নিবিড় বিমূর্ততার ভিতরে-বাইরে কখনওই মনে পড়তে দেননি কোনও ম্যানারিজ়মকে। সলিড ফর্ম অথবা প্রতিচ্ছায়া, রেখা কিংবা ছায়াতপ, ঘষামাজা সমতল বর্ণ কিংবা মিশ্রণ, হালকা বা গাঢ় বর্ণিল প্যাটার্ন কখনও ডিজ়াইন হয়ে যায়নি। বিমূর্ততার ঘন রহস্যেই কম্পোজ়িশনের সমাধান লুকোনো আছে। লালুপ্রসাদ সাউয়ের একক প্রদর্শনী ‘মর্নিং ডিউ’ সম্পন্ন হল সম্প্রতি আকৃতি গ্যালারিতে—তাদেরই আয়োজনে। সবই গোয়াশ। সবই এই সময়ে করা অ্যাবস্ট্রাক্ট পেন্টিংয়ের সিরিজ়।
এক সময়ে এই বর্ষীয়ান শিল্পী বেশ কিছু সাদাকালো লিথোগ্রাফে জ্যামিতিনির্ভর, স্ট্রাকচারসমৃদ্ধ ছবির কাজ করেন। এ বারের চিত্রমালার বিমূর্ত সিরিজ়টি বেশ দৃষ্টিনন্দন। সুদীর্ঘ সময় ধরে টেম্পারা-আশ্রিত প্রচুর ‘বাবু-বিবি’র ছবির নীরব আকুতি ও অব্যক্ত এক ধরনের নৈঃশব্দ্যবোধকে উজ্জীবিত করা কাজগুলিতে নরনারীর সংক্ষিপ্ত বিলাস, প্রসাধন, নিপাট বেশভূষা, স্থিরচিত্রের পুষ্প-পল্লবিত মুহূর্তকে উদ্ভাসিত করার ক্ষেত্রে শিল্পী লালুপ্রসাদ একটি নিজস্ব স্টাইল তৈরি করে ফেলেছিলেন। বহু জনের সংগ্রহে থাকা অনেক কাজ তার সাক্ষ্য বহন করছে। বলতে দ্বিধা নেই, কখনও কখনও একটু হলেও মনোটোনি এসে গিয়েছে ছবিতে। তুলির কাব্যিক রেখার ছন্দোবদ্ধতা তাঁর নিপুণ এক স্টাইল ছাপিয়েও যেন চলে গিয়েছে সমতল বর্ণের আবহকে কেন্দ্র করে বেশ শৃঙ্খলাবদ্ধ এক ডিজ়াইনধর্মিতার দিকে! লোকশিল্প যে তাঁকে খুব বেশি প্রভাবিত করেছিল, সন্দেহ নেই।
এ বারের অ্যাবস্ট্রাক্ট সিরিজ়টি সব দিক থেকেই বিবর্তিত। ছাপচিত্রের পুরনো ঘরানাকে নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে তাঁর সাবকনশাসে এক নির্জন বর্ণ-তোলপাড় কাজ করেছিল। মাধ্যম বদলে দেখা গেল, হরেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবাধ উচ্ছ্বাস! এই তীব্র স্বাধীনতাই বুঝি উসকে দিয়েছিল লালুপ্রসাদকে ফর্ম ও কনটেন্টের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘবদ্ধতাকে একই সঙ্গে সন্নিবেশিত করতে! ফর্ম হিসেবে তখন কনটেন্টকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ওই স্ট্রাকচারাল কোয়ালিটি, যার জ্যামিতিনির্ভর এক কাব্যিক স্টাইলও তৈরি হয়ে যাচ্ছে, চৌকো একই মাপের পটের মধ্যিখানে।
চওড়া ফ্ল্যাট ব্রাশিং, বহু ক্ষেত্রেই রোলার-নির্ভর আধাবর্তুল লম্বাচওড়া বঙ্কিম ও দিক-পরিবর্তিত ফর্মেশনের মধ্যেই গড়ে উঠেছে কম্পোজ়িশন।
চিরুনির দাঁতের টানটোন, বিচ্ছিন্ন রঙের প্রতিচ্ছায়ার কিছু বৈপরীত্য, রূপবন্ধের সঙ্গে বা পাশে মিশ্র বর্ণের ছায়াতপ, মশারি-জালের বা চটের বস্তার মতো প্রতিচ্ছায়া, হালকা-গাঢ় বর্ণের উপর অন্য বর্ণের ওভারল্যাপিং এবং কখনও কখনও এই স্টাইল এবং ফর্মের মধ্যে কিছু শুকনো রং না-লাগা অধ্যায় তৈরি করে, এক অপূর্ব উজ্জ্বলতা বা টুকরো আলোকে তীব্র সুন্দর কাজে লাগিয়েছেন লালুপ্রসাদ। মনে হয়, ব্যান্ডেজের কাপড় আটকে দিয়েছেন ছবিতে। উপর-নীচে রঙের পোঁচে ঘষামাজা রং-ও বেশ একটা রোম্যান্টিক আবহ তৈরি করেছে। মোটা রঙের মিশ্রণ একে অন্যের সঙ্গে মিশে বিমূর্ততাকে ছাড়িয়েও যেন কী এক কাহিনি তৈরি করছে। এই ভিস্যুয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ কিন্তু রং এবং ফর্মের দ্বিমাত্রিক পটকে এক সাঙ্গীতিক মূর্ছনার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বহু কাজেই সাদার ব্যবহার অপূর্ব!
স্ট্রাকচারই তৈরি করে দিচ্ছে রঙিন মুহূর্তের জ্যামিতিক ছন্দ। আবার সচেতন ভাবে জ্যামিতিকে প্রাধান্য দিয়ে গড়া হচ্ছে স্ট্রাকচারের বিমূর্ত রূপবন্ধ। নির্মিত হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি, রঙের রহস্যময় আস্তরণ। করণ-কৌশলের মাধ্যাকর্ষণে থেমে থাকা কম্পোজ়িশনই তখন অন্য রূপ পেয়ে যাচ্ছে এক না-বলা কাহিনির অনন্য রূপকথায়! দর্শককে এতেই মোহিত করেছেন লালুপ্রসাদ।
সমতল রংকে দু’পাশে রেখে— নাটকের দৃশ্যকাব্য রচিত হচ্ছে। আবার ঘোর কালো ও কালোর ভাঙা প্রতিচ্ছায়ার ছায়াতপে কিছু সূক্ষ্ম ধাতব পাতের রেখা যেন সাদাকে ভেদ করে রচনা করছে একটি কবিতা। রঙের বিভিন্ন একক ও মিশ্র প্রতিধ্বনি থেকে উঠে আসা ভিন্ন প্যাটার্ন স্ট্রাকচারগুলির অলঙ্কার। ফর্মের বৈপরীত্যে লক্ষ করা যাচ্ছে আর এক ধরনের ফর্ম অন্যান্য মিশ্র রঙের সাহায্য নিয়ে তৈরি করছে এক ব্যালকনি, যাতে লাল-কালোর অদ্ভুত উপস্থিতি তাদের অস্তিত্বকে হালকা বাদামি বোর্ডের মাঝখানে রেখে, যেন অদ্ভুত এক গদ্যকবিতা রচনা করছে। লালুপ্রসাদের এই বিমূর্ত এবং আশ্চর্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার বর্ণমালা যেন একই সঙ্গে বাজছে ও নড়াচড়া করছে। এটি ছিল নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল প্রদর্শনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy