Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪

আইনস্টাইনের নারী

খুড়তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম-সহবাস। কুমারী প্রেমিকার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া। স্ত্রীর পরকীয়া। প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীর বিস্ফোরক প্রণয়কাহিনি লিখছেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্যআইনস্টাইনের প্রথম প্রেমে পড়া ও প্রথম তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখা একই বয়সে—১৬! প্রবন্ধটি ছিল ‘চৌম্বক ক্ষেত্রে ইথারের অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধান’। আর প্রেমিকা ছিল মারি ভিন্টেলার। আলবার্টের চেয়ে দু’বছরের বড়, সদ্য কলেজে শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়।

মিলেভার পাশে

মিলেভার পাশে

শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

আইনস্টাইনের প্রথম প্রেমে পড়া ও প্রথম তাত্ত্বিক প্রবন্ধ লেখা একই বয়সে—১৬!

প্রবন্ধটি ছিল ‘চৌম্বক ক্ষেত্রে ইথারের অবস্থান নিয়ে অনুসন্ধান’। আর প্রেমিকা ছিল মারি ভিন্টেলার। আলবার্টের চেয়ে দু’বছরের বড়, সদ্য কলেজে শিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায়।

আলবার্ট তখন ভিন্টেলার পরিবারের সঙ্গেই থাকে, জুরিখ থেকে পঁচি‌শ মাইল পশ্চিমে, আরাউ গ্রামে।

আরাউ কেন? কারণ অত অল্প বয়েসে জুরিখ পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়া যাবে কিনা সন্দেহ ছিল আলবার্টের।

আলবার্ট বেছে নিয়েছিল আরাউয়ের গ্রামের জীবন। সেখানকার ইস্কুলের খোলামেলা পড়াশুনোর পরিবেশ। একই সঙ্গে প্রেমে পড়েছিল গ্রামটির ও ভিন্টেলার পরিবারের মেয়েটির।

প্রথম প্রেমপত্র

প্রেমিকা মারির বোন আনা সে-সময়ের আলবার্টকে বর্ণনা করেছেন এ ভাবে: ‘‘ওর দারুণ রসবোধ ছিল। আর সময়-সময় আলবার্ট প্রাণভরে হাসত।’’

আরেক মহিলার বর্ণনায়, ‘‘মেয়েদের মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো পুরুষালি চেহারা ছিল ওর।’’ ঢেউ খেলানো কালো চুল, অভিব্যক্তিপূর্ণ চোখ ও চাহনি, চওড়া কপাল আর খোশমেজাজি স্বভাব। ‘‘ওর মুখের নীচের অংশ হতেই পারত কোনও ইন্দ্রিয়াসক্ত পুরুষের, যার জীবনের প্রতি টানের অভাব নেই।’’

আলবার্ট ও মারির প্রণয়ে ওদের দুই পরিবারেই তখন প্রবল চাঞ্চল্য।

মারি নতুন বছরে আলবার্টের মা’কে গ্রিটিং কার্ড পাঠালে তিনি উষ্ণতার সঙ্গে জবাব দিলেন: ‘‘তোমার ছোট্ট চিঠি, স্নেহের মারি, আমাকে ভীষণ আনন্দ দিয়েছে।’’

সেই বছরের বসন্তে বাড়ি ফিরে আলবার্ট মারিকে ওর প্রথম প্রেমপত্র লেখে। লিখল:

‘‘প্রিয়তমা,

অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমার ছোট্ট মিষ্টি চিঠির জন্য, যা আমাকে অশেষ আনন্দ দিয়েছে। ওই টুকরো কাগজ বুকে ধরে কী যে একটা অনুভূতি হল! কারণ ওই পাতায় দুটি প্রিয় চোখ তোমার দৃষ্টি ফেলেছে আর ওর ওপর তোমার নরম হাত দুটি চলাফেরা করেছে। অ্যাদ্দিনে টের পাচ্ছি, ছোট্ট দেবদূতী আমার, মন কেমন করা আর মিলনাকাঙ্খা কী বস্তু! তবে বিরহ যত না বেদনা আনে তার চেয়ে ঢের বেশি সুখ আনে প্রেম...

মা তোমাকে না চিনেই ভালবেসে ফেলেছেন। শুধু তোমার দুটো মিষ্টি চিঠি তিনি পড়েছেন। মা খুব হাসাহাসি করেন আমাকে নিয়ে, কারণ আমি আর আগের মতো অন্য মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হই না। আমার কাছে সারা জগতের থেকেও তোমার মূল্য অনেক বেশি এখন।’’

ছেলের চিঠিতে মা একটা ছোট্ট পুনশ্চ যোগ করে দিয়েছিলেন, ‘‘এ চিঠি না পড়েই এতে আন্তরিক শুভেচ্ছা যোগ করছি।’’

ভেঙে গেল প্রেম

আরাউয়ে এক বছর কাটিয়ে আলবার্ট যখন জুরিখে ফিরে পলিটেকনিকে ভর্তি হল, তখন থেকে দুটি মস্ত বিবর্তন ওর মধ্যে কাজ করতে দেখা যায়।

দুটিই বলা চলে, প্রেমঘটিত।

প্রথমটি পদার্থবিদ্যানুরাগী আলবার্টের অঙ্কশাস্ত্রের প্রেমে আবদ্ধ হওয়া।

দ্বিতীয়টি মারি ভিন্টেলারের সঙ্গে সেই অপূর্ব প্রেমের নিগড়টি ছিন্ন হওয়া।

কোথায় কখন যে সম্পর্কের সুরটা কেটে গেল এত দিনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে বিচার করা খুব কঠিন।

মিষ্টি কিন্তু ছটফটে স্বভাবের মারির সঙ্গে আলবার্টের বুদ্ধিমত্তার মস্ত ফারাক ছিল বটেই, তা বলে জুরিখে চলে এসে প্রথম আদানপ্রদানের মধ্যেই আলবার্টের তরফ থেকে চিঠি লেখালেখি বন্ধ করার প্রস্তাব খুবই নির্মম ঠেকে।

চলে আসার পর প্রথম কিছু দিন তো নিজের জামাকাপড়ও মারিকে ডাকে পাঠাত আলবার্ট।

সে-সব কেচে ডাকে ফেরত পাঠাত মারি। অথচ পোশাকের সঙ্গে একটু ধন্যবাদ জানিয়ে দু’লাইনও খুঁজে পায় না মেয়েটি।

আক্ষেপ করে লেখে: ‘‘চোখ চালিয়ে খুঁজে মরি তোমার হস্তাক্ষরে দু’একটি বাক্য। পাওয়ার মধ্যে পাই ওই হস্তাক্ষরে লেখা ঠিকানাটুকু।’’

এর পর আলবার্ট যখন লিখল ও আরাউ আসতে চায় মারি উত্তর পাঠাল, ‘‘তুমি আসতে চেয়েছ বলে অজস্র ধন্যবাদ। এখন থেকে প্রতিটি মুহূর্ত গুনব তোমার আসা অবধি। বর্ণনা করার চেষ্টাও করব না যে কী সুখে আছি যবে থেকে তুমি এ বাড়িতে পা রাখলে আর আমার হৃদয়ে প্রবেশ করলে, প্রিয়, আমি তোমাকে অনন্ত কালের জন্য ভালবাসি।’’

শেষ অবধি আলবার্ট কিন্তু আরাউ এল না। এবং আসবে যে না তা মারির মা’কে চিঠিতে জানাল। ‘‘ফের কিছু স্বর্গীয় সুখের দিনের জন্য গিয়ে বেচারি মেয়েটির দুঃখ আরও বাড়াব। নিজের দোষে ইতিমধ্যেই তো ওর অনেক ক্ষতি করেছি।’’

আলবার্টের জীবনে মিলেভা

কার কী দোষ কেউ জানে না, তবে সম্পর্ক ভেঙে যেতে মারি ভিন্টেলার স্নায়ুবৈকল্যে পড়ে অনেক দিন ইস্কুলে পড়াতে যেতে পারেনি।

আর ক’বছর পর ঘড়ির কারখানার ম্যানেজারকে বিয়ে করে ফেলল।

আলবার্ট সেই খবরে এমন এক নারীর আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপল যে সর্ব অর্থে মারির বিপরীত— রূপে গুণে মেধায় স্বভাবে বংশে গোত্রে। মিলেভা মারিচ।

মিলেভা মারিচ ছিলেন এক সার্বিয় পরিবারের প্রিয় প্রথম সন্তান। বাবা কৃষিকাজ ছেড়ে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। বিয়ে করেন এক মোটামুটি ধনী ঘরের মেয়েকে।

আর তার পর মিলেভার বিদ্যেবুদ্ধির বহর দেখে একাগ্র ভাবে চেষ্টা চালান মেয়েকে অঙ্ক ও পদার্থবিজ্ঞানের পুরুষ-প্রাধান্যের জগতে একটা কেউকেটা করে তুলতে।

মিলেভার সঙ্গে আইনস্টাইনের পরিচয় জুরিখ পলিটেকনিকে।

আইনস্টাইনের ক্লাসে একমাত্র মেয়ে তিনি। বয়সে তিন বছরেরও বড়।

তখনকার এক বান্ধবীর বর্ণনায় মিলেভা ছিলেন ‘‘খুবই সিরিয়াস এবং স্মার্ট। ছোট্টখাট্ট, নরমসরম, কালো চুলের, বেশ বাজে দেখতে।’’

কোমরের হাড়ের একটা সমস্য ছিল মিলেভার। শরীরে একটা যক্ষ্মাভাবও ছিল।

তা হলে কীসে মজেছিলেন আইনস্টাইন?

বলা যেতে পারে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যায় ওঁর ঘোর প্যাশনে। ওঁর স্বভাব চিন্তামগ্নতায়। আত্মিক সৌন্দর্যে। ওঁর গভীর দুই চোখ ও বেদনাহত মুখাবয়বে।

বন্ধুরা অবাকই হতেন আইনস্টাইনের মতো এত সুঠাম, সুদর্শন পুরুষ এত বেঁটেখাটো, পা টেনে হাঁটা, রুগ্ণ মহিলায় আকর্ষিত হল কেন?

আইনস্টাইন জবাবে বলেছিলেন, ‘‘কিন্তু কী সুন্দর কণ্ঠস্বর ওর!’’

তবে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মা পাউলিনে আইনস্টাইন। যিনি মারি ভিন্টেলারের দু’খানি চিঠি পড়ে পুত্রের প্রেমিকায় মজেছিলেন, তিনি মিলেভার ফটো দেখেই সম্পূর্ণ বিস্রস্ত।

আইনস্টাইন লিখেওছিলেন মিলেভাকে: ‘‘তোমার ছবি দেখে বুড়ি বেশ দমেই গেলেন। তখন সহাভূনুতির সুরে আমাকে বলতেই হল— হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর বুদ্ধিসুদ্ধি খুব।’’

মিলেভার সঙ্গে মেলামেশার মধ্যেও মারি ভিন্টেলারের স্মৃতি ফিরে এসেছে আইস্টাইনের।

শেষে যখন বোন মায়াকে আরাউয়ের ইস্কুলে ভর্তি করতে গেলেন তখন আশ্বস্ত করতে হল সঙ্গিনীকে। লিখলেন, ‘‘যে-মেয়েটির জন্য প্রেমে পাগল ছিলাম, চার বছর আগে, সে এখন আরাউয়ে বাপের বাড়িতে। তাই বোনের জন্য ঘন ঘন আরাউ যাওয়াটা হবে না।’’


এলসার সঙ্গে

প্রেম নিয়ে অশান্তি মায়ের সঙ্গে

১৯০০ সালের গ্রীষ্মের ছুটিতে লেক লুসেন-এর কাছে পাহাড়ি গ্রাম মেলখ্টাল পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে এলেন আইনস্টা‌ইন। বোন মায়া বলেছিল, মা’র সামনে মিলেভার নামোচ্চারণেও সাহসে কুলোয় না ওর। যদিও ওরই মধ্যে বাড়িতে কারও জানতে বাকি নেই যে আলবার্ট সোহাগ করে মিলেভার একটা ডাকনাম রেখেছে ‘ডলি’।

প্রথম বার মা’র ঘরে যেতে তিনি ছেলের পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করলেন। তার পর হঠাৎই, ‘‘তো এ বার তোমার ডলির কী হবে?’’

প্রায় মায়েরই নিরুদ্বিগ্ন স্বরেই পুত্র উত্তর দিল, ‘‘আমার স্ত্রী হবে।’’

তখন মা— পরে আইনস্টাইন স্মৃতিচারণা করছেন— ‘‘খাটের ওপর ছিটকে পড়ে, মুখে বালিশ চাপা দিয়ে, শিশুর মতো কেঁদেছিলেন।’’

তার পর নিজেকে একটু সামলে ফের বলতে শুরু করেছিলেন, ‘‘তুই তোর ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিচ্ছিস। কোনও ভদ্র পরিবার ওকে মেনে নেবে না। এর পর ও যদি অন্তঃসত্ত্বা হয়, তো সোনায় সোহাগা।’’

এই কথায় পুত্রও এ বার মেজাজ হারাল। বলল, ‘‘এ সব কথা তোমার মুখে শোভা পায় না। কারণ আমরা কোনও পাপে লিপ্ত নই।’’

মিলেভাকে নিয়ে মায়ে-পোয়ে বিবাদের এই সবে শুরু।

এও বলছেন মা: ‘‘ও কি একটা বউ হবার নাকি? ও তো একটা বই! আর অন্য এক সময় মনে করিয়েছিলেন: ‘‘তোর বয়স একুশ, আর ওর চব্বিশ। তো তোর যখন তিরিশ হবে ও তো বুড়ি ধামড়ি। সেটা ভেবেছিস?’’

এই টানাপড়েন চলেছিল আলবার্ট-মিলেভার বিয়ে অবধি।

যেটা লক্ষণীয় তা হল, যে-নবীন যুবা প্রায় কোনও স্পষ্ট কারণ ছাড়াই প্রথম প্রেমিকার থেকে সরে এসেছিল, সে-ই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবার মতামত উপেক্ষা করে স্বমনোনীতার পাশে দাঁড়াল বিবাহলগ্ন অবধি।

কুমারী প্রেমিকা গর্ভবতী

আমরা আরেকটু চলে যাই আলবার্ট-মিলেভার প্রণয়-পরিস্থিতিতে।

আইনস্টাইনের জীবনের যা এক দুঃসহ সময়ই বলা যায়।

বের্ন শহরের যে-পেটেন্ট অফিসে কাজ করতে করতে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করে বিশ্বে আলোড়ন তুললেন সেই চাকরি তখনও দূর-অস্ত।

জুরিখের কুড়ি মাইল উত্তরে, রাইন নদীর ধারঘেঁষা শাফহাউসেন গ্রামের ইস্কুলে মাস্টারি করছেন।

ইস্কুলে মাস্টারিটা নামমাত্র, আসলে দেড়শ’ সুইস ফ্র্যাঙ্কে এক বড়লোক ইংরেজ বালকের প্রাইভেট টিউশানি করে সময় যাচ্ছিল, ফলে ইচ্ছে থাকলেও মিলেভার থাকা হচ্ছিল না আলবার্টের সঙ্গে।

বছরটা, মনে রাখা দরকার, ১৯০১।

১৯০২-এর ফেব্রুয়ারিতে কিন্তু ওদের কন্যা লিজের্ল-এর জন্ম হচ্ছে। বিয়ে হয়নি, এবং সঙ্গতিও নেই সংসার পাতার, তাই মিলেভাকে সন্তান প্রসবের জন্য চলে যেতে হল নোভি সাদ-এ বাপের বাড়িতে।

কন্যার আসন্ন জন্মে খুবই স্ফূর্তি আইনস্টাইনের, সঙ্গে দুটি গভীর আশঙ্কা। বের্ন-এর পেটেন্ট অফিসের চাকরিটা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে না করে সেখানে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে থাকা সমস্যা। মেয়েটিকে জারজ ধরে নেওয়া হবে।

দ্বিতীয় আশঙ্কা আরও সাঙ্ঘাতিক। মা’র ভয়ঙ্করতম ভয় যে ছেলে বাচ্চার বাবা হয়ে বিয়ের ফাঁদে পড়বে। তাও যেন তলে তলে ঘনিয়ে উঠছে।

কন্যা চিরকালই অপরিচিতা

বোন মায়ার একটা সন্দেহ ছিলই যে দাদা বিয়ে করতে চলেছে, আর সে-কথাটা ও আরাউয়ের ভিন্টেলার পরিবারকে জানিয়েওছিল।

সেই খবর আলবার্টের প্রথম প্রেমিকার মায়ের কাছ থেকে জানতে পারেন আইনস্টাইনের মা।

তিনি শ্রীমতী ভিন্টেলারের কাছে কষ্টের সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলেন: আলবার্টের সঙ্গে কুমারী মারিচের সম্পর্ক আমাদের একেবারেই বরদাস্ত নয়। মেয়েটির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক কোনও দিনই রাখতে চাই না আমরা।’’

তাঁদের মেয়ের সঙ্গে নিজেদের ছেলের বিয়েতে যে মত নেই তা জানিয়ে আলবার্টের মা ও বাবা একাটা রাগী চিঠিও পাঠান মারিচ দম্পতিকে।

তাতে মিলেভা ওর এক বান্ধবীকে লিখেছিল, ‘‘এই মহিলা (আইনস্টাইনের মা) ওঁর জীবনের লক্ষ্যই করেছেন আমার এবং ওঁর ছেলের জীবন যতখানি সম্ভব তিক্ত করে তোলা। এমন একটা হৃদয়হীন শয়তান যে থাকতে পারে এ আমার ধারণার অতীত ছিল। আমরা মা-বাবাকে চিঠি লিখেও আমাকে নিয়ে অকথ্য নোংরা কথা বলল!’’

কন্যা লিজের্ল-এর কথা আলবার্ট মা, বাবা, বোন বা বন্ধুবান্ধবদের কখনও জানতে দেয়নি, ফলে বিজ্ঞানীর জীবনে ও এক অচেনা, অজানা মানুষই থেকে গেছেন চিরকাল।

আইনস্টাইনের কোনও কথায় বা চিঠিপত্রেও ওর কোনও উল্লেখ নেই। বস্তুত, ও যে আদৌ ছিল এই তথ্যটাই পণ্ডিতরা বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেন নানা কাগজপত্র ঘেঁটে ১৯৮৬-তে!

মৃত্যুকালে বিয়েতে বাবার সম্মতি

১৯০২-এর ১৬ জুন বের্ন-এর পেটেন্ট অফিসে চাকরি হল আলবার্টের। কিন্তু বাবা হের্মান আইনস্টাইনের কপালে ছিল না আর তিন বছরের মধ্যে ছেলের যুগান্তকারী আবিষ্কারের বার্তা শোনা বা ওর জগৎজোড়া খ্যাতি দেখা।

ওই বছর অক্টোবরে ওঁর তখনকার নিবাস মিলানেই উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আলবার্ট পৌঁছেছিলেন ওঁকে শেষ দেখা দেখতে।

অন্তিম মুহূর্তে উনি সবাইকে বলেন, ওকে একলা রেখে যেতে, ‘‘কারণ আমি একা একাই মরতে চাই।’’

এই শেষ মুহূর্তটা সারা জীবন পীড়া দিয়েছে আইনস্টাইনকে।

বলেছেন, ‘‘এ আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন ধাক্কা।’’

তবে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবার আগে ছেলের সঙ্গে বাক্যবিনিময় কালে আলবার্ট ও মিলেভার বিয়েতে, অবশেষে, সম্মতি দিয়ে যান।

এইটুকুরই হয়তো অপেক্ষায় ছিলেন আইনস্টাইন। আর তিন মাসের মধ্যেই— ৬ জানুয়ারি ১৯০৩— বের্ন-এর রেজিস্ট্রি অফিসে হাতে গোনা কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে এক অতি নিভৃত আইনি-বিয়ে সারলেন বিজ্ঞানী। বর-কনে কারও বাড়িরই কেউ সেখানে নেই।

সই শেষে বন্ধুদের খাওয়াতে নিয়ে গেলেন এক রেস্তোরাঁয়। তার পর অধিক রাতে বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরে প্রফেসর আবিষ্কার করলেন যে, বাড়ির চাবি নেই পকেটে।

স্ত্রীর পরকীয়া

এত সাধ্য সাধনা করেই যে-বিয়ে তা দেখতে, না-দেখতে এত ছায়াঘন হয়ে উঠল কী করে ভেবে অবাক হতে হয়।

বিজ্ঞানীকে তো ডুবতেই হচ্ছিল আরও আরও কাজ ও গবেষণায়, কিন্তু গৃহিণীও শোনাতে শুরু করলেন, ‘‘গৃহকর্মের ঝকমারি আমার বারোটা বাজাচ্ছে।’’

ক্রমশ মিতবাক এবং ঝিম মেজাজের মানুষ হয়ে উঠেছিলেন মিলেভা, ফলে কাজে মগ্ন স্বামীর পক্ষে একটু কম নির্ভরযোগ্যই।

দাম্পত্যের শুরু থেকেই এই স্বার্থপরতা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছিলেন আইনস্টাইন।

বলেওছেন যে এক সময় মিলেভাকে বিয়ের ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে একটা প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল। যা তিনি পেরিয়ে ওঠেন একটা ‘দায়িত্ববোধ’ থেকে।

স্বামী কত বড় কাজের মধ্যে ডুবে আছেন, এটা না বোঝার মতো বুদ্ধি অভাব মিলেভার অন্তত ছিল না।

অথচ দাম্পত্য এমনই অদ্ভুত সম্পর্ক, তাতে কে যে কী হয় বিধির লিখনে, বোঝা দায়। আইনস্টাইন-মিলেভার সমীকরণ দ্রুত গড়িয়ে পড়তে লাগল পাক খেতে খেতে। আইনস্টাইন ব্যক্তিগত বেদনার থেকে অব্যাহতি পেতে আরও বেশি একাকী ও মগ্ন হতে থাকলেন।

আইনস্টাইন দম্পতি যখন বার্লিনে উঠে এসেছেন, মিলেভা এক নতুন সম্পর্কে কিছুটা জড়িয়েছেন জাগ্রেব শহরের অঙ্কের অধ্যাপক ভ্লাদিমির ভারিচাক-এর সঙ্গে।

আইনস্টাইন সেটা জানতেন এবং মন্তব্য করেছিলেন: ‘‘ওর একটা সম্পর্ক হয়েছিল আমার স্ত্রীর সঙ্গে, যা নিয়ে দু’জনের কাউকে দোষী করতে চাই না। অথচ তা আমার নিঃসঙ্গতাকে দ্বিগুণ বেদনাদায়ক করে তুলেছিল।’’

শিশুর মতো কান্না আলবার্টের

১৯১৪-র জুলাইয়ে বিয়েটা ভাঙল।

বিবাদের তুঙ্গে মিলেভা ওঁদের দুই বালকপুত্রকে নিয়ে রসায়নবিদ ফ্রিৎজ হাবের-এর বাড়িতে উঠলেন।

হাবের নিজেও তখন ঘোর অশান্তিতে, কিছুকাল হল ওঁর স্ত্রী আত্মহত্যা করেছেন। আইনস্টাইনের শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুও তিনি। গোটা বার্লিনে মিলেভার একমাত্র বন্ধু বলতে তিনি।

আইনস্টাইন-মিলেভার সম্পর্কে জোড়াতালি দিতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি হাবের।

আইনস্টাইন স্ত্রী’র ফিরে আসায় সম্মত হলেন, আশ্চর্যভাবে কঠিন শর্ত লিখিত ভাবে ধরিয়ে।

সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ রচনার শেষ মুহূর্তগুলোয় নিজের নির্জনতা ও প্রশান্তি বজায় রাখার জন্য অসাধারণ সেই শর্ত মিলেভাও মেনে নিলেন।

শর্তাবলি এ রকম—

ক. তোমায় নিশ্চিত করতে হবে যে,

১. আমার কাপড়চোপড় কাচা, পরিচ্ছন্ন ও গোছানো থাকবে

২. আমার ঘরে দিনে তিন বার খাওয়া পরিবেশন হবে

৩. আমার শোবার ঘর ও পড়ার ঘর পরিচ্ছন্ন থাকবে, বিশেষ করে আমার কাজের টেবল শুধু আমার কাজের জন্যই তৈরি থাকবে

খ. আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক তুমি পরিহার করবে, কেবল সামাজিক ভাবে যেটুকু যা দরকার তা বাদে। বিশেষ করে তোমায় ছাড়তে হবে—

১. বাড়িতে আমার পাশে বসে সময় কাটানো

২. আমার সঙ্গে তোমার বেড়াতে বেরনো

গ. আমাদের সম্পর্কে এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে—

১. আমার থেকে কোনও অন্তরঙ্গ ব্যবহার আশা করবে না, কোনও বকাঝকা, শাসানি চলবে না

২. আমি অনুরোধ করলে আমার সঙ্গে কথা বন্ধ রাখবে

৩. আমি চাইলে আমার পড়ার বা শোবার ঘর ত্যাগ করবে

ঘ. কথা দেবে যে আমাদের সন্তানদের সামনে আমায় কথায় বা ব্যবহারে ছোট করবে না

সম্পর্কহানির এর চেয়ে জোরালো ছবি আর কী হতে পারে!

জীবনের শেষ দিকে, লিও টলস্টয় ও স্ত্রী সোফিয়া আন্দ্রেয়েভনার সম্পর্কের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই দাম্পত্য।

বোঝাপড়া করাতে গিয়ে ফ্রিৎজ হাবের টের পেয়েছিলেন যে একটা সময় পাগলের মতো মিলেভাকে ভালবেসেছিলেন আইনস্টাইন, যা সম্পূর্ণ উবে গেছে। তা বলতে বলতে শিশুর মতো কেঁদেছিলেন আইনস্টাইন।

এর পর বিবাহ বিচ্ছেদটা সম্পন্ন হতে শুধু সময়ের অপেক্ষা!

নোবেলের অর্থ ও মিলেভা

১৯০৫ সালে ওঁর বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ হতে সবারই ধারণায় ছিল যে আইনস্টাইন আজ হোক, কাল হোক, পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেনই।

১৯১৫-য় ওঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বিদ্বৎসভায় আসতে বিশ্ব জুড়ে এক তুমুল উন্মাদনা মনীষীকে নিয়ে। তবু কেন যে ওঁকে নোবেল প্রাইজ দিতে কমিটিকে ১৯২২ সাল অবধি অপেক্ষা করতে হল তা এক অতি আমোদকর বৃত্তান্ত। আপাতত তাতে যাচ্ছি না।

কখনও না কখনও নোবেল আসছে জেনেই আইনস্টাইন বিচ্ছেদ চুক্তিতে জানিয়ে রেখেছিলেন যে পুরস্কার পেলে তার অর্থমূল্য যাবে মিলেভা মারিচের হাতে।

সেই মতো ৩২,২৫০ মার্কিন ডলারের পুরস্কার অর্থ (তৎকালে অধ্যাপকদের বাৎসরিক আয়ের দশগুণ) জুরিখে ও আমেরিকার দুটি অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে মিলেভা ও ওদের পুত্রদের নামে।

মিলেভা তা দিয়ে তিনটে বা়ড়ি কিনেছিলেন জুরিখে।

খুড়তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম, সহবাস

১৯১২-য় বিখ্যাত আইনস্টাইন ও তাঁর বিজ্ঞানবিদুষী স্ত্রী মিলেভা বসবাস করছেন প্রাগ শহরে।

বরকে দেশে দেশে ঘুরে তখন বক্তৃতা করতে হচ্ছে আপেক্ষিকতা, মাধ্যাকর্ষণ, সৃষ্টিরহস্য নিয়ে।

মিলেভা কিন্তু বিজ্ঞানী মহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে একটা মনমরা ভাব নিয়ে বাড়ি বসে থাকা ধরছেন।

এক কালে যে-বউ বরের কাজে সাহায্যের জন্য জটিল জটিল গাণিতিক ফলাফল তৈরি করে দিতেন তিনিই তাঁর যুগান্তকারী বক্তৃতা সফর থেকে দূরে দূরে থাকছেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেকার আকর্ষণে ভাটা পড়েছে।

সম্পর্কের এই কঠিন সময়ে ইস্টারের ছুটি কাটাতে এসে আইনস্টাইনের নতুন করে দেখা হল তিন বছরের বড় খুড়তুতো দিদি এলসার সঙ্গে।

ছেলেবেলায় ওদের মিউনিখের বাড়িতে খেলাধুলো করেছে ওরা। এক বার দু’জনে অপেরা দেখতে গিয়েছিল।

তার পর তো এক সুইস ব্যবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে লোয়েন্থাল হল। দু-দুটি ছেলেমেয়ে হল। তারপর এক সময় সে-বিয়ে ভেঙেও গেল।

আলবার্টের সঙ্গে ফের দেখা যাচ্ছে যখন , ওঁর বয়স তখন ছত্রিশ।

বাস্তবিকই এক নতুন সঙ্গিনীর খোঁজে ছিলেন আলবার্ট।

প্রথম প্রথম এলসার বোন পাউলার সঙ্গে মেলামেশা শুরু হয়েছিল।

পরে মনে হয়েছিল যে-ধরনের সঙ্গ ও স্বাচ্ছন্দ্যের খোঁজে ওঁর মন, তা এলসার কাছ থেকেই পাওয়ার।

মিলেভা মারিচের থেকে এলসা (উনি তখন লোয়েন্থাল পদবি আর লিখছেন না) একেবারে উল্টো মেরুর মানুষ।

মিলেভা মেধাবী ও জটিল।

এলসা সুন্দরী ও ঘরোয়া।

খুড়তুতো ভাই আলবার্টের সঙ্গে মুখের অনেক মিল।

প্রাগে ফিরে গিয়ে আইনস্টাইন ওঁকে লিখেছিলেন, ‘‘কাউকে একটা ভালবাসতে হচ্ছিলই আমার, না হলে জীবন দুর্বিষহ হত। আর সেই কেউ একটা হলে তুমি।’’

তবে একেবারে বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসাতেও সঙ্কোচ ছিল আইনস্টাইনের।

এলসাকে চিঠি লেখালেখিও বন্ধ করেছিলেন। উত্তরোত্তর ডুবে যাচ্ছিলেন গভীর গবেষণায়।

মিলেভা ওঁর এক বন্ধুকে লিখেছেন তখন, ‘‘ও ওর বিজ্ঞানের সমস্যা নিয়ে সারাদিন পরিশ্রম করে। ওই তত্ত্বতল্লাশের জন্যই ওঁর বাঁচা। একটা কথা লজ্জার সঙ্গেই মেনে নিচ্ছি আমরা ওর কাছে গৌণ।’’

প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হতেই আইনস্টাইন ও মিলেভা মারিচের বিবাহ বিচ্ছেদ মামলা কোর্টে উঠল।

২৩ ডিসেম্বর, ১৯১৮, বার্লিনের আদালতে দাঁড়িয়ে জগতের সেরা বিজ্ঞানী কবুল করলেন, ‘‘আমি গত সাড়ে চার বছর আমার বিধবা খুড়তুতো বোন এলসা আইনস্টাইনের সঙ্গে সহবাস করেছি।’’

এ বার বিয়ে বোনকে

এর চার মাস পর এলসাকে বিয়ে করলেন আইনস্টাইন।

আইনস্টাইনের নতুন বিয়ে একেবারে ভিন্ন ছিল প্রথম বিয়ের থেকে। ভয়ানক প্যাশনেট বা রোম্যান্টিক নয়।

‘‘আপেক্ষিকতা বোঝাটা’’, এলসা বলতেন, ‘‘আমার সুখী হওয়ার পক্ষে জরুরি নয়।’’

কতকগুলো বিষয়ে আবার দিব্যি চোস্ত ছিলেন মহিলা। চমৎকার ফরাসি ও ইংরেজি বলতেন, তাতে বিদেশ সফরে স্বামীর ম্যানেজার ও দোভাষীর কাজ চালিয়ে নিতেন।

বলতেনও, ‘‘বউ এবং মা হিসেবেই আমার যত-যা ট্যালেন্ট। অঙ্কে আমার উৎসাহ সংসারের খাইখরচার হিসেব রাখা অবধি।’’

বরের বাক্সপত্র গোছগাছ করা, পকেট খরচ এগিয়ে দেওয়া, কী খাবেন, না-খাবেন দেখভাল করা, ওঁর প্রবল খ্যাতিকে সমাদর করা, সেই খ্যাতির দাপট থেকে ওঁকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলা, এ সবই আদত হয়েছিল এলসার।

ওঁকে উল্লেখ করতেন কখনও ‘প্রফেসর’, কখনও শুধু ‘আইনস্টাইন’।

বার্লিনের বাড়িতে তিনটে চিলেকোঠাকে মিলিয়ে বরের পড়ার ঘর করে দিয়েছিলেন গিন্নি।

সেখানে একটা বড় জানলা বসিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে ধুলো ঝাড়া হত বইপত্র, কাগজের।

কিন্তু কাগজ, বই যা যেখানে থাকার সেখানেই থাকত। একটা পুরনো আরামকেদারায় ভাবাভাবি করতেন আইনস্টাইন।

তার পর হঠাৎ-হঠাৎ উঠে কাগজ কলম নিয়ে বিশ্বের রহস্যমোচনে ব্যস্ত হতেন।

ওঁর মাথার ওপরে— দেওয়ালে— শোভা পেত তিনটি ছবি।

নিউটন। ম্যাক্সওয়েল। ফ্যারাডে।

ওই তিন প্রতিকৃতি ও রক্তমাংসের আইনস্টাইনকে নিয়ে মহামঞ্চ ওই ঘর তখন।

(১৯১৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইনের ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ প্রকাশিত হয়। তারই শতবর্ষে এই লেখা)

ঋণ: আইনস্টাইন: হিজ্ লাইফ অ্যান্ড ইউনিভার্স
(লেখক: ওয়াল্টার আইজ্যাকসন)

অন্য বিষয়গুলি:

Albert Einstein
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE