Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
আলোচনা

অনন্য শিল্পীর আড়ালে এক কথাপ্রিয় মানুষ

ছবিকেই জীবনসর্বস্ব করেছিলেন তিনি। অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও, গণেশ পাইন ছিলেন এক সহজ, আত্মভোলা, মিষ্টভাষী আলাপচারী। যেন পরমাত্মীয়। তাঁর এই পরিচয় সম্পর্কে লিখলেন হর্ষ দত্ত ছবিকেই জীবনসর্বস্ব করেছিলেন তিনি। অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও, গণেশ পাইন ছিলেন এক সহজ, আত্মভোলা, মিষ্টভাষী আলাপচারী। যেন পরমাত্মীয়। তাঁর এই পরিচয় সম্পর্কে লিখলেন হর্ষ দত্ত

শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০৮:০০
Share: Save:

আবাসের নাম ‘দক্ষিণী’। ঠিকানা যতীন বাগচী রোড। বিবেকানন্দ পার্কের দক্ষিণমুখী, দৈর্ঘে–প্রস্থে-নির্মাণে সুদৃশ্য এই ফ্ল্যাটবাড়িটার প্রতি তলে দু’টি করে সুবিশাল ফ্ল্যাট। গণেশদা থাকতেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে বা লিফট থেকে নেমে বাঁ দিকে। অর্থাৎ ‘দক্ষিণী’রও দক্ষিণে। লিভিং প্লেসের গায়ে লাগানো বারান্দা থেকে সাদার্ন অ্যাভিনিউ সংলগ্ন সবুজ কলকাতাকে বুক ভরে দেখেছি কত দিন! একদিন আমার পাশে দাঁড়িয়ে গণেশদা বলেছিলেন, ‘শুধু প্রশস্ত বলে নয়, দক্ষিণের সবুজ আঁচল যেন ছুঁয়ে আছে বাড়িটা। নির্মাণশিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গির তারিফ করতেই হবে।’ এদিকে ওঁর পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে শিল্পের স্পর্শ, শৈল্পিক আবহ, নন্দিত শিল্পসম্ভার। ফ্ল্যাটের সদর দরজার দু’পাশে ছিল পাথরে তৈরি অপূর্ব শিল্পরীতির দুই নৃত্যাঙ্গনা। আকারে বেশ বড়। সম্ভবত ওড়িশা থেকে নিয়ে আসা।

‘দক্ষিণী’ গণেশদার শেষ বাসস্থান, আমার সঙ্গে ওঁর অন্তরঙ্গ সংযোগের শেষ স্পর্শবিন্দু। দু’হাজার তেরো সালের মার্চে ওঁর অকস্মাৎ প্রয়াণের অন্তত সাঁইত্রিশ বছর আগে গণেশদার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কিংবা বলা ভাল, ওঁর সঙ্গলাভ করেছিলাম। নাট্যকর্মী প্রবীর বসুর (কুট্টিদা) সহায়তায় একটি ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হওয়ার সুযোগ হল। কলেজে পড়ি। ফিল্ম ক্লাবের সদস্য হওয়া তখনকার দিনে ভীষণ গৌরবের ব্যাপার ছিল। কোনও সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্বই সে সময় নেই। মোবাইল ফোন বিদেশে জন্ম নিয়েছে কি না জানতাম না, অন্তত এখানে তার কোনও ছবিও দেখিনি। এন্টারটেনমেন্ট বলতে রেডিয়ো, সদ্য আগত সাদা-কালো টিভি-র একমাত্র মেট্রো চ্যানেল আর বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি সিনেমা। হলগুলো তখনও স্বমহিমায় বিরাজ করছে। সিনেমার জগৎ ভরভরন্ত। কোথাও টানাটানির চিহ্ন নেই। এক টাকার টিকিটে পিছনের সারিতে বসে সিনেমা আর নাটক দেখি। গতানুগতিকতা বর্জিত ভাল ছবি দেখার জন্য ফিল্ম ক্লাব এবং তার সদস্য হওয়ার জন্য একটা ঝোড়ো হাওয়া ঘুরপাক খেত। আমি যে-ক্লাবের সদস্য হলাম, গণেশদাও যে সেই ক্লাবে আছেন— আমি জানতাম না। আমার এক বন্ধু, গোখেল গার্লস স্কুলের সরলা রায় মেমোরিয়াল হলে একটি ফরাসি ছবি দেখা শেষ হওয়ার পর, ওঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। প্রথম পরিচয়েই মনে হল, অতি আন্তরিক মানুষ। মনে আছে, আমার উপাধি জেনে এবং মধ্য কলকাতায় থাকি শুনে হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘তা হলে তুমি আমার মতো নিখাদ ঘটি। হয়তো বেনেও হতে পারো।’

নিজের বাড়িতে গণেশ পাইন। বাড়ির দেওয়ালেও ছবি আঁকতেন তিনি

হরিশ মুখার্জি রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে শম্ভুনাথ পণ্ডিত স্ট্রিট পেরিয়ে গণেশদা এলগিন রোডের মুখে এসে দাঁড়ালেন। দেখে-আসা ফিল্ম সম্বন্ধে কোনও আলোচনাই করলেন না। ধুতি ও হালকা গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরা নাতিদীর্ঘ মানুষটি জেনে নিচ্ছিলেন কোথায় পড়ি, চলচ্চিত্র নিয়ে উৎসাহিত কেন, অবসর সময়ে কী করি ইত্যাদি। তখন রাত হয়ে গিয়েছে। ধর্মতলা হয়ে শিয়ালদা যাওয়ার বাসে উঠে পড়লেন। আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে মৃদু হেসে বললেন, ‘যতটা এগিয়ে থাকা যায়, বুঝলে। ধর্মতলায় নেমে ভিক্টোরিয়া হাউসের সামনে থেকে বাড়ি যাওয়ার বাস পেয়ে যাব।’ মেট্রো রেলের কাজ তখনও চলছে। শেষ হয়নি।

পরে জেনেছিলাম গণেশদা সে-সময় থাকতেন ট্রপিক্যালের উল্টো দিকে অবস্থিত, কলুটোলা রাজবাড়ির পিছন দিকের একটি গলি কবিরাজ রো-তে। আজও সেই গলি এই নামেই আছে, নাম পরিবর্তন হয়নি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যাতায়াতের সময় এখনও দেখতে পাই। তবে গণেশদাদের বনেদি যৌথ পরিবারের ৩/১এ নং বাড়িটি তেমনই আছে কিনা আর দেখিনি। মহাত্মা গাঁধী রোড পেরোলেই উত্তর কলকাতার শুরু। মধ্য আর উত্তরের মধ্যবিত্ত পল্লির বাড়িগুলো যেমন হয়, গণেশদার কবিরাজ রো-এর বাড়িটাও তেমনই। মধ্যবিত্তের বাসযোগ্য গৃহ। তারই একটা ঘর তখনও পর্যন্ত অকৃতদার গণেশদার শিল্পসৃষ্টির চৌহদ্দি। সেই ঘরে ঢুকে কান পাতলে শোনা যেত সৃষ্টিমুখরতার প্রতিধ্বনি। আমার সঙ্গে ওঁর আলাপের সময় গণেশদার বয়স চল্লিশ কি একচল্লিশ। বাইরে থেকে দেখে কখনও মনে হত না, কত বড় মাপের শিল্পীসত্তা নিয়ে সাধারণ জীবনের মধ্যে মিশে আছেন মানুষটি। শিল্পীরূপে তখন তিনি সর্বমান্য হলেও, বিপুলতর খ্যাতির শিখরে পৌঁছননি।

অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টস-এ সবচেয়ে বেশি নাটক দেখেছি। ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের অন্ধভক্ত ছিলাম। ওঁদের প্রতিটি নাট্যনির্মাণকেই মনে হত স্বর্গের নন্দনকানন থেকে উপড়ে আনা পারিজাত। নাটক শুরু হওয়ার অনেক আগে পৌঁছে আর্ট গ্যালারিগুলো ঘুরে দেখতাম। ওখানে গণেশদার সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল। বলতে গেলে শিল্পতীর্থে শিল্পীর সঙ্গে দেখা। সম্ভবত সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস সংস্থার একটি প্রদর্শনী নর্থ বা সাউথ গ্যালারিতে হচ্ছিল। কিংবা দুটো গ্যালারি নিয়ে। স্বনামখ্যাত শিল্পীদের বড় বড় কাজ। শুধু আকারে বড় নয়, পূর্ণতায়, বীক্ষণে, অঙ্কনে, মননে, চিত্রভাষায়ও বৃহৎ। আজ আর মনে নেই, গণেশদা নিজের কোনও কাজটি সেখানে প্রদর্শনের জন্য দিয়েছিলেন। সব ছবি খুঁটিয়ে দেখার সময় পাইনি। কিন্তু গণেশদা ও রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ দেখতে সময় নিয়েছি। যখন চলে আসছি, ডাকলেন গণেশদা, পিঠে হাত রেখে বললেন, ‘ছবি দেখে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি মনে রেখো, শিল্পীকে সম্মান জানানো আরও বড় বিষয়। আর একদিন এসে সবার কাজ সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখবে।’

সেদিন গণেশদা জ্ঞানও দেননি, পরামর্শও দেননি। অন্তরে আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত শিল্পীরূপে গণেশদা তখনই শিল্পমহলে পরিচিত। তবে শিল্পরসিক ও শিল্পসংগ্রাহকরা তাঁকে অসাধারণ ও অন্যতম প্রতিভাবান হিসেবে আবিষ্কার করলেন আশির দশকে। সম্পূর্ণ নিজস্ব এক চিত্রস্বাক্ষর (সিগনেচার) তিনি তত দিনে নিজের পরিশ্রম ও সংযমে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। কৃতিত্বের সঙ্গে আর্ট কলেজে পড়া শেষ করে চিত্রশিক্ষক হওয়ার চেষ্টা, ফ্যাক্টরিতে ডিজাইনার হিসেবে যোগদানের প্রয়াস, মন্দার মল্লিকের তত্ত্বাবধানে অ্যানিমেশন ছবি তৈরি, গ্রন্থের প্রচ্ছদ অঙ্কন, প্রতিটি শিল্পপ্রদর্শনীতে যোগদান ও পুরস্কার লাভ, শিল্পীসংগঠনগুলির সদস্যপদ, শিল্পীদের সান্নিধ্য, গুণমুগ্ধদের সাহচর্য ইত্যাদি স্তর-স্তরান্তর পেরিয়ে গণেশ পাইন তত দিনে ভারতের দশজন শ্রেষ্ঠ শিল্পীর মধ্যে অন্যতম।

ওঁর শিল্পকৃতি নিয়ে বহু আলোচনা সবাই পড়েছেন। গণেশদার একাধিক সাক্ষাৎকার, ওঁর নিজস্ব এবং অপরের লেখা নানা রচনা ও অভিমতের পাঠক হিসেবে সবিনয়ে বলি, শিল্পী গণেশ পাইনের কৃতিত্ব বিশ্লেষণ করার কোনও চেষ্টাই এই লেখায় করব না। আমার কাছে গণেশদা মানেই এক সহজ, আত্মভোলা, মিষ্টভাষী, কথাপ্রিয় মানুষ।

একদিন আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার তখনকার প্রধান সম্পাদক অভীক সরকার ওঁর ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘এই চিঠিটা পড়ো। তারপর ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্যাখো তো কী ব্যাপার।’ কথা বলতে বলতে প্রধান সম্পাদক আমার দিকে চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। নিজের ঘরে ফিরে এসে সেই চিঠি পড়ে, আমি যেন হাতে চাঁদ পেয়েছি— এমন আনন্দ হল। জার্মানি থেকে জনৈক অচিন্ত্য সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, তিনি একদা গণেশ পাইনের ছবির অনুরাগী ও বন্ধু ছিলেন। তাঁরা দু’জন স্থানিক দূরত্বে অনেকটা ব্যবধানে চলে যাওয়া সত্ত্বেও, চিঠির মাধ্যমে পরস্পরের গাঢ় যোগাযোগ ছিল। অচিন্ত্যবাবুর কাছে গণেশদার লেখা সত্তরটির অধিক চিঠি আছে। চিঠিগুলি তিনি ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশ করতে আগ্রহী।

কালবিলম্ব না করে অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গে প্রথমে চিঠিতে, তার পর সরাসরি ফোনে কথা বললাম। উনি আগ্রহের সঙ্গে একাধিক সিডি-বন্দি করে চিঠিগুলি পাঠিয়ে দিলেন। প্রিন্ট নিয়ে দেখলাম, অচিন্ত্যবাবুর ডাকনাম ‘কানু’ সম্বোধনে গণেশদা চিঠিগুলি লিখেছেন। খোলামেলা, অকপট, সর্বোপরি সচিত্র। প্রথম দিকের চিঠিতে ‘প্রিয় কানুবাবু’। তারপর শুধু ‘প্রিয় কানু’। বন্ধুত্বের সূচনা উনিশশো পঁচাত্তরের জানুয়ারিতে, আর দৃঢ় বন্ধন সাতাত্তরের মার্চ মাস থেকে। শেষ চিঠি মে, উনিশশো পঁচানব্বই। চিঠিগুলির বিষয় একমুখী নয়। কোনওটায় আছে শিল্পকলার বিবর্তন নিয়ে মত বিনিময়, কোনওটায় সমসময়ের শিল্প ও শিল্পী সম্পর্কিত নির্মোহ পর্যবেক্ষণ। কোনওটা আবার দেশে এবং বিদেশে ভারতীয় শিল্পীদের কাজ সম্পর্কে ধারণা। শিল্পসমালোচক শোভন সোম বলেছিলেন, ‘হাত উজাড় করে দেওয়া খসড়ায় ও অজস্র রঙিন ছবিতে আকীর্ণ এই পত্রাবলি হল তাঁর সেই ক’টি বছরের ছবির আঁতুড়ঘর।’

গণেশদাকে জানালাম চিঠিগুলোর কথা। খুব বিস্মিত হলেন। চিঠিগুলি যে হস্তগত করে ফেলেছি তা শুনে আঁতকে উঠে বললেন, ‘সে কী! কী করবে ওগুলো দিয়ে?’ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, ‘দেশ পত্রিকায় আপনার চিঠিগুলো ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে। এ সিদ্ধান্ত আমার নয়, সংস্থার।’

দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে গণেশদা বললেন, ‘সে আবার হয় নাকি! আমি তো এখনও বেঁচে আছি, হর্ষ। বিখ্যাত মৃত ব্যক্তিদের চিঠিই তো দেশ-এ প্রকাশিত হয়।’

এবার উচ্ছ্বাস দমন করে বললাম, ‘সেটাই ট্র্যাডিশন, আমিও জানি। তবে ঐতিহ্য ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার এমন সুযোগ আমরা হাতছাড়া করতে চাই না।’

নিমরাজি হয়ে গণেশদা বললেন, ‘কত বছর আগে লেখা চিঠি! কী লিখেছিলাম কিছুই মনে নেই। আমি কিন্তু চিঠিগুলো না-দেখে ছাপতে দেব না। বন্ধুকে আঁতের কথা লিখতে গিয়ে কারও আঁতে ঘা দিয়ে থাকতেই পারি। অতএব ওগুলো আমাকে না দেখিয়ে প্রকাশ করবে না।’

বললাম, ‘এ তো আপনার সম্পত্তি। আপনি অনুমতি না-দিলে কখনওই ছাপা হবে না। তবে চিঠিগুলো পড়ে আপনি নিজেই অবাক হয়ে যাবেন! এমন একজন গণেশ পাইনকে দেখতে পাবেন, যাঁকে আপনি কুড়ি বছরের ওপারে ফেলে অনেক দূর চলে এসেছেন।’

ফাইল-বন্দি করে সব ক’টা চিঠি গণেশদাকে দিয়ে এলাম। ওঁর বাড়িতে গেলেই আমার জন্য একটা বড় কাপে লিকারের বদলে আসত দুধ-চা— যা আমি খেতে পছন্দ করি। সঙ্গে বিস্কুট বা কুকিজ। মীরা-বউদি অবসর পেলে আমাদের সঙ্গে কথাবার্তায় অল্পক্ষণের জন্য যোগদান করতেন। দুরুদুরু বক্ষে কয়েক দিন অপেক্ষা করার পর গণেশদার কাছ থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত ফোনটি এল, ‘বেশ কয়েকটা চিঠি বাতিল করে দিয়েছি। সেগুলো হয় বালকোচিত, নয় বিতর্ক ডেকে আনবে। বাদবাকিগুলো ছাপতে পারো। তবে পাঠকরা তোমার নিন্দে করবে। যে-এখনও সশরীর বর্তমান, তাঁর চিঠি ছাপাবার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলবে কেউ কেউ।’

আসলে গণেশদা ভীষণ কুণ্ঠিত, লজ্জিত হয়ে পড়েছিলেন আমাদের এই উদ্যোগে। আমি একটু ঘুরিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, ধরুন, আপনার সমসময়ের কোনও বিখ্যাত জীবিত শিল্পীর চিঠি যদি ছাপা হত, তা হলে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হত?’

একটু চুপ করে থেকে গণেশদা দু’টো শব্দ বললেন, ‘ঋদ্ধ হতাম।’

আমার তখন লাফিয়ে ওঠার পালা, ‘আপনার চিঠিগুলিও তাহলে সাধারণ পাঠক, শিল্পসমালোচক ও শিল্পীদের ঋদ্ধ করবে। নিন্দের কোনও অবকাশই নেই। এমন সুযোগ এ জীবনে আর পাব না, গণেশদা।’

‘শিল্পভাবনা’ নামে দেশ-এ ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল গণেশদার বাষট্টিটি জবাবি-পত্র। অচিন্ত্যবাবুকে ধন্যবাদ জানানোর উপযুক্ত ভাষা খুঁজে পাইনি। তাঁরই লেখা চিঠির প্রত্যুত্তরে পরিশীলিত, প্রাণবন্ত এই পত্রসম্ভার। পরবর্তীকালে ‘শিল্পচিন্তা’ নামে বই আকারে প্রকাশিত চিঠিগুলির প্রারম্ভিক ভূমিকায় শোভন সোম একটি দামি কথা বলেছেন, ‘সময়ের খতিয়ানে এই পত্রাবলিতে আমরা তাঁকে তাঁরই ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পাই।’

চিঠিগুলি যখন প্রকাশিত হচ্ছে, বা প্রকাশ সম্পূর্ণ, সেই সময়ে জার্মানি থেকে অচিন্ত্যবাবু কলকাতায় এসেছিলেন। মনে আছে, উঠেছিলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। হোটেল থেকে একদিন অফিসে এসে আমার সঙ্গে দেখাও করে গেলেন। কথায় কথায় জানিয়েছিলেন, ভারতের অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীদের প্রথম যুগের অনেক কাজ ও চিঠি ওঁর সংগ্রহে আছে। গণেশদার বাড়ির হদিশ এবং ফোন নম্বর নিলেন ওঁর সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশে। কিন্তু কোনও কারণে বা অসুবিধায় দুই বন্ধুর পুনর্মিলন ঘটেনি। তবে গণেশদা ‘শিল্পচিন্তা’ বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘বন্ধুবরেষু’ কানুকে।

২০০৪ সালে শারদীয় দেশ-এর প্রচ্ছদ

আনন্দবাজার সংস্থা একটা সময় থেকে, ‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যার প্রচ্ছদ গণেশদা ছাড়া আর কোনও শিল্পীকে দিয়ে আঁকানোর কথা ভাবতে পারত না। ফলে বছরের পর বছর গণেশদার সৃষ্ট প্রচ্ছদ শারদীয় সংখ্যার গৌরব বৃদ্ধি করেছে। সেরা পুজো সংখ্যার প্রচ্ছদ সেরা শিল্পীর কীর্তিতে যেন ভাস্বর। আমি প্রতি বছর মে-জুন মাস নাগাদ ওঁর বাড়িতে গিয়ে প্রচ্ছদ আঁকার আমন্ত্রণ জানিয়ে আসতাম। দু’হাজার দশ সালে প্রচ্ছদের কথা বলতেই রাগে ফেটে পড়লেন, ‘না, আমি কিছুতেই পুজোর প্রচ্ছদ আঁকব না। আর কি কোনও আর্টিস্ট নেই?’

ওঁর রুদ্রমূর্তি দেখে ভয় পেয়ে বললাম, ‘আছেন।’

‘তা হলে তাঁদের কারও কাছে না গিয়ে প্রতি বছর আমাকে নিয়ে কেন টানাটানি করো, বলো তো!’ সম্ভবত ফতুয়া পরে কোনও ছবি আঁকছিলেন। ফতুয়ায় রঙের দাগ। রাগের চোটে হাফ হাতা পাঞ্জাবিটা পরতেও ভুলে গিয়েছেন।

মহাবিপদে পড়ে শরণাগত হয়ে বললাম, ‘আমরা তো আপনাকে ছাড়া এই কাজটির জন্য অন্য কাউকে ভাবিনি। ভাবিও না।’

‘তুমি কি জানো, শিল্পীরা বলে বেড়ায়, ‘দেশ’ পুজো সংখ্যার প্রচ্ছদগুলো প্রতিবছর একই রকমের। গণেশ পাইন কোনও ভ্যারিয়েশন আনতে পারছেন না। এরপরও আমার প্রচ্ছদ ছাড়া তোমরা কেন অচল, বুঝতে পারি না। শোনো, কর্তৃপক্ষকে গিয়ে বলো, আমি হাত তুলে নিয়েছি।’

বিনীতভাবে বললাম, ‘ঠিক আছে বলব। তবে ওই যে আপনি ভ্যারিয়েশনের কথা বলছিলেন, সে সম্পর্কে আমার একটা সাজেশন আছে। আপনি অভয় দিলে বলব।’

আমার কথায় মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি দিলেন। ‘দেখুন, লোকে অনেক কথাই বলে। চিন্তা-ভাবনা ও রঙের ব্যবহারে আপনার প্রত্যেকটা কভারই আলাদা। আসলে প্রতি বছর প্রচ্ছদে গণেশ পাইন দেখলেই কেউ কেউ জ্বলে-পুড়ে উঠছেন। সে বাদ দিন। তবে গণেশদা, সম্প্রতি দুর্গার ওপর ভারতীয় ভাস্কর্য নিয়ে একটি ইংরেজি বই দেখলাম। অপূর্ব সব আর্টপ্লেট, রয়্যাল সাইজ। দিল্লি থেকে বইটি প্রকাশিত হয়েছে। বৈচিত্রের জন্যে বইটি একবার দেখবেন? ‘দেশ’-এ সমালোচনার জন্য এসেছে। বললেই আপনাকে দিয়ে যেতে পারি। আপনি যত দিন ইচ্ছে বইটা রাখুন। অপূর্ব সব স্কাল্পচার। ঐতিহাসিক যুগ থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত।’

নাকের পাটা ফুলিয়ে, মুখ ব্যাজার করে একটু ভাবলেন। পশ্চিমের বারান্দা দিয়ে এক ঝলক হাওয়া এসে ওঁর কাঁচাপাকা চুল অবিন্যস্ত করে দিল। বললেন, ‘ঠিক আছে, দিয়ে যেও।’

বইটি হাতে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘দারুণ বই! অজানা শিল্পী, মানে ভাস্কররা কী সব কাজ ভাবী কালের জন্যে রেখে গিয়েছেন! বইটা দেওয়ার জন্য তোমাকে মেনি থ্যাংকস।’

এরপর চিন্তামুক্ত হতে দেরি হয়নি। দু’হাজার দশেও ‘দেশ’ শারদীয় সংখ্যার প্রচ্ছদশিল্পী গণেশ পাইন। তবে ওই বইটি থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন কিনা, তা আর বুঝতে পারিনি। কেননা, দু’হাজার এগারো সাল থেকে ‘দেশ’ পুজো সংখ্যার প্রচ্ছদ অঙ্কনের কাজ বন্ধ করে দিলেন। তারপর আর ওঁকে পুনর্বার অনুরোধ করার সাহস হয়নি।

‘বইয়ের দেশ’-এর জন্য (জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১০) আমাকে সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় দিয়েছিলেন। অনেকটা সময়। সেই আলাপচারিতা, যেখানে ব্যক্তি গণেশ পাইন নিজেকে একটু একটু করে রেখায়-রঙে প্রকাশ করেছেন, তা কত জন পড়েছেন জানি না। ‘জীবন, ছবি, সাহিত্য ও শিল্পভাবনা’ নিয়ে চিত্রী গণেশদার সঙ্গে সেই দীর্ঘ কথোপকথন আবার পড়তে গিয়ে মনে হল, মানুষটি যেন সামনে বসে কথা বলছেন!

আমার শেষ প্রশ্নের উত্তরে যে-কথাগুলি বলেছিলেন, তা যেন এখনও শুনতে পাচ্ছি— ‘আমার জীবন, আমার চিন্তাভাবনা নিয়ে ছবির জগতে বেঁচে আছি।’

স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী (২০১৩) উপলক্ষে জানুয়ারি মাসে যে-বিশেষ সংখ্যাটি বেরিয়েছিল, তার প্রচ্ছদই ‘দেশ’-এর জন্য গণেশদার শেষ কাজ। বারো সালের শেষ দিকে যখন অনুরোধ করলাম, যথারীতি হাঁকিয়ে দিলেন, ‘অন্য কাউকে বলো। আমার হাতে অনেক কাজ।’

স্বামীজির এই প্রচ্ছদ চিত্রটি দেশ-এ তাঁর শেষ কাজ

সেই সময় ওঁর মন-মেজাজও ভাল ছিল না। সিমা আর্ট গ্যালারিতে মহাভারতের নানা চরিত্র ও মূহূর্ত নিয়ে ওঁর একক ও বিরাট প্রদর্শনীটি ঘিরে শিল্পমহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। ওই প্রদর্শনীটি দেখে সবাই বাক্‌রুদ্ধ হয়ে যাননি। বরং ইথার তরঙ্গে অপূর্ণ প্রত্যাশা ও সমালোচনা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার ওপর এক নামী অবাঙালি শিল্পপতি কয়েক কোটি টাকা দিয়ে পুরো প্রদর্শনীটা কিনে নেওয়ার জন্য ওঁকে বারংবার ফোন করছিলেন। কোনও অনৈতিকতার প্রশ্নে উনি বিরক্ত হচ্ছিলেন, উত্ত্যক্তও। এই প্রসঙ্গটা গণেশদা ও মীরা-বউদি দু’জনেই আমাকে বলেছিলেন। এই অবস্থায় ওঁর না-বলা অস্বাভাবিক নয়। তবু হাল ছাড়িনি।

একদিন ফোন করে বললেন, ‘তুমি আমাকে স্বামীজির কিছু পোর্ট্রেট দিয়ে যেও তো! দেখি কী করা যায়।’

আমি কলকাতার অদ্বৈত আশ্রম (রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের একটি শাখা কেন্দ্র) থেকে বিবেকানন্দের অনেকগুলি রঙিন ছবি নিয়ে গেলাম। ছবিগুলির আদিরূপ সাদা-কালো। কিন্তু অদ্বৈত আশ্রম দীর্ঘদিন ধরে কম্পিউটারের মাধ্যমে, স্বামীজির পোশাক-পরিচ্ছদের বিষয়ে সমকালীন নানা তথ্য ও বর্ণনা অনুযায়ী রং ব্যবহার করেছেন। ছবির ত্রুটি সংশোধনও ছিল এই কাজের অঙ্গ। ছবিগুলি ওঁকে দিয়ে এলাম। খুশি হলেন।

প্রচ্ছদ শেষ হওয়ার পর যে-দিন আনতে গেলাম, সে-দিন ওঁকে দেখেই মনে হল, শরীরটা ভাল নেই। ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘ভেবেছিলাম কাজটা করে উঠতে পারব না। কিন্তু স্বামীজি হাত ধরে করিয়ে নিলেন।’ মনে হয়েছিল, আমার প্রতি স্নেহকেও উপেক্ষা করতে পারেননি।

কলকাতায় তখন শীত। গরম চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ কথা বললেন। আর্ট গ্যালারি, ছবি বিক্রি, ছবির হস্তান্তর, বিদেশে শিল্পী হুসেনের ছবির প্রদর্শনী, পুরাণের চিত্রকল্প অঙ্কনের ভাবনা, ব্রিটেনের সদবি-তে ছবির নিলাম, এমনকী নিজের সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে কীভাবে উইল করে দিয়ে যাবেন—এই সব নানা প্রসঙ্গ। সব কথার মধ্যে উইলের ব্যাপারটা নিয়ে ওঁকে খুব চিন্তিত লাগছিল। আমাকে হঠাৎ জি়জ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, খবরের কাগজে নোটিশ দিয়ে যদি জানিয়ে দিই, আমার সমস্ত সম্পত্তির কে উত্তরাধিকারী, তা হলে কেমন হয়?’ যেন খুব নিকটজনকে প্রশ্নটা করলেন, এমনভাবে আমার দিকে অপলকে তাকিয়েছিলেন।

আমি সেই মূহূর্তে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলাম। এ বিষয়ে জ্ঞান বা বুদ্ধি দেওয়ার মতো কোনও অভিজ্ঞতা এই স্নেহাস্পদের নেই। তবু বললাম, ‘বিজ্ঞপ্তি দেবেন কেন?’

মাথা নিচু করে আনমনে বললেন, ‘ভবিষ্যতে অনেক জটিলতা গজিয়ে যেতে পারে।’

বললাম, ‘আপনার সম্পত্তি আপনি কাকে দেবেন, তা আপনার নিজস্ব অধিকার। যাকে দেবেন, সে-ই পাবে। আপনার আইনি ইচ্ছাপত্রই শেষ কথা।’

ঠিক সেই সময় মীরা-বউদি এক টুকরো কেক নিয়ে এসে সেন্টার টেবিলে রেখে বললেন, ‘এ নিয়ে তোমাদের গণেশদা ক’দিন খুব চিন্তা করছে। তুমি একটু বুঝিয়ে বলো তো।’

‘দাদা, আপনার সঙ্গে নিশ্চয়ই আইনজ্ঞদের চেনাশোনা আছে। তাঁদের সঙ্গে একবার কথা বলুন। তাঁরা সঠিক পরামর্শ দেবেন।’ আমি একটু সংকোচের সঙ্গে বললাম।

যেন হারিয়ে যাওয়া জিনিসটা খুঁজে পেয়েছেন, এমনভাবে শিশুর মতো হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অনেকেই আছেন। ঠিক বলেছ।’

বিষয়টার এখানেই ইতি হয়ে গেলেও কথা থামল না। ওঁর সময় নষ্ট হচ্ছে দেখে উঠে পড়ার মুহূর্তে বললাম, ‘আপনি এবার আপনার আত্মজীবনী লিখুন। চোখের আড়ালেও জীবন যে এত বর্ণময় হতে পারে, তা মানুষ জানুক।’

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে যেন অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘না ভাই, কিছু লিখতে আমার মন চায় না। আর আমি তো লেখক নই। তুমি তো জানো হর্ষ, ছবিকেই জীবনসর্বস্ব করেছি। তাই, পৃথিবীতে যে-ক’দিন আছি, ছবি আঁকার কাজটাই করব। ওটুকুই পারি।’

এরপর আমি আর কোনও কথা বলতে পারিনি। এক-এক সময় মনে হয়, তখনই কি সুতীব্র অনুভূতিপ্রবণ মানুষটি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন?

অন্য বিষয়গুলি:

Ganesh Pyne Painter গণেশ পাইন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE