি। পাশাপাশি ভাল ফুটবল খেলার সুবাদে (মোহনবাগান জুনিয়র) রেলের চাকরি পান, বিলাসপুরে। শুরু হয় জীবনের এক অদ্ভুত অধ্যায়। সেখানকার শ্রমজীবী মানুষ, রাতের জীবন, শিল্পীকে অস্থির করে তোলে। আবার ছবি আঁকার অদম্য ইচ্ছে জেগে ওঠে। ফিরে আসেন, প্রকৃত শিক্ষককে খুঁজে বেড়ান। শুভাপ্রসন্নর কলেজ অব ভিসুয়াল আর্টসে শেখার সুযোগ মেলে। ছবির মূলস্রোতে নিয়ে যান শিক্ষক শুভাপ্রসন্ন। জলরং তাঁকে পথের দিশা দেখায়। মোটা গাঢ় রংকে স্বচ্ছতায় নিয়ে আসেন।
মূলত ড্রয়িং, জলরং, ইঙ্ক, অয়েল, অ্যাক্রিলিকের বিভিন্ন প্রয়োগে সচিত্র গুণমানের প্রকাশে ছিল, কৃষ্ণকথা, গণেশ, সন্ত, হংস, কৃষ্ণ, রাধা, সিংহ, বুদ্ধদেব, শিব, নারায়ণ, সরস্বতী, ঘণ্টা, পেঁচা, আশীর্বাদ ইত্যাদির ছবি। প্রায় ক্লাসিক পর্যায়ের প্রাণভরে দেখার মতো ছবি। অয়েল, অ্যাক্রিলিক ছাড়া অনায়াসে কব্জির জোরে উঠে এসেছে স্নিগ্ধ রেখার অভিব্যক্তির এক-একটি মহৎ ড্রয়িং।
সরস্বতী-কৃষ্ণ নামের ছবি নিয়ে প্রশ্ন করলে শিল্পী বলেন, “পুরাণ থেকে জানতে পারি, কৃষ্ণের কণ্ঠ থেকে সরস্বতীর সৃষ্টি। এই দেবীকে প্রথম পুজো করেন কৃষ্ণ। সরস্বতী শ্রীকৃষ্ণকে কামনা করেন। এখানে আমি হাঁসকে শ্রীকৃষ্ণ-বংশীবাদক রূপে রূপান্তরিত করি। এবং হংসরূপী কৃষ্ণকে সরস্বতীর সঙ্গে মিলিয়ে নানা প্রক্রিয়া তৈরি করি।”
যে সব ছবি পুরোটাই রঙিন, তার টেক্সচারের টেকনিকে, জলরঙের সাথে ইঙ্ক মেশালে জায়গাটা ফেটে যায়। ওয়াশের মতো একবারেই করা। ভাবনা অনুযায়ী টেক্সচারের রকমফের ঘটে। এ সব টেকনিকে রং জমাতে হয়। যে দিকটা জমানো হল, সে দিকটা বন্ধ রাখতে হয় সময় বুঝে। বসে যাওয়ার পরে ড্রয়িং করা। কখনও আবার কিছুটা তুলে নেওয়া, আবার কিছুটা রাখা। কাজগুলি করতে শিল্পীর প্রায় তিন মাস লাগে।
রং খুব চড়া-ই হোক কিংবা হালকা, ছবিগুলির ঠান্ডা ভাব আর তুলির মসৃণতা দেখার মতো। কিছু জায়গা ছেড়ে ছেড়ে কাজ করার মধ্যে সাদা অংশের ভারসাম্যে সূক্ষ্ম রেখার আসল রহস্য বড্ড বেশি টানে। কৃষ্ণ নিয়ে কাজগুলিকে কৃষ্ণ না বলে বরং একজন সাধারণ প্রান্তিক মানুষ বলা যায়। অ্যাসিড-ফ্রি পেপারে প্রত্যেকটি ড্রয়িং অবলীলায় চলে আসে রিলেক্সের মতো। যেমন ইঙ্কের স্বল্প রেখায় উপবিষ্ট কৃষ্ণর বাঁশি বাজানোর ভঙ্গিতে সাধারণত্ব ও দেবত্ব এক হয়ে যায়। আর একটি ছবি পাত্র হাতে বসা হালকা কালো রেখার ‘বুদ্ধদেব’। কন্টুর সে ভাবে নেই, বদলে আছে কমলা, অর্থাৎ ত্যাগের রং, সামান্য আরোপিত। তেলরঙের কাজগুলিতে (রাধা, ঘণ্টা, কৃষ্ণ ইত্যাদি) রং পাতলা করে দেওয়া। তারপিনের সাথে জল মিশিয়ে টেক্সচারের মজা এনেছেন। এই পদ্ধতি বড় একটা দেখা যায় না।
শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতা আজও শিল্পীর পাথেয়। তা ছাড়া তিনি নিজের জীবন ও শিল্পকর্মের কৃতিত্বের সিংহভাগই নিজের জীবনসঙ্গিনীকে দেন। রোগে কাতর না হয়ে, সৃষ্টির প্রতি কতখানি সততা এবং নিষ্ঠা থাকলে, এ রকম শিল্পসৃষ্টি সম্ভব, ভাবতে অবাক লাগে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy