জুম্মাবার, মানে শুক্রবার। তা’ও আবার রমজানের মধ্যে।
দুপুর দুপুর যখন ঢুকছি মেটিয়াবুরুজ পল্লিতে, তখন বর্ষার গর্ভিণী মেঘে মেঘে এক রুপোলি আলোছায়া সারা তল্লাটে।
বাজারভরা পণ্য আর রাস্তাজোড়া মানুষজন। ট্র্যাফিক আর গার্ডেনরিচের যে লম্বা সড়ক ধরে লখনউয়ের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের স্মৃতিপূত ইমামবাড়ায় যাব, সে-রাস্তায়ও যান চলাচল সাময়িক বন্ধ।
যে-কাউকে জিজ্ঞেস করলেই সাফ জানিয়ে দেবেন, ‘‘সোজা গেলেই থানা, থানার বগলেই প্যালেস।’’ পুলিশ বলল, ‘‘আধা ঘণ্টা সবুর করুন, রাস্তা খুলবে।’’ গাড়িতে অপেক্ষায় বসে ইতিহাসের টুকরো কথাগুলো ফের পড়ে ফেললাম।
• পশুশালায় বাঘ তেইশটি অন্দরে বেগম তিনশো পঁচাত্তর
১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহের এক বছর আগেই কলকাতা পুলিশের পত্তন হয়েছে। কিন্তু নবাবের একত্রিশ বছরের মেটিয়াবুরুজ নিবাসে তখন কলকাতা পুলিশের প্রবেশাধিকার নেই— রাজ্যছাড়া নবাবের এক টুকরো লখনউ কলকাতার এক কোণে।
নবাবের জীবনীকার রোজি লেওয়েলিন-জোন্স বলছেন, সে-মেটিয়াবুরুজ যেন শহরের মধ্যে গ্রামের এক সুন্দর নিদর্শন!
কিংবা আরও তলিয়ে বুঝলে, আধুনিক বঙ্গের মধ্যে এক প্রাচীন ভারত।
১৮৭৪ সালের শরতে আমেরিকার বিখ্যাত একটি দৈনিকপত্রের এক প্রতিবেদন বলছে যে, কিছু আইনি ব্যাপার ছাড়া ব্রিটিশদের কোনও মাথা গলানো চলে না অবধের প্রাক্তন নবাবের গড়ে তোলা এই নকল রাজত্বে।
সে-রাজত্ব ছোট। কিন্তু আঁটোসাঁটো। ছ’হাজার প্রজা নিয়ে দিব্যি চলে রাজ্যপাট। মাসিক এক লক্ষ টাকার পেনশনে নবাবের খাইখরচার শেষ নেই। ফলে ধারকর্জও বেলাগাম। তাই ধার মেটানো, ভাতা বাড়ানো নিয়ে সাহেবদের সঙ্গে আকচাআকচিও অবধারিত।
লখনউ ছেড়ে আসার সময় তাঁর অসংখ্য বেগমের একটা বড় অংশ নবাবের সঙ্গে কলকাতা পাড়ি দেন। পরেও চলে আসেন অনেকে (জীবনের শেষ অবধি ওঁর স্ত্রীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৭৫!)।
সঙ্গী আমির-ওমরাহ, পাইক-বরকন্দাজ, খিদমদগার, গাইয়ে-বাজিয়ে-নর্তকীদের সংখ্যাও তাজ্জব করা।
কিন্তু এই ছোট্ট রাজত্বকে এক আরব্যরজনীর আবেশে বেঁধেছিল নবাবের নিজস্ব চিড়িয়াখানা।
সেই চিড়িয়াখানার পিছনেই ওয়াজিদ আলি শাহের মাস গেলে খরচ ন’হাজার টাকা। কারণ হাজার হাজার পাখপাখালি ছাড়াও (শুধু পায়রাই ২৪ হাজার) সেখানে পোষা হত তেইশটি বাঘ, সিংহ ও চিতা!
এর মধ্যে একটি বাঘ ও একটি বাঘিনী ফেরার হয়। তারা নদী পেরনোর তালে ছিল। বাঘটিকে গুলি করে মারা গেলেও বাঘিনী কিন্তু আধ মাইলটাক চওড়া গঙ্গা পেরিয়ে শিবপুরের বোটানিকাল গার্ডেনে হামলা করে!
পুলিশ যখন রাস্তা খুলে দিল তখনও এ সব মাথায় ঘুরছে। থানার দিকে যাচ্ছি। যেতে যেতে গার্ডেনরিচ-এর জাহাজ কারখানা পড়ল। যেখান থেকে এই সে দিন ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য তিন-তিনখানা যুদ্ধজাহাজ বেরিয়েছে। কিন্তু আমার শুধু কৌতূহল ঠিক কোনখান থেকে সেই বাঘ গঙ্গাপার হল।
এই ঔৎসুক্যের আসল কারণ অন্য। মেটিয়াবুরুজ আজও কেমন জানি ইতিহাসের দু-দুটো সময়ে যাতায়াত করে। হয়তো’বা দু’দুটো সভ্যতাতেও। কারণ যা স্থানীয়দের মেটিয়াবুরুজ, তাই আবার সাহেবদের কাছে হয়েছিল গার্ডেনরিচ।
কী করে, সেই গল্প শুনুন…
• মাটির কেল্লা মেটিয়াবুরুজ, গার্ডেনরিচ
আসলে কথাটা ছিল মাটিয়া বুর্জ, অর্থাৎ মাটির কেল্লা। গঙ্গার বাঁকে এক কালে কাঁচা ইটের এই কেল্লা থেকেই পাহারা চলত।
সেই মাটিয়া বুর্জ থেকেই মেটিয়াবুরুজ উতরোল। শ্রীপান্থ সেই মেটিয়াবুরুজকেই আরও নরম করলেন তাঁর ‘মেটিয়াবুরুজের নবাব’ বইয়ে।
মেটিয়াবুরুজ দিয়ে এগোলে আজও জ্বলজ্বল করতে দেখা যায় তার ওস্তাগর সাম্রাজ্য। সম্ভবত ভারতের সর্ববৃহৎ দর্জিপাড়া।
সব দোকানের সামনেই সুবেশ ছেলেছোকরা। বড়দের জটলা। নবাববাড়ির সড়কের বাঁক থেকেও অনেক সাইনবোর্ডেই এখনও টিকে আছে গার্ডেনরিচ নামটা। যদিও এক দশক হল রাস্তার নাম বদলে হয়েছে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ সরণি।
নবাব-প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত ইমামবাড়ার ম্যানেজার সহৃদয় মৃদুভাষী জনাব আখতার মির্জা বললেন, ‘‘নামকরণটা হয়েছিল মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সময়। ওঁরই উদ্যোগে।’’
নবাব যখন এসে উঠেছিলেন গার্ডেনরিচে তখন এই পল্লি সাহেবদের ছড়ানো বিছানো বাংলোয় বাংলোয় ‘প্রাসাদনগরী’ কলকাতার সঙ্গে টেক্কা দেয়। এখানে আসার সামান্য আগে, ১৮৫৫-য় কলকাতার চিফ জাস্টিসের পদ থেকে অবসর নিয়ে ইংল্যান্ড ফিরে গিয়েছিলেন স্যার লরেন্স পিল। তখনও তিনি গার্ডেনরিচে বসবাসের সুখে এতই বিভোর যে আইল অব ওয়াইট-এ তাঁর মনোরম বাড়িটির নামকরণ করেছিলেন ‘গার্ডেনরিচ’।
গঙ্গার দক্ষিণ কূলের দু’মাইল লম্বা পাড়া ধরে বেড়ে ওঠা সেকালের গার্ডেনরিচের শোভাই আলাদা। দুই বা তিন তলার বাংলোগুলোর পুরোভাগ হত ধনুকের মতো বাঁকানো।
১৭৭০ সাল নাগাদ বাগানবাড়িগুলোর পত্তন শুরু। এর এক দশক পর জলপথে শহরে এসে শিল্পী উইলিয়াম হজেস এক সুন্দর বর্ণনা রেখেছেন গার্ডেনরিচের।—
‘‘জাহাজ যখন কলকাতা ছুঁচ্ছে নদীটা সরু হয়ে আসে। যাকে বলা হচ্ছে গার্ডেনরিচ, সেখান থেকে ধরা দেয় বাগানঘেরা সব সুদৃশ্য ইমারত। এ সব হল কলকাতার বড়লোক বাসিন্দাদের বিনোদভবন।’’
এই ‘ভিলাগুলো’র মেজাজ ও গড়ন কলকাতার চৌরঙ্গির বড়সড় বিল্ডিংগুলোর থেকে কিছু কম যেত না।
• কলকাতায় তোপধ্বনি তিনি এলেন শহরে
১৮৫৬-র ৪ ফেব্রুয়ারি জেমস উট্রামের হাতে তাঁর মাথার তাজ তুলে দিয়ে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ আত্মীয়স্বজন সমেত লখনউ ছেড়ে কলকাতার পথে জাহাজ নিলেন।
১৩ মে পৌঁছলেন শহরে। ৩ জুন তারিখে এলেন গার্ডেনরিচে।
তখ্ত গেছে, রাজ্য থেকেও সরে এসেছেন। তবুও একুশটি তোপধ্বনিতে তাঁর কলকাতা আগমনকে সম্ভাষণ জানানো হয়েছিল।
তবে এই ‘গান স্যালুট’ ছিল তাঁর জীবনের শেষ গান স্যালুট; এর পর আর কখনও তাঁকে অভিবাদন জানানো হয়নি।
সে-সময়কার ভারতশাসক আর্ল মেয়োকে এক বার নবাব প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, তাঁকে যেন সেই একুশটি গান স্যালুট থেকে বঞ্চিত করা না হয়। সে অনুরোধ কখনও রাখা হয়নি।
আজ কেন যেন হাঁটতে হাঁটতে মনে হচ্ছে সেই গার্ডেনরিচ খুঁজে পাচ্ছি না! কে আর আশা করে যে বাড়ির পর বাড়ি থেকে গান আর নাচের আওয়াজ ঠিকরে বেরবে! বিযয়টা এত সরলীকৃত নয়, কিন্তু সংশয়ের উত্তর দিল এই পরিক্রমাই।
তাকিয়ে দেখছিলাম নবাবের ‘রানিমহল’। যার কোনও শোভা বলতে কিছু নেই আজ। শুধু তার একটা ভাড়া পান স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি। আরেকটা হোঁচট খেতেই হয়— তল্লাট জুড়ে জিনিসপত্রের দর হাঁকাহাকিতে। অথচ নবাব কিন্তু এখানেই প্রায় বানিয়ে ফেলেছিলেন তার দ্বিতীয় লখনউ! আসল লখনউ ছাড়ার শোক কখনওই মুছতে পারেননি, তবু!
আফশোস করে বলেছিলেন, ‘‘একটা সময় ছিল, যখন আমার পায়ের তলায় থোকা থোকা মুক্তো চাপা পড়ত। এখন শুধু ওপর থেকে এক নিষ্ঠুর রোদ আর পায়ের তলায় কাঁকর।’’ —এই ২০১৫-য় তাঁর ফেলে যাওয়া স্মৃতির মহলে ঘুরতে ঘুরতে (শাহি ইমামবাড়ায় কবরস্থ আছেন স্বয়ং নবাব, তাঁর পুত্র বির্জিস কাদের, শোভা পাচ্ছে নবাবের মসনদ, যেটি তুলে নিয়ে গিয়ে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’-র শ্যুটিঙে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়) যা দেখি তাতেই মগজে ভিড় করে রাশি রাশি গল্প।
চলুন গল্পে যাই, যা আসলে স্পন্দমান ইতিহাস।
• নবাব গ্রেফতার রানির কাছে দরবার
১৮৫৬-র ৩ জুন নবাব এলেন বটে গার্ডেনরিচে, কিন্তু এক বছরের মাথায়, ১৬ জুন, তাঁকে গ্রেফতার করে রাখা হল ফোর্ট উইলিয়ামে। কারণটা বলার আগে দূরত্বটাও বলতে হয়।
গার্ডেনরিচ থেকে দুটি পথে ফোর্ট উইলিয়াম পৌঁছনো যায়, যার একটার দূরত্ব দাঁড়ায় তিন কিলোমিটার। অন্যটায় দুই কিলোমিটার।
১৭৮৩-তে কলকাতায় জজ হয়ে এসে যখন ৩ নং গার্ডেনরিচে থাকা শুরু করেন মহৎ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স, তিনি রোজ ভোরে পায়ে হেঁটে ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে সংস্কৃতের চর্চায় বসতেন।
পরে সেখানেই বেঙ্গল বেঞ্চের জজিয়তি করে এবং বিকেলে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটির (তখনও পার্ক স্ট্রিটের বাড়ি হয়নি সোসাইটির) কাজ সেরে সন্ধেকালে ঘোড়ার গাড়িতে বাড়ি ফিরতেন।
দূরত্বটা ঠিক কতটুকু, তা মাপার জন্য গাড়ি করে জোন্স-এর বাড়ি থেকে ফোর্ট উইলিয়াম গেলাম।— ড্যাশবোর্ডে দেখলাম দেখাচ্ছে ৩ কিমি। যাওয়ার পথে একটা অতিরম্য দৃশ্য আছে। খিদিরপুর ডকের একটা ব্রিজ পেরোতে হয়। সেখানে গাড়িটা দাঁড়াতে চোখ জুড়িয়ে দিল বন্দরের শোভা— জাহাজ, জাহাজ আর জাহাজ।
হয়তো এখানে দাঁড়িয়েই স্যার উইলিয়াম তাঁর স্ত্রীকে হাত নেড়ে শেষবিদায় জানিয়েছিলেন।
মনে প্রশ্ন জাগল নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ কি এখানেই নেমেছিলেন?
বেশিক্ষণ দাঁড়ানো গেল না, কারণ এখন প্রতিরক্ষার কারণে ওখানে দাঁড়াবার নিয়ম নেই।
তা হলে এইটুকু দূরত্ব নবাবকে সরাতে হল কেন? যিনি লখনউয়ে উট্রামকে তাজ তুলে দিয়ে বলেইছিলেন, ‘‘এমনটা আমার প্রতি করার অর্থ কী? কী আমার দোষ?’’
উট্রাম তখন ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে সই করার জন্য কাগজ এগিয়ে দেন। নবাব তা মন দিয়ে পড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন, ‘‘চুক্তি সমানে সমানে হয়। আমি এখন আর কে, যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে যাব?’’
তিনি পেনশনও নেবেন না, বরং ইংল্যান্ডে গিয়ে রানির কাছে দরবার করবেন ভুলত্রুটি মাফ করে মসনদ ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
ইংল্যান্ডে দরবার করা হয়েছিল, কিন্তু সেটা করতে গিয়েছিলেন নবাবের বৃদ্ধা মা মালিকা কিশোয়ার বাহাদুর ফকরুজ-জামানি নবাব তাজ আরা বেগম। সংক্ষেপে এবং চলতি সম্ভাষণে জনাব-ই আলিয়া।
শেষমেশ পুত্র ওয়াজিদ আলি এসেছিলেন কলকাতা। থুড়ি, গার্ডেনরিচ।
• মুক্তির আনন্দে এক দিনে তিনটে বিয়ে
১৮৫৭-র ১০ মে মেরঠে মহাবিদ্রোহ শুরু হয়ে দিল্লি অবধি ছড়াতে ব্রিটিশরা আর সবুর করেনি।
১৬ জুন নবাবকে কেল্লায় পাঠিয়ে অপশাসনের দায়ভাগি নবাবকে কোম্পানির এক রাজনৈতিক বন্দি করে রাখল।
বলা বাহুল্য, বানানো অভিযোগ।
১৮৫৮-র ২ অগস্ট মহারানির ঘোষণায় মহাবিদ্রোহ শেষ হল।
তার আগে, ২ অগস্ট, গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া অ্যাক্ট দিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্ছেদ হয়েছে।
আর ১৮৫৯-এর ৯ জুলাই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের কারাগার থেকে গার্ডেনরিচে ফেরেন নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ।
লখনউ ছেড়ে তড়িঘড়ি যখন কলকাতা এসেছিলেন নবাব, তাঁকে তোলা হয়েছিল ইতিপূর্বে উল্লেখিত চিফ জাস্টিস স্যার লরেন্স পিল-এর ছেড়ে যাওয়া বাংলোয়।
সে যেন এক ছোটখাট মেটকাফ হল। নবাবের পছন্দ না হয়ে উপায় ছিল না। বড় কথা, গঙ্গাপাড়ের বাড়ির নিজস্ব একটা ঘাটও ছিল।
ইমামবাড়ার প্রধান কক্ষ। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
নবাব চাইলে তাঁর নতুন বাড়ির উত্তরের বারান্দায় বসে লখনউয়ের গোমতী নদীর চেয়ে বড় গঙ্গা-দর্শন করতে পারতেন। যা ছিল স্যার লরেন্স পিল-এর ১১নং বাংলো (সাহেবদের বাংলোর কোনও নাম থাকত না, শুধু একটা করে নম্বর), তারই নতুন নামকরণ হল সুলতানখানা, বা রাজবাড়ি।
মেটিয়াবুরুজে ঘোরাঘুরি করলে চট করে সুলতানখানা এখন চোখে পড়ার নয়। তবে সাবেকি চেহারা এখনও ধরা আছে। অবশ্য তা বহিরঙ্গের, এটা এখনও বেশ সাহেবসুবো দর্শন। একেবারে ভেতরের দৃশ্য কেমন আছে, তা যদিও জানা হল না।
শুধু সুলতানখানা নয়, তার পাশের দুটো জমি ও বাড়ি নবাব কিনে নিয়েছিলেন সাকুল্যে তিন লাখ টাকায়। ইউরোপীয় স্টাইলের বাংলোকে গড়ে নিয়েছিলেন ভারতীয় স্টাইলে। পাশে নিজের নমাজের জন্য মসজিদ।
এই তিন জমি ও বাড়িতে ঠেসেঠুসে ভরে দিয়েছিলেন তাঁর বউ-ছেলেমেয়ে, অসংখ্য সভাসদ ও কাজের লোকদের। এর মধ্যে ছিল ৫০ জন আফ্রিকার দাস, ২৪৫ জন ‘বিশেষ রক্ষী’, ১২০ সশস্ত্র রক্ষী, ২০ জন দণ্ডবাহী, ১৮ জন খোজা। এ ছাড়াও ছিল কসাই, কামার, কুমোর, রসুইকর, জমাদার, ধোপা, নাপিত, ঘণ্টাপিটাই।
নবাবের প্রধানা স্ত্রী বা খাস মহলেরও একটা ছোট দরবার ছিল। সেখানে দর্জি, ধোপানি, ধাই। চাকরানি, হুকাবরদার, পঙ্খাওয়ালি, পানওয়ালি ছাড়াও ছিল গল্প শোনানোর মেয়েরা। অন্য রানিদের বন্দোবস্ত কিছু কম যায় না। তাতেও অজস্র রানিতে খেয়োখেয়ি, ঝগড়াঝাঁটি, লাগানো-ভাঙানো, মন্দ সম্পর্কের শেষ নেই।
একটা সময় এল যখন চার দেওয়ালের মধ্যে হাঁসফাঁস-করা অনেক বেগমই লখনউ ফিরে যাবার উদ্যোগ করেন। অনেকে পরে ফিরেও আসেন, রাজ্যচ্যূত নবাবের যে কিছু কম আকর্ষণ ছিল না বেগমের কাছে। ১৮৫৯-এর শরতে প্রথম মেটিয়াবুরুজ ছাড়েন ছোটি বেগম।
আর ওই ১৮৫৯-এর ১৬ নভেম্বর ফোর্ট উইলিয়ামের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার আহ্লাদে একই দিনে তিনটে নতুন বিয়েও করেন নবাব।
মেটিয়াবুরুজে একত্রিশ বছরে কম বিয়ে করেননি তিনি। আর এই নতুন বেগমদের অনেককেই আনা হয়েছে ওঁর প্রিয় লখনউ থেকে।
আজ মেটিয়াবুরুজের নবাবপাড়ায় হাঁটলে জেমস ফ্রেজার-এর আঁকা খিদিরপুরের রাস্তার দৃশ্যের সঙ্গে মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এক সেই শাহি ইমামবাড়া ছাড়া যুগের ছবি ধরে রাখার মতো কিছু পাওয়া ভার।
সেই প্রাসাদকেও হেরিটেজ বিল্ডিং ঘোষণা করেও সরকারি টাকার জোগান থমকে আছে।
ম্যানেজার আখতার মির্জা বললেন, ‘‘যে এক লাখ টাকার মতো ভাড়া ওঠে তাই দিয়ে সামলেসুমলে চলছি। মেরামতিতেই বিশ-ত্রিশ হাজার লেগে যাচ্ছে। গোটা ইমামবাড়া করতে কয়েক কোটি। কোত্থেকে আসবে?’’
ইমামবাড়ার লাগোয়া একটা অংশে জেনানা-মহল ছিল। সে-অংশও এখন ভাড়ায় আছে।
ইমামবাড়ার গেটও এখন হকারদের দখলে। তাদের বলেকয়েই প্রায় ভেতরে ঢুকতে হয়। কিন্তু একবার ভেতরে ঢুকলে অবিচল প্রশান্তি। একেবারে অন্য এক সময়।
সেখানে নবাবের মসনদ, কোট অফ আর্মজ, তরোয়াল, সংগ্রহের পিকদানি, বাতিদানি, ঝাড়বাতি, পা-দানি, সাইডটেবল, বৃদ্ধবয়েসের ছবি, পুত্র বির্জিস কাদেরের কবর, মৌলবীদের তখ্ত (কী বলব? তখ্ত-এ-জজবাত?) হারানো দিনের দরবারি কানাড়ার মূর্ছনা ধরে রেখেছে।
নবাবের বৃদ্ধ বয়েসের একটি ছবিও সেখানে টাঙানো। গোঁফ, দাড়ি সব বেবাক সাদা। চাউনির মধ্যে কিন্তু একটা সাঙ্ঘাতিক রাজকীয় ভাব। শরীরটা বহরে প্রায় তেমনই আছে। কিন্তু কলকাতা নির্বাসনের ৩০টা বছরের ক্ষয়ক্ষতি মুখের ওপর ধরা।
• অমিরন এবং ওয়াজিদের প্রেম, বহুবিবাহ
ছাব্বিশ বছর বয়সে নবাবের মনে হয়েছিল— ‘‘জীবনের প্রথম থেকে এখন অবধি আমার প্রেম-ভালবাসার কথা লিখব।’’
লেখাও শুরু করলেন, যে-বছর নবাবিতে অভিষিক্ত হলেন, সেই বছরেই। এবং শেষ করলেন দু’বছরে।
সেই অপরূপ জীবনকথাই ব্যাখ্যা করে তাঁর বিচিত্র জীবনদর্শনকে। লখনউয়ের যে-স্বপ্ন মেটিয়াবুরুজে এসেও ভেঙে ধুয়ে যায়নি।
জীবনের গোড়ার থেকেই প্রেমের আকাঙ্ক্ষায় মনোবেদনার কথা লিখেছেন নবাব।
বলছেন, সব মানুষের মনকেই আল্লাহ ‘প্রেমের স্বাদ’-এ নিষিক্ত করেন, কিন্তু তাঁর যে-জীবন হওয়ার কথা ছিল চিরবসন্তের বাগান, তা-ই হয়ে পড়ল খাঁ খাঁ প্রান্তর।
কী করে তা ঘটল তার বর্ণনাতেই বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদ।
যখন মাত্র আট বছর বয়স তখন বালক রাজকুমারের দেখাশোনায় ছিল এক মধ্যবয়সী পরিচারিকা রহিমান।
‘‘একদিন যখন বিছানায় শুয়ে সে জোরজবরদস্তি আমাকে যেখানে-সেখানে হাত বুলোতে লাগল। বাচ্চা ছিলাম, ভয়ে পালাতে গেলাম, কিন্তু সে আমাকে জোর করে আটকে রেখে ভয় দেখানো শুরু করল। বলল পড়ার মাস্টারের কাছে নালিশ করে শাস্তি দেওয়াবে। আমি তো ঘাবড়েই রইলাম, তাতে আমার শরীর নাড়াঘাঁটা ওর একটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেল।’’
আজকের দিনে যাকে শিশুর যৌন নিগ্রহ বলে, বালক ওয়াজিদ আলির ওপর তা নাগাড়ে দু’বছর চলেছিল, যদ্দিন না রহিমান বরখাস্ত হল। কিন্তু সে যেতে বালকের জীবনে ঢুকল পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ বছরের, ঝলমলে পোশাকধারিণী নকরানি অমিরন।
এক রাতে ওয়াজিদকে বিছানায় একা পেয়ে তার পাশেই শুয়ে পড়ল অমিরন। আর এবার যেন কোনও ভয়ভীতি, জোরাজুরি রইল না এক অস্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হওয়ায়।
কিন্তু এভাবে অতঃপর যা ঘটল তা সারাজীবনের মতো প্রভাব ছড়াল ওয়াজেদ আলির জীবনে। ‘‘সেই থেকে’’, তিনি লিখছেন, ‘‘প্রণয়ের সম্পর্কের প্রতি আমার দুর্বলতা সৃষ্টি হয়ে গেল।’’ আর কাব্যে-কাব্যে তিনি সমানে দাবি করে চললেন যে, ‘‘প্রকৃত প্রেমিক–প্রেমিকার পরিস্থিতি প্রায়ই আমাকে ব্যথাতুর করে।’’
তাঁর মনের পর্দায় ভাসত এক ‘নিষ্ঠুর’ প্রেমিকার ছবি যে কেবল নির্দয় ভাবে খেলেই চলে পুরুষের মনোবাসনা নিয়ে।
ওয়াজেদ আলির যা ক্ষোভ তা-ই নিয়েই তো সিংহভাগ ফার্সি ও উর্দু কবিতা। যা এক সময় আধ্যাত্মিক সংবাদে পৌঁছে যায়। কিন্তু ওয়াজেদ আলির কথনের মাত্রা অন্য।
এক শিশুর কান্না ধ্বনিত হয়েছে তাঁর আত্মজীবনী ‘পরিখানা’-র বিলাপে। যে–শিশু অমন ভাবে যৌনজীবনে নিক্ষিপ্ত হয়ে সারাজীবন প্রেমের তৃষ্ণাই ভোগ করেছে, তৃপ্তির সন্ধান পায়নি। বয়সকালে শ’য়ে শ’য়ে বিয়েও করেছে, এক বন্ধন থেকে আরেক বন্ধনে গেছে, বন্ধন মুক্তির আশায়, নেশায়।
নহবতখানা
নবাবের বংশধরদের থেকে তাঁর বহুবিবাহের এক সুন্দর ব্যাখ্যা শুনেছিলেন রোজি লেওয়েলিন জোন্স।
তাঁদের মতে, নবাব ভেতরে ভেতরে এতই ধার্মিক যে মুতাহ্ শাদি না করে তিনি কোনও মেয়ের সেবা নিতেন না। বিয়ে না করে কোনও মেয়ের সঙ্গে একান্তে রইবেন না।
লেওয়েলিন জোন্সের মনে হয়েছে এ বেশ আকর্ষক কারণ-দর্শানো, যদিও তা তাঁর সব বিয়ের ব্যাখ্যা জোগায় না।
মেটিয়াবুরুজের ইমামবাড়ায় তাঁর শতেক বেগমের মধ্যে কেবল একজনেরই প্রতিকৃতি শোভা পায়। ম্যানেজারের ঘরের দেওয়ালে। বেগম হজরত মহল।
তাঁর নিকাহ্ করা তিন বেগমের একজন। যিনি নবাব কলকাতা এলে তার সঙ্গী হননি, কারণ তত দিনে নবাব ওঁকে তালাক দিয়েছেন। নবাবকে সরিয়ে ব্রিটিশরা মহাবিদ্রোহ সামাল দিতে ব্যস্ত হতেই প্রস্তাব আসে নবাবের তখতে— নতুন কাউকে বসানোর। তাতে বেগম হজরত মহল তাঁর গর্ভে নবাবের বারো বছরের পুত্র বির্জিস কাদেরকে বসিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার তোড়জোড় শুরু করেন।
১৮৫৮-র ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ বাহিনী লখনউয়ের ওপর চড়াও হলে দু’সপ্তাহ ধরে মরণপণ যুদ্ধ চলে লখনউয়ের বুকে।
শেষে শহরটা ইংরেজদের ফের কব্জায় আসতে হজরত মহল, বালক পুত্রকে সঙ্গে করে কাঠমাণ্ডু পালিয়ে যান। এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটে।
এই সেদিন নেপালের ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কাঠমাণ্ডুর অজস্র স্থাপত্যের সঙ্গে হজরত মহলের সমাধিটিও ধূলিসাৎ হয়।
পুত্র বির্জিস এক সময় চলে আসেন মেটিয়াবুরুজে এবং এখানেই প্রয়াত হয়ে পিতার সঙ্গে কবরস্থ আছেন এক ছাদের তলায়। অর্থাৎ গার্ডেনরিচের সিবতৈনাবাদ ইমামবাড়ায়।
ইমামবাড়ার প্রধান হল-এর বাঁ হাতের কাচ আর লোহার শিকে ঘেরা ঘরটায় কবরস্থ আছেন অবধের শেষ নবাব। যাঁকে তাঁর বইয়ে রোজি লেওয়েলিন জোন্স বলেছেন ‘দ্য লাস্ট কিং ইন ইন্ডিয়া’। হঠাৎ এক প্রদেশের শেষ নবাবকে ‘ভারতের শেষ রাজা’ বলা কেন? লেখিকার উত্তর, ‘‘মনে হল বইয়ের নামকরণে ওই বর্ণনাটাই বেশি মানায়।’’ আসলে নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের সঙ্গে এই ‘শেষ’ কথাটা অদ্ভুত মসৃণতায় জুড়ে গেছে।
মাত্র ন’বছরের নবাবি সাঙ্গ করে রাজ্য ছাড়া হয়ে যিনি তাঁর অমরগীতি রচনা করলেন ‘যব ছোড় চলি লখনউ নগরী’, লখনউ হারিয়ে তিনিই আবার নতুন করে লখনউ গড়লেন গঙ্গার পাড়ে। ফোর্ট উইলিয়ামে দু’ বছরের কারাবাসে এক মসনবি বা দীর্ঘ কবিতায় নিজের পতন ও বেদনার বৃত্তান্ত লিখলেন। সে-রচনার নাম রাখলেন ‘হুজ্ন-ই-আখতার’ বা ‘আখতারের দুঃখ’। ভারতের শেষ বাদশাহ বাহাদুর শাহ দিল্লি থেকে বিতাড়িত হয়ে জাহাজে করে বর্মার রেঙ্গুনে আশ্রয় নিতে যাবার পথে তরী থামালেন গার্ডেনরিচে। সে-শুধু সুলতানখানার বারান্দায় দাঁড়ানো নবাবকে দূর থেকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাবেন বলে।— এই ওয়াজিদকে ‘শেষ রাজা’ বলে ডাকারও একটা সমীহের ইতিহাস তৈরি হয়ে আছে!
প্রেমচন্দের দুই দাবাড়ুর গল্পকে অবলম্বন করে এই শেষ রাজাকেই সেলাম জানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছবিতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy