শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়
বছরটা ১৯৬৯। কলকাতায় রাজ কপূরের আগমন উপলক্ষে পাঁচ তারা হোটেলে পার্টি দিয়েছিলেন বাংলা ছবির প্রযোজক হেমেন গঙ্গোপাধ্যায়। সেই পার্টিতে রাশিয়ান ব্যালে শিল্পী রাবিনকিনার সঙ্গে আলাপ হয় বাংলা ছবির অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের। তখন সদ্য শেষ হয়েছে রাজ কপূরের ‘মেরা নাম জোকার’-এর শ্যুটিং। ওই ছবিতে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে রাবিন ও সিমি গ্রেওয়াল পরস্পরের ভাল বন্ধু হয়ে যান। প্রিয় বন্ধুর কাছে শুভেন্দুকে ভাল লাগার কথা বলেন রাবিন। আর সেই কথা সিমি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিং ফ্লোরে সর্বসমক্ষে শুভেন্দুকে এসে জানান। সেই সময় উপস্থিত ছিলেন এই ছবির পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও। সিমির কথা শুনে শুভেন্দু তো লজ্জায় লাল। কথাটা শুধু বলেই থেমে গেলেন না সিমি। রাবিনের একটি ছবিও শুভেন্দুকে দিলেন। যে ছবিটির পিছনে রাবিন নিজে লিখে দিয়েছিলেন, ‘টু শুভেন্দু , টু অল মাই হার্ট’। ব্যাপারটা দেখে উপস্থিত সকলে হেসে উঠলেন। কালো কাপড়ে মোড়া ক্যামেরার লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘তা হলে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পাঠাই, কী বলো শুভেন্দু?’’ বাড়িতে এসে শুভেন্দু তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘তুমি আমাকে যতটা ফেলনা ভাবো, আমি কিন্তু ততটা নই।’’ শুভেন্দুগিন্নি ব্যাপারটা শুনে বেজায় হেসেছিলেন। বাংলা ছবির ইতিহাসে কোনও দিনই ফেলনা ছিলেন না শুভেন্দু চট্টোপাধ্যয়। বরং তিনি বাংলা ছবির ইতিহাসে এক শক্তিশালী পিলার। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরেও বাঙালি দর্শকদের কাছে তিনি আজও অনন্য।
অভিনেতা শুভেন্দু, পিতা শুভেন্দু, মানুষ শুভেন্দুকে নিয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ‘‘গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’ বাবার শেষ ছবি। এই ছবিটির জন্য তিনি জাপান গিয়েছিলেন। ফিরে আসার পর থেকেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্বাসকষ্ট হতো। একটা সময় বাবা প্রচণ্ড ধূমপান করতেন। যখন আমি সদ্য সিগারেট খেতে শিখেছি, বাবার পকেট থেকে সিগারেট চুরি করছি। বাবা একদিন বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি, ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে রাখলে নিজেকে উত্তমকুমার মনে হয়। ওটা ঝুলিয়েই রাখিস, টানিস না’!’’ হেসে ফেললেন শাশ্বত। কখনও চায়ে চুমুক দিতে দিতে, কখনও সোফায় কুশন জড়িয়ে বসে, কখনও বাবার কণ্ঠস্বর নকল করে স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। বাবার প্রসঙ্গে কথা বলতে হবে জানার পরই প্রতিবেদককে তিনি বলেছিলেন,‘‘হাতে কিন্তু অনেকটা সময় নিয়ে আসবেন।’’ কথাটা ষোলো আনাই সত্যি হল!
অভিনয়ের টানে...
ভাল ছাত্র ছিলেন শুভেন্দু, তাঁর প্রিয় বিষয় ছিল সাহিত্য, ভালবাসতেন পাহাড় সম্পর্কে বই পড়তে। আর ছিল অভিধান পড়ার শখ! শব্দের উচ্চারণ নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল প্রবল। একটু-আধটু কবিতা লিখতেন, কখনও বা গদ্য। কিন্তু ঠাকুরদা ডাক্তার ছিলেন বলে বাবার ইচ্ছেয় শুভেন্দুকে ডাক্তারি পড়তে হল। কিছু দিন পুরসভার হাসপাতালে চাকরি করে পেশায় ইতি টানেন তিনি। অবশ্য ইতি টানার বীজ বপন হয়েছিল সেই কোন স্কুলে পড়ার সময়ই! কেননা শ্রীরঙ্গমে শিশির ভাদুড়ীর ‘মাইকেল মধুসূদন’ নাটকটি দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন। অভিনয় করার ইচ্ছে সঞ্চারিত হয় হৃদয়ে। ডাক্তারি পড়তে পড়তেই আইপিটিএ –তে যোগ দেন। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যাকে তিনি গুরু মানতেন। সাল ১৯৬৫, আইপিটিএ-এর মঞ্চে তাঁকে দেখে পরিচালক মৃণাল সেন চিন্তা করেন তাঁর ছবি ‘আকাশকুসুম’-এর জন্য। ‘আকাশকুসুম’ মুক্তি পাওয়ার পর পরিচালকদের নজরে পড়েন শুভেন্দু। সে তালিকায় ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। তাঁকে দেখে সিগারেট এগিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরায়। এই ঘটনা প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে শুভেন্দু বলেছিলেন, ‘‘এই প্রথম কারও সামনে সিগারেট ধরানোর জন্য মাথা নিচু করতে হল না!’’ ডেবিউ ছবির পরেই সুযোগ এল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে। তার পরের বছর ‘হংসমিথুন’ ও ‘চৌরঙ্গী’। অরূপ গুহর ‘পঞ্চশর’ ছবিটির জন্য ফ্রাঙ্কফুর্ট ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলেন শুভেন্দু। উৎসব শেষ হওয়ার পর আরও কিছু দিন থেকে তিনি জায়গাটা ভাল করে ঘুরে দেখতে চাইছিলেন। ইচ্ছের বাধা হয়ে দাঁড়াল ‘চৌরঙ্গী’র শ্যুটিং শেডিউল। তিনি ফোন করেলেন উত্তমকুমারকে। প্রোডিউসারকে বলে শ্যুটিংয়ের ডেট শুধু মাত্র শুভেন্দুর জন্যই পিছিয়েছিলেন উত্তমকুমার! সেই থেকে অজান্তেই উত্তমকুমার হয়ে ওঠেন শুভেন্দুর ‘দাদা’।
উত্তমকুমারের সঙ্গে
ছেলের সঙ্গে ‘A’ মার্কা ছবি দেখা...
‘‘বাবা যখন টপ ফর্মে, আমি তখন বেশ ছোট। আমাদের বাড়ি ছিল রাজা বসন্ত রায় রোড়ে। তার কিছু দূরেই ছিল আমার দাদামশাইয়ের বাড়ি। শনি-রবিবার হলেই আমি দাদুর বাড়ি চলে যেতাম। কারণ বাবা সাইকেল চালাতে দিতেন না। অন্য দিকে দাদুর বাড়ি এ সবের জন্য স্বর্গভূমি! ছোটবেলায় জন্মদিনে বাবা আমাকে যে সব বই উপহার দিতেন, তা মোটেও পছন্দ হত না। তিনি একটা বাচ্চা ছেলেকে উপহার দিচ্ছেন ‘আইভ্যানহো’, ‘টেকনোলজি অব ম্যানকাইন্ড’... যা তখন আমার কাছে অবোধ্য ছিল। অবশ্য কখনও সখনও এই সব মোটা বইয়ের সঙ্গে ‘ফেলুদা’র মতো বইও দিতেন। এক-এক বছর দাদামশাই মা, মামা, পরিবারের সকলকে নিয়ে পুরী বেড়াতে যেতেন। বাবা আমাদের সঙ্গে যেতে পারতেন না, পরে শ্যুটিং শেষ করে এসে আমাদের সঙ্গে জয়েন করতেন। বাবা অন্যান্য ব্যাপারে বেশ কড়া হলেও সিনেমা দেখার ব্যাপারে ছিলেন অসম্ভব উদার। মনে আছে, ১৯৭৯-তে ‘ক্র্যামার ভার্সেস ক্র্যামার’ রিলিজ হওয়ার পর বাবা আমাকে গ্লোব সিনেমা হলে নিয়ে গিয়েছিলেন দেখাতে। ছবিটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। ব্যাপারটা জানতে পেরে মা ভীষণ রেগে গিয়ে বলেছিলেন, ‘পোস্টারে বড় বড় করে ‘এ’ লেখা আছে, আর সেই ছবি কিনা বাচ্চা ছেলেকে দেখাবে?’ উত্তরে বাবা বলেছিলেন, ‘ভাল ছবি দেখা উচিত।’ জানেন, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ রুকুর চরিত্রটা আমার করার কথা ছিল। বাবার কাছে মানিকজেঠুর প্রস্তাব শুনে মা ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন। মা মনে করেছিলেন, সিনেমা করলে আর পড়াশোনা হবে না। তাই আমার চুল এমন ভাবে কেটে দেন যে, তা দেখে বাবার মাথায় হাত! তুমুল ঝগড়া হল বাবা-মা’র। পরের দিন মানিকজেঠুর বাড়িতে কাঁচুমাচু মুখ করে বাবা আমাকে নিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে মানিকজেঠু বলেছিল, ‘একেবারে বাটি ছাঁট দিয়ে দিয়েছ শুভেন্দু! আমার হাতে তো আর সময় নেই।’ এই রকম কত শৈশবস্মৃতি আছে।’’
শূন্যর জন্য গ্র্যান্ড-এ ট্রিট...
‘‘বরারবই আমি পড়াশোনায় ফাঁকিবাজ। একবার হোমওয়র্কে পেলাম শূন্য। মা তো বাড়ি মাথায় করলেন। বাবার কানে ব্যাপারটা যেতে, গম্ভীর ভাবে তিনি বললেন, ‘তোমার মা রত্নগর্ভা। আমি তোমার জন্য গর্ববোধ করি। হোমওয়ার্কে কেউ জিরো পায়, আজ অবধি শুনিনি! একে-ওকে জিজ্ঞেস করেও তো লিখে দিলে পারতিস। সেটুকু চেষ্টাও করিসনি!’ তার পর কী হল জানেন? জিরো পাওয়ার সৌজন্যে বাবা আমাকে গ্র্যান্ড হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন! তখন বলেছিলেন, ‘এই যে চৌরঙ্গী-চৌরঙ্গী শুনিস, এই দ্যাখ সেই শাজাহান হোটেল!’ বড় অদ্ভুত ছিলেন বাবা! বাবা-ই কিন্তু শিখিয়েছিলেন ভগবান দুটো কান দিয়েছেন, একটা শোনার জন্য অন্যটা বের করে দেওয়ার জন্য। বাবার এই শিক্ষা প্রয়োজনে বাবার উপরেই প্রয়োগ করেছি! প্রতিদিন কাজ শেষ করে বাবা বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই মা আমার সম্পর্কে ওঁকে অভিযোগ করতেন। লুকিয়ে দেখতাম, বাবা শুনছেন, কিন্তু কোনও উত্তর করছেন না। এমন ভাব যেন, তিনি ঘরে নেই। মা কিন্তু বলে যাচ্ছেন। ফ্রেশ হয়ে বাবা ছাদে চলে যেতেন এবং রেডিয়োয় গান শুনতেন। আর সেই সময় তিনি আমাকে ডাকতেন। ধীরে সুস্থে বোঝাতেন, জীবনদর্শন নিয়ে কথা বলতেন। তখন আমি বাবার শেখানো অস্ত্রটাই প্রয়োগ করতাম। বাবার কথার চেয়ে রেডিয়োর গান আমার কানে বেশি ঢুকত।’’ সিনেমার মতো স্মৃতির দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতেই যেন সরল হািস ফুটে উঠছিল শাশ্বতর মুখে।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র শ্যুটিংয়ে
ডাক্তারবাবু...
‘বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা’ ছবিটির শ্যুটিংয়ের সময় গঙ্গোত্রী থেকে যমুনোত্রী পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা হেঁটে যেতে হয়েছিল শুভেন্দু ও পুরো শ্যুটিং ইউনিটকে। সেই সময় বহু পাহাড়ি মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। অনেকেই তাঁর কাছ থেকে ওষুধ নিতেন। তাঁদের কাছে তখন তিনি অভিনেতা নন, ডাক্তারবাবু হিসেবেই পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু একটা সময় তাঁর ওষুধের ভাণ্ডার শেষ হয়ে আসে। এ দিকে তখনও শ্যুটিং শেষ হয়নি। এমনই একদিন এক বুড়ো তাঁর কাছে ওষুধ নিতে এলেন। বুড়োর পায়ে ছেঁড়া ব্যান্ডেজ খুলে আঁতকে উঠলেন শুভেন্দু! এ তো পা কেটে বাদ দিতে হবে! কিন্তু সে সময় তা সম্ভব নয়। তিনি ক্ষত পরিষ্কার করে সালফাডায়জিন ট্যাবলেট গুঁড়ো করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তাঁর মনে আরোগ্য নিয়ে সন্দেহ ছিল। শ্যুটিং শেষ করে ফেরার পথে দেখলেন সেই বুড়ো দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে একবাটি ছাগলের দুধ। বুড়োর পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ ঠিক হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারবাবুকে দেওয়ার মতো পয়সা নেই, তাই বুড়ো ছাগলের দুধ এনেছেন। শুভেন্দু সে দুধ খেয়েছিলেন। ‘বহুরূপী’ ছবির শ্যুটিংয়ের পর মেকআপ তুলবেন বলে স্পিরিট চেয়েছিলেন সহকারীর কাছে। কিন্তু স্পিরিট মুখে লাগাতেই কটু গন্ধে শুভেন্দু প্রায় বমি করে ফেলেন! রেগে গিয়ে সহকারীকে ডেকে ওই স্পিরিট শুঁকিয়ে শুভেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এটা কী?’’ তিনি বলেন, ‘‘কেন, ঠিকই তো আছে।’’ উত্তর শুনে আরও রেগে শুভেন্দু বলেছিলেন ‘‘দেখুন, ডাক্তারি পাশ আমি এমনি এমনি করিনি। আমাকে রেকটিফায়েড স্পিরিট চেনাচ্ছেন?’’ আসলে ওটা ছিল বাংলা মদ!
‘চিড়িয়াখানা’র শ্যুটিংয়ের সময় একদিন ফ্লোরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তমকুমার। শুভেন্দু বুঝতে পারেন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, কিন্তু তিনি সেটা উত্তমকুমারকে না বলে প্রাথমিক ওষুধ খাইয়ে ডাক্তার সুনীল সেনকে ডেকেছিলেন। শোনা যায়, তার পর থেকে অসুস্থ হলেই শুভেন্দুর মতামতের উপর ভারী ভরসা করতেন উত্তমকুমার। ‘‘আমি একবারই চোখের সামনে বাবাকে দেখেছিলাম ডাক্তারি করতে। তখন আমার ভাই কোলের শিশু। ঝিনুক দিয়ে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন ঠাকুমা। বেকায়দায় দুধ ওর শ্বাসনালীতে ঢুকে যায়। দম বন্ধ হয়ে নীল হয়ে যায় ভাই। বাবা দৌড়ে এসে ভাইকে থাবড়ে, প্রেশার দিয়ে দুধ বার করেন। বাবা কিন্তু ঠাকুমাকে কিচ্ছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, ‘কাল থেকে এ বাড়িতে ঝিনুক বন্ধ। ফিডিং বটলে খাওয়াবে। আরে, খিদে পেলে কুকুরের বাচ্চাও কেড়ে খায়। এ তো মানুষের বাচ্চা! বলতে পারবে, বোঝাতে পারবে।’ পিনড্রপ সায়লেন্স।’’ কথাটা বলে একটু থেমে আবার বলতে শুরু করেন শাশ্বত,
‘‘বাবা প্রফেশনালি ডাক্তারিটা করেননি ঠিকই, তবে পুরোদস্তুর ডাক্তারিটা জীবনেও ঝেড়ে ফেলতে পারেননি। একদিন খবর এল, বুম্বাদা (প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ফ্লোরে অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন। বাবা খবরটা শুনেই আমাকে বললেন, ‘চল, বুম্বাকে ঝেড়ে আসি।’ বুম্বাদা চুপচাপ শান্ত ছেলেটি হয়ে বাবার উপদেশ শুনলেন। বাবা এমনই। একটা মাত্র সংজ্ঞায় বোঝানো মুশকিল।’’
অভিভাবকের ভূমিকায়
‘‘১৯৭৯-তে বন্যাত্রােণর ফান্ড তোলার জন্য ইডেনে হয়েছিল বলিউডের তারকাদের সঙ্গে বাংলার শিল্পীদের ক্রিকেট ম্যাচ। বাবাকে বলে রেখেছিলাম, আমার কিন্তু অমিতাভ বচ্চনের অটোগ্রাফ চাই-ই-চাই। বাবা কথা রেখেছিলেন। ইডেনের ডেসিংরুমে নিয়ে গেলেন। দেখি, অমিতাভ বচ্চন ও রেখা পাশাপাশি বসে আছেন। বাবাকে দেখে অমিতাভ ‘আরে দাদা, আপ! আইয়ে, আইয়ে’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন। আমি তো মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। অমিতাভ ও রেখা দু’জনের অটোগ্রাফ নেওয়ার পর বেরিয়ে আসার সময় দেখি, দরজা ঠেলে ঢুকলেন বিনোদ খন্না। তাঁর দিকেও অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিলাম। তখনই ঢুকলেন আরও একজন অভিনেত্রী। যিনি আমার পছন্দের তালিকায় ছিলেন না। তাই তাঁকে এড়িয়ে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম করতেই বাবা পিছন থেকে আমার হাতটা টেনে অভিনেত্রীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তিনিও হাসিমুখে অটোগ্রাফ দিলেন। দরজার বাইরে এসে বাবা কড়া গলায় বললেন,‘তুই যখন পাঁচজনের সই নিচ্ছিস, তখন উচিত ছিল না কি ওঁরটাও নেওয়া! কাউকে বাদ দেওয়া কখনও ভদ্রতা হতে পারে না! তুমি কাউকে এমন করে অপমান করতে পারো না।’ পদে পদে এমন অনেক ছোট ছোট জিনিস বাবা শিখিয়েছেন আমাদের দুই ভাইকে,’’ ভেজা গলায় বললেন শাশ্বত।
সুরক্ষিত পেশা ছেড়ে শুভেন্দু ঝাঁপ দিয়েছিলেন অনির্দিষ্টের দিকে। তিনি সফল হয়েছিলেন। তাই হয়তো তিনি চাইতেন, তাঁর বড় পুত্রও অভিনয়ের জগতে আসুক। ‘‘তখন কলেজে পড়ি। নাইট কলেজ। সারা সকাল ক্রিকেট-ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতাম। বাবা দেখতেন, আর বলতেন, ‘পাড়ার ক্রিকেট খেলে কেউ গাওস্কর হতে পারে না’। আমিও বলতাম, ‘গাওস্কর হতে কে চেয়েছে? আনন্দ হয়, তাই খেলি’। ভাই পড়াশোনায় বরাবরই ভাল। ওর কেরিয়ার নিয়ে বাবা-মা চিন্তিত ছিলেন না। চিন্তা ছিল আমাকে নিয়ে। একদিন সকালে বাবা তাঁর লাল-সাদা ইতালিয়ান ফিয়েটে বসিয়ে নিয়ে গেলেন বাইপাসের ধারে একটি রিসর্টে। সেখানে গিয়ে বিয়ার অর্ডার করলেন। তার পর প্যাডেল বোটে করে নিয়ে গেলেন রিসর্ট সংলগ্ন ঝিলের মাঝে। বোট থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জীবনে কী করতে চাস তুই?’ ফস করে বলে দিলাম, ‘অভিনয়’। ‘তুই অভিনয় জানিস?’ আমার ভাবটা এমন ছিল যে, অভিনয় জানার কী আছে! তাই বললাম, ‘ও ঠিক হয়ে যাবে’। বাবা তখন বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন, অভিনয়টা এমনি এমনি হয় না, শিখতে হয়। এর পর চার্বাক-এ ভর্তি করে দিয়েছিলেন। মনে আছে, প্রথম দিন ঘর মুছেছিলাম। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাবাই বোধহয় জোছন দস্তিদারকে বলেছিলেন, একে একেবারে ছাড়বেন না। বেশ অনেক দিন পরে ঘরের টেব্লে বাবার লেখা একটা চিরকুট পেয়েছিলাম, ‘ইন্টারেস্টিং ক্যারেকটারাইজেশন।’ আমার একটা টেলিফিল্ম দেখে রিঅ্যাকশন দিয়েছিলেন,’’ চোখের কোেণ জলের ঝিলিক পুত্রের।
মান্না দে ও পুত্র শাশ্বতর সঙ্গে
কেরিয়ারের চড়াই-উতরাই
উত্তম-সৌমিত্র-শুভেন্দু। পরপর এ ভাবে নাম নিতে অভ্যস্ত বাঙালি। কিন্তু সুসময়ের পাশাপাশি দুঃসময়ের মধ্য দিয়েও গিয়েছেন শুভেন্দু। ‘‘যখন দেখতাম বাবা চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী পড়ছেন, তখনই বুঝতাম, ওঁর মুড ভাল নেই। বাবা বলতেন, ‘দুঃসময়ে বিখ্যাত মানুষদের আত্মজীবনী পড়বি, দেখবি তোর সমস্যাটা তুচ্ছ মনে হবে’।’’ কিন্তু যে মানুষটা ‘আকাশকুসুম’, ‘চৌরঙ্গী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ‘গণশত্রু’, ‘লাল দরজা’র মতো ছবি করছেন, তিনিই আবার একাধারে ‘অমর প্রেম’, ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’, ‘গুন্ডা’র মতো ছবিতেও অভিনয় করেছেন। মন থেকে মেনে নিতে পেরেছিলেন এই বিরাট তফাতটা? ‘‘একটা ক্ষোভ তো ছিলই। শেষের দিকে কাজে যেতে চাইতেন না, মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। বাবার সময় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল, তা আজ আর নেই। মনে আছে, প্রায়শই ছুটির দিনে রবিজেঠুর (ঘোষ) বাড়ি তিন পাত্তি খেলতে যেতেন বাবা। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল দারুণ। শুনেছিলাম, ট্রেনের মধ্যে ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ ছবিটির শ্যুটিং চলছে। ভানুজেঠু বাবার উপর রেগে গিয়ে শ্যুটিং চলাকালীন অন্য কামরায় চলে গিয়েছেন! একবার একটি বাংলা ছবি করতে গিয়ে বাবার এক সহকর্মীর সঙ্গে প্রেম হয় হিন্দি ছবির এক নায়িকার। হিরোইন সেই ভদ্রলোককে ইংরেজিতে চিঠি লিখতেন। সহকর্মী ভাল ইংরেজি জানতেন না। বাবা তাঁর হয়ে গুছিয়ে ইংরেজিতে উত্তর লিখে দিতেন, সব রকম গোপনীয়তা রেখেই। এই ছিল সম্পর্ক। যা আজকে ভাবাই যায় না। একটা সময় গ্রামে মফস্সলে বাবা অনেক ফাংশন করতেন। একবার এমনই এক ফাংশনে বাবাকে দেখে এক দর্শক বলেছিেলন, ‘ওই যে জ্যোৎস্নার বাবা এসেছে’। বাবা এসে বলেছিলেন, ‘তা হলে চৌরঙ্গী, আকাশকুসুম কিছু নয়! আমি জ্যোৎস্নার বাবা হয়ে গেলাম’!’’
সিনেমার গণ্ডির মধ্যে আটকা ছিলেন না শুভেন্দু। অভিনয়ের সব রকম স্তরে তিনি কাজ করেছেন। ‘এমন একটা মানুষ চাই’, ‘নকল স্বামীর ঘর’-এর মতো বেশ কয়েকটি যাত্রাও করেছেন তিনি। সিনেমার পাশাপাশি করেছেন ‘কালবৈশাখী’, ‘অমরকণ্টক’, ‘বধূবরণ’-এর মতো প্রফেশনাল নাটক। ছোট পরদাতে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ ছিল ‘ড: মুন্সির ডায়েরি’, ‘এই তো জীবন’ ইত্যাদি।
গায়ক শুভেন্দু
সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ ছিল তাঁর গভীর। টিভি আসার পর রাতে নিয়মিত শুনতেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। একবার একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আবিষ্কার করেন, শুভেন্দু সুকণ্ঠী। তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন গান রেকর্ড করার। শুভেন্দু ভেবেছিলেন, পার্টিতে তো অনেক কথাই হয়, এই প্রস্তাবও সে রকমই। কিন্তু কয়েক দিন পর এইচএমভি থেকে সন্তোষ সেনগুপ্ত ফোন করে তাঁকে বলেছিলেন, ‘হেমন্ত বলছিল, আপনি নাকি ভাল গান করেন?’ সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতায় সুর দিয়েছিলেন শুভেন্দুর এক বন্ধু, গানটি গেয়েছিলেন তিনি।
অভিনেতা ছিলেন বলে সারাক্ষণ তিনি অভিনয়েই ডুবে থাকেননি। তিনি ছিলেন একজন মুক্তমনা। সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, মানুষের জীবনযাত্রা নিয়ে তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আই থিংক দেয়ার ইজ নো গড।’ তিনি মনে করতেন ভারতে একাধিক গাঁধীর দরকার। পিতা, অভিনেতা, বন্ধু, স্বামী সব ভূমিকাতেই তিনি ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy