দুপুর ছোঁওয়া ৩০ নভেম্বরের বিকেল।
সল্টলেকে নিজের বাড়িতে বুদ্ধদেব-কন্যা দময়ন্তী বসু সিং।
সামনে খোলা বাবার লেখার খাতা।
টেবিলের সব কাগজ ঠেলে হাতে তুলে নিলেন ডায়েরিটা। কাগজের ওপর কালো মুক্তোমালার মতো অক্ষর। তার ওপরে আদরের হাত বুলিয়ে বললেন, ‘‘বলুন, আজ কী জানতে চান...’’
পত্রিকা: নতুন প্রজন্ম বুদ্ধদেব বসু মানেই জানে শুধু বিতর্ক। কীসের এত বিতর্ক?
দময়ন্তী: আমার বাবা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। ওঁর প্রথম বই ‘বন্দীর বন্দনা’ থেকেই সেই কালের লোক ‘অশ্লীল’ কবি বা লেখক বলে ওঁকে চিহ্নিত করেছিলেন। আসলে উনি নারী-পুরুষের প্রেম এবং নারী দেহের বর্ণনা কবিতা বা গল্পের মধ্যে আনতে দ্বিধা করেননি। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসও অশ্লীলতার দায়ে পোড়ানো হয়েছে। কিন্তু যখন বুদ্ধদেব বসুরা, তাঁর প্রজন্মের লেখক-কবিরা, মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, তখন তাঁরা রবীন্দ্রনাথ থেকে সরে গিয়ে আরও উঁচু কণ্ঠে কথা বলতে চেয়েছিলেন।
পত্রিকা: এই বিতর্কের প্রশ্নে অশ্লীলতা বড় ছিল? নাকি বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্র বিরোধী, এটা বড় ছিল?
দময়ন্তী: এই প্রাথমিক পর্বে অশ্লীলতাটাই ‘আধুনিক’ কবি লেখকের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বস্তু ছিল। সেটা যে একচেটিয়া বুদ্ধদেবের উপরেই আরোপিত হয়েছিল তা নয়। ‘কল্লোল’ গোষ্ঠী, যার হোতা ছিলেন দিনেশ রঞ্জন, সঙ্গে ছিলেন অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র’র মতো তরুণ সাহিত্যিকরা, তাঁরাও আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে বুদ্ধদেব বসু ‘কল্লোল’-এর সঙ্গে যুক্ত হন। তখন থেকেই অচিন্ত্য-প্রেমেন-বুদ্ধদেব এই নাম তিনটি একসঙ্গে উচ্চারিত হত। ‘কল্লোল’-এই ‘রজনী হল উতলা’ বেরিয়েছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে অশ্লীলতার দায় মাথায় নিয়ে সেই সময় থেকে শুরু করে ষাটের দশকে লেখা ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ পর্যন্ত বুদ্ধদেব বসুকে চলতে হয়েছিল। উনি সহাস্যে চলেওছিলেন।
পত্রিকা: ‘রাত ভ’রে বৃষ্টি’ নিয়ে তো অশ্লীলতার দায়ে মামলা পর্যন্ত হয়েছিল ...
দময়ন্তী: সেটা একটা ঘটনাই বটে! এর আগেও তো বাবার একাধিক বই অশ্নীলতার দায়ে পুলিশের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
পত্রিকা: আচ্ছা, দ্বিতীয় বিতর্কটা কী নিয়ে ছিল ?
দময়ন্তী: বাবা কলকাতায় এসে যখন ক্রমশ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন, বাংলার সব্যসাচী লেখক বলে ওঁকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখন মনে হয় কোথাও একটা প্রতিরোধ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। এ নিয়ে অনেক ভেবেছি জানেন, কেন তাঁকে বার বার নানা ধরনের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে আমার মনে হয় ঢাকা-কলকাতা সাংস্কৃতিক বিভেদ তখনও যথেষ্ট তীব্র ছিল। বাংলা সাহিত্যের জগৎটা পুরোটাই দখল করে ছিলেন খাস পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিকরা। তখন বুদ্ধদেব বসু নিতান্তই কিশোর। হাতে লেখা ‘প্রগতি’ পত্রিকা বের করেন, সজনীকান্তের (দাস) ‘শনিবারের চিঠি’-তে বাবা এবং জীবনানন্দ দাশ অশ্লীল ভাবে আক্রান্ত হয়েছেন। এই আক্রমণ আমাদের বড় হওয়া পর্যন্ত চলেছিল। একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে ‘শনিবারের চিঠি’ গোষ্ঠীর প্রতিটি লেখকই মূলত পশ্চিমবঙ্গীয়। হয়তো একজন বেঁটে কালো বাঙাল ছেলের হঠাৎ কলকাতায় এসে আধুনিক বাংলা কাব্য-সাহিত্য নামক দ্রুতগামী রথের সারথি হওয়াটা এঁরা কেউ মেনে নিতে পারেননি। কেননা বাবা কোনও দলাদলি পছন্দ করতেন না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আড্ডা দিতেন না। চিরকাল নিজের ঘরে বসে প্রচুর কাজ করতেন। তখনও পরিশ্রম করে চলেছিলেন সমসাময়িক ও তরুণতর কবিদের প্রতিষ্ঠার জন্য। ১৯৩৫ থেকে ১৯৬১ অবধি প্রকাশিত ‘কবিতা’ পত্রিকা আজও তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী। সত্যি বলতে তখন কবিতা প্রকাশের কোনও জায়গাই ছিল না। প্রতিষ্ঠিত মাসিকগুলিতে কবিতার জায়গা হত (রবীন্দ্রনাথ ছাড়া) গদ্য রচনার নীচে। ‘কবিতা’ পত্রিকার আগেও উনি বিষ্ণু দে’র কবিতার বই ছাপেন। সত্যি বলতে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ থেকে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ পর্যন্ত সবই সর্বপ্রথম কবিতা ভবন থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
পত্রিকা: এই বিতর্কের কথায় আপনি ‘প্রাথমিক’ কথাটা ব্যবহার করলেন। তা হলে আরও অন্যান্য কারণ আছে কি?
দময়ন্তী (একটু হাসলেন): হ্যাঁ আছে। সেই সময় অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া। কবিতা ভবনে তখন বুদ্ধদেব বসুর চারপাশে অনেক তরুণ কবি, যাঁরা পুরোপুরি সেই দলভুক্ত। বাবা-মা দু’জনেই সক্রিয় ভাবে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
পত্রিকা: তরুণ কবিরা কারা ছিলেন?
দময়ন্তী: সমর সেন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়—ছোটবেলা থেকেই এঁদের কাকা বলেই জানি। বামপন্থী আন্দোলন যখন দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তার আগেই বুদ্ধদেব বসু অনুভব করেছিলেন অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট আন্দোলন আর আগের মতো নেই। শিল্পীর স্বাধীনতায় তাঁরা যেন হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছিলেন। কে কী লিখবে, পড়বে, ওপর থেকে নির্ধারিত হয়ে আসতে শুরু করল। এই বাধ্যবাধকতা বুদ্ধদেব বসু যে মানতে পারবেন না, সেটা তো স্পষ্টই ছিল।
পত্রিকা: বুদ্ধদেব বসু কি দল ছাড়লেন তখন?
দময়ন্তী: অবশ্যই বাবা দল ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তখন থেকেই বাবার বিভিন্ন লেখায় ব্যক্তির স্বাধীনতা, শিল্পীর স্বাধীনতার কথা।এই বক্তব্য বার বার তাঁর নানা প্রবন্ধে এসেছে। কিন্তু পরবর্তী কালে বামপন্থীরা তাঁর দল ছেড়ে যাওয়া, স্বাধীন মত প্রকাশের এই সাহস বরদাস্ত করতে পারেননি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদের মতো আপনজনরাও আর কবিতা ভবনের ছায়া মাড়াননি। পরে আমাকেও অনেক বিশেষ বিশেষ মানুষ বলেছেন, বুদ্ধদেব বসুর বই পড়া দলের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়েছিল। তিনি নাকি ‘শ্রেণিশত্রু’। যাঁকে কমিউনিস্ট রেজিমে বলা হত ‘এনিমি অব দ্য পিপল।’
পত্রিকা: শুনেছি বুদ্ধদেব বসুকে একটি বিশেষ শ্রেণির লেখক বলে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি দারিদ্রচর্চায় মনোযোগী নন। তাঁর ওপর দক্ষিণপন্থী ও ‘গজদন্ত মিনারবাসী’, এটা ঠিক?
দময়ন্তী: (বেশ রেগে) কবিতা ভবন নামক প্রতিষ্ঠানটি যে কোন ধরনের গজদন্তের মিনার, যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন। বুদ্ধদেব বসু নিজের জন্য কোনও দিন বাদ-প্রতিবাদে নামেননি। তাঁর জবাবটুকু ‘মিনার’ নামক কবিতাটা পড়লেই বোঝা যাবে।
পত্রিকা: আর দক্ষিণপন্থা?
দময়ন্তী: একবার মার্কিন দেশে গেলেই মানুষকে যদি দক্ষিণপন্থী হতে হয় তা হলে বলার কিছু নেই। তিনি কেবল প্রতিষ্ঠিত লেখকই ছিলেন না, মেধাবী ছাত্রও ছিলেন। সেই জোরেই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে সরকারি উদ্যোগে প্রথম ১৯৫৪-তে মার্কিন দেশে পড়াতে যান। এর পরে যাদবপুরে ১৯৫৬-য় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।
পত্রিকা: বুদ্ধদেব বসু’র নামে রবীন্দ্র বিরোধিতার ধুয়োটা কবে থেকে উঠল?
দময়ন্তী: ( প্রচণ্ড উত্তেজিত) বিতর্ক সবচেয়ে বেশি উস্কেছিল রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষে (১৯৬১) যখন সারা পৃথিবী থেকে বাবার বক্তৃতা দেবার নিমন্ত্রণ আসে। প্যারিসে ওঁর একটি বিশেষ বক্তৃতা সূত্রে কোনও একটি সংবাদপত্র সম্পূর্ণ পরিকল্পিত মিথ্যা অপপ্রচার করতে শুরু করেছিল। আয়রনিক্যালি এই প্রবন্ধটি তার আগে ন’বার বাংলা ও ইংরেজিতে বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। এবং প্রথম বেতার ভাষণ হিসেবে লেখা হয়েছিল। তখন আমি কলেজে। এটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিল কত মানুষের আগ্রহ আসলে নোংরা গসিপে। সত্য-মিথ্যা বিচারে নয়। একটা সংবাদপত্রের পাতায় কত যে নোংরামি করা যায়, এটা তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এ বিষয়ে কথা বলতে ঘেন্না বোধ হয়।
পত্রিকা: ওই বক্তৃতার মূল বাংলা ভার্সান তো ‘দেশ’ পত্রিকাতেই বেরিয়েছিল।
দময়ন্তী: হ্যাঁ, ওই সময় আনন্দবাজার গোষ্ঠী আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। দেশ-এর সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তখন বক্তৃতাটির বাংলায় পুনর্মুদ্রণ করেন। এই সঙ্গে এম.সি সরকারের কর্ণধার সুধীর সরকার মানহানির মামলা করতে উদ্যোগী হন। যেটা অবশ্য আমাদের পরিবারের সর্বসময়ের শুভাকাঙ্খী সত্যেন বসু এসে নাকচ করেন। সংগৃহীত কাগজপত্র তৎক্ষণাৎ জ্বালিয়ে দিয়ে বহ্ন্যুৎসব করা হয়।
পত্রিকা: অথচ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর অসাধারণ সব প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ‘সব পেয়েছির দেশে’-র পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে। দুই অসমবয়সি কবির মধ্যে লেখা চিঠিপত্রেও ...
দময়ন্তী: (থামিয়ে দিয়ে) বুদ্ধদেব রবীন্দ্রনাথকে যে ঠিক কী চোখে দেখতেন সেটা যদি কেউ জানতে চান, তা হলে শুধুমাত্র ‘সব পেয়েছির দেশে’ পড়াই যথেষ্ট। বাবা মাত্র ছয় বছর রবীন্দ্রনাথকে কাছে পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে শান্তিনিকেতনে আমাদের পুরো পরিবার আমন্ত্রিত হয়েছিল তাঁর ব্যক্তিগত অতিথি হয়ে। আমেরিকা থেকে চিঠি লিখছেন বাবা— ‘‘চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে জগতের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য। আমাকে শুধু রবি-তৃষ্ণায় পেয়েছে’’।
পত্রিকা: কিন্তু ১৯৩৫-এ ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথের কবিতা চাইলেন না কেন?
দময়ন্তী: রবীন্দ্র-পরবর্তী যাঁরা নিজেদের আধুনিক বলে ঘোষণা করেছিলেন, তাঁদের রবীন্দ্রনাথ থেকে বেরিয়ে আসতেই হত। বিশাল বটগাছের তলায় ছোট গাছ থাকলে তার মৃত্যু অনিবার্য। ‘কবিতা’ পত্রিকার পুরোধা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কবিতা না চেয়ে শুধুমাত্র নিজেদের প্রজন্মের কবিদের নিয়ে তিনি একটি ‘লিটল ম্যাগাজিন’ (এই শব্দটিও বুদ্ধদেব বসুর অবদান) তৈরি করেন। সেটা তাঁদের ঔদ্ধত্য ছিল না। ছিল তারুণ্যের যোশ। তাঁদের দেখাতেই হত যে তাঁরাও স্বকণ্ঠে তাঁদের নিজস্ব কথা নিজের ভঙ্গিতেই বলতে পারেন। তবুও প্রথম সংখ্যাটি বাবা সাহস করে প্রথম রবীন্দ্রনাথকেই পাঠান। শুধু তাই নয়, অনুরোধ করেন দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে কবিতা দেওয়ার জন্য। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে রবীন্দ্রনাথ তৎক্ষণাৎ কবিতা পাঠিয়ে এই পত্রিকাকে স্বীকৃতি দেন।
পত্রিকা: চিঠিপত্রে দেখেছি ‘চোখের বালি’, ‘যোগাযোগ’ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসু রবীন্দ্রনাথকে সরাসরি তাঁর মতামত দিয়েছিলেন। কী হয়েছিল?
দময়ন্তী: ‘চোখের বালি’র শেষ অংশে অর্থাৎ বিনোদিনীর মধ্যে সাহস ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের একটা বদল ঘটে যায়। সেটা বাবার পছন্দ হয়নি। সরাসরি রবীন্দ্রনাথকে বলেছিলেন যে তিনি মনে করেন লেখকের অনেক সাহসী হওয়া উচিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছিলেন এ কথা সত্যি। যা তিনি করতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত প্রকাশ্যে করে উঠতে পারেননি।
পত্রিকা: ‘যোগাযোগ’এর ক্ষেত্রে?
দময়ন্তী: ‘যোগাযোগ’ প্রসঙ্গ অন্য রকম। বাবা বলেছিলেন ‘যোগাযোগ’-এর দ্বিতীয় খণ্ড হওয়া উচিত। কুমুদিনী-ই হোক বা বিনোদিনী, দেহ বিষয়ে তাদের ছুৎমার্গ ছিল না। তারা বঞ্চিত বলে বারে বারে প্রতিবাদ করেছে। বাবার এই কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ প্রতিভা বসু’র দিকে নাকি তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেছিলেন, দ্বিতীয় খণ্ড তোমার স্বামীকেই লিখতে বলো না গো।
পত্রিকা: রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আপনার মায়ের নাকি বুদ্ধদেব বসু’র সঙ্গে বিয়ের আগেই দেখা হয়েছিল?
দময়ন্তী: ঠিক কথা। মা তখন হাওয়া বদলের জন্য কাকার কাছে দার্জিলিং-এ। শোনা গেল রবীন্দ্রনাথ আসছেন সেখানে। মা সারাদিন দাঁড়িয়ে রইলেন কবির যাওয়া-আসার পথে। কিন্তু কবির দেখা পেলেন না। সেদিন কবি অন্য পথে গিয়েছিলেন। মা যখন অপার দুঃখে হাহুতাশ করছেন তখনই এক বেয়ারা মারফত চিঠি এল। প্রতিমা দেবী লিখেছেন অমুক দিন বিকেলে ওঁর সঙ্গে চা খেলে বাবামশাই খুশি হবেন। মা তো আকাশ থেকে পড়লেন। রবীন্দ্রনাথ নাকি মায়ের দেখা পাওয়া মাত্র বলেছিলেন, তুমি তো সবার গান গাও। আমার গান তো গাও না! এখন থেকে রোজ ভোর হলেই চলে আসবে, আমি তোমায় গান শেখাব।
বুদ্ধনামা
সাড়ে ছ’টায়: ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা। (সেটা আর খেতেন না)।
সকাল সাতটায় আবার গরম গরম চা।
ন’টায় প্রাতরাশ: ডিম (অবশ্যই হাফ বয়েল। পরে সেটা আবার ওয়াটার পোচ হয়ে গিয়েছিল), টোস্ট। স্বাস্থ্যের কারণে পরে পাঁউরুটির ওপর চিকেন লিভার স্প্রেড দিয়ে।
লেখার টেবিলে লেখা শুরু।
দুপুর একটা থেকে দেড়টা: স্নান সেরে মধ্যাহ্নভোজ। ডাল, ভাত, মাছ (একটা ছোট মাছ। একটা বড় মাছ)। দই।
আবার লেখার টেবিলে ফেরা। এর মাঝে অগুন্তি সিগারেট আর চা।
বিকেল পাঁচটা: চা এবং সিগারেট। টায়ের খুব একটা চল ছিল না।
দশটা: রাতের খাবার। শেষের দিকে গ্লাসভর্তি বরফে হাফ পেগ ইন্ডিয়ান হুইস্কি। রোজ।
রুটি, মাংস।
পত্রিকা: সবার গান গাও বলতে?
দময়ন্তী: মা ধ্রুপদী গানের চর্চা করতেন। অতুলপ্রসাদ, নজরুল, দিলীপ রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়—এঁদের গানই রেকর্ড করেছিলেন। ঢাকায় বসে সঠিক ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার কোনও গুরু পাননি। সে কারণেই নিজের মনে গাইলেও রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ড করার সাহস পাননি। তখন ভদ্র পরিবারে মেয়েদের রেকর্ড করা, গান করা ভাল চোখে দেখা হত না। কিন্তু ওঁর প্রতিভার আশৈশব এত খ্যাতি ছিল যে দিলীপ রায়, নজরুল—এঁরা তাঁকে নিজেদের গান নিজেরাই তুলিয়েছেন। দিলীপ রায় অবশ্য অতুলপ্রসাদ আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানও শিখিয়েছিলেন। দার্জিলিং যাত্রায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখালেন।
পত্রিকা: নজরুল এবং প্রতিভা বসু’র যে আশ্চর্য সম্পর্ক স্থাপন হয়েছিল সেটা নিয়ে বলুন না ...
দময়ন্তী: ‘জীবনের জলছবি’-তে মা লিখেছেন সে সব দিনের কথা। আমাদের বাড়িতে নজরুলের সেই গানের খাতা আজও আছে, যার মধ্যে মায়ের ঢাকার বাড়িতে বসে নজরুল মা-কে যত গান শিখিয়েছিলেন তার বড় অংশ নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। প্রতিটি গানের তলায় ওঁর সই। রাগ-এর নাম লেখা। মা-কে উনি গানের বই উৎসর্গ করেছেন। নিজের হাতে লিখেছেন—‘কিন্নরকণ্ঠী রাণু মনিকে কবিদা’, ‘কোকিলকণ্ঠী রাণু মনিকে কবিদা’। সেই বাচ্চা মেয়েটির মধ্যে যে প্রতিভা দেখেছিলেন, তাকে কুর্নিশ না করে পারেননি।
পত্রিকা: আপনাদের ২০২ বাড়ির আড্ডায় শুনেছি বসু দম্পতি পরবর্তী প্রজন্মকে প্রচুর প্রশ্রয় দিয়েছেন। এও শুনেছি যাঁরাই আসতেন, তাঁরাই আপনার মায়ের ভক্ত হয়ে যেতেন। আপনার বাবা …
দময়ন্তী: (মুখের কথা কেড়ে নিয়ে) কী ভাবে নিয়েছেন, তাই তো?
পত্রিকা: তাই।
দময়ন্তী: বাবা জানতেন, বিশ্বাস করতেন, মা একজন বিশেষ নারী। আমরা তো সারাক্ষণ মজা করে বলতাম, মা তোমার কাছে আমরা সবাই হেরে গেছি। ২০২ নম্বরে যিনিই আসতেন, তিনিই মায়ের ভক্ত হয়ে যেতেন। আনন্দবাজারের প্রাক্তন বার্তা সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষ মায়ের নাতনি তিতির কিশোরী হওয়ার পরে হঠাৎ একদিন আমাকে আর দিদিকে বললেন, ‘তোমরা এখন মধ্যপদলোপী সমাস’ অর্থাৎ মা আর তিতিরের মধ্যে আমরা বেচারিরা একদম আউট! একজন রোম্যান্টিক কবি হিসেবে বাবা এটা উপভোগই করতেন। আসলে বাবার মধ্যে কোনও দিনই কোনও সন্দেহ, সংস্কার, এসব কিছুই দেখিনি। শুনেছি ফুলশয্যার রাতে বউয়ের শাঁখা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন! কোনও সংস্কার আমাদের কারও মধ্যে থাকুক সেটা চাননি কখনও। বাঙালি বাড়ির রবিবারের দুপুরের মাংস-ভাতের মতোই আমাদের বাড়িতে হত বিফের ঝোল।
পত্রিকা: আপনার বাবার বিষয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন— ‘তরুণদের মধ্যেও তরুণতম।’ বুদ্ধদেব বসুর সন্তানের পরবর্তী প্রজন্ম থেকে এ রকম উক্তি আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। আপনার বাবা কি সেই প্রজন্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন?
দময়ন্তী: উনি তো সময়ের আগে হেঁটেছেন। তাই সবচেয়ে উপভোগ করতেন তরুণদের সংস্পর্শ। সুনীলের আগের প্রজন্মে যে চার যুবক ২০২-এর আবহাওয়াকে আনন্দে মুখর করতেন, তাঁরা ছিলেন অরুণ সরকার, নরেশ গুহ, অশোক মিত্র, নিরুপম চট্টোপাধ্যায়। এঁরা রাত তিনটেয় কড়া নেড়ে লেক-এর গাছ থেকে শিরীষ ফুল এনে চা দাবি করতেন। বাবা-মা আনন্দে তাঁদের আবদার মেটাতেন। এঁদের পাগলামি খানিক থিতু হওয়ার পর এল সুনীল-শক্তিদের দল। বাবার সঙ্গে বসে সিগারেট খাওয়া ওঁরা সবচেয়ে বেশি এনজয় করতেন। বাবা নিজেই সিগারেট অফার করতেন।
আর অরুণ সরকার তো মায়ের জন্মদিনে কবিতাই লিখে ফেললেন, ‘সিন্দুক নেই : স্বর্ণ আনিনি,/ এনেছি ভিক্ষালব্ধ ধান্য।/ ও দুটি চোখের তাৎক্ষণিকের/ পাব কি পরশ যৎসামান্য?’ বাবা এক দিন আমাকে বললেন, ‘তোর জন্য খবর আছে। অরুণ সরকারের বিয়ে।’ আমি তো শুনে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েছিলাম (হাসি)।
পত্রিকা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও তো ২০২-এ খুব নিয়মিত যেতেন!
দময়ন্তী: সুনীল-শক্তি যখন তখন এসে প়ড়ত। বাবার সঙ্গে কবিতার ছন্দ নিয়ে তর্ক জুড়ে দিত ওরা। দু’জনেই খুব ভালবাসত বাবাকে। বাবারও ছিল তাদের প্রতি অপত্য স্নেহ।
পত্রিকা: আচ্ছা শিবনারায়ণ রায়ের কাছে সজনীকান্ত দাস আপনার বাবাকে কি কিছু মেসেজ পাঠিয়েছিলেন?
দময়ন্তী: আজ যা বলব, তা পুরোটাই শিবনারায়ণ রায়ের মুখে শোনা। এই কথাটা প্রকাশ্যে বলতে পারি কি না, তার অনুমতিও শিবনারায়ণ রায়ের কাছ থেকে আমি নিয়ে রেখেছিলাম। সজনীকান্ত দাস যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন শিবনারায়ণ রায়কে বাবার কাছে পাঠিয়েছিলেন। বাবাকে বলতে বলেছিলেন, বাবার প্রতি তাঁর আচরণের জন্য তিনি সত্যিই অনুতপ্ত। বাবা যেন তাঁকে ক্ষমা করে দেন।
পত্রিকা: তার পর?
দময়ন্তী: শিবনারায়ণ রায়ের কাছেই শুনেছি, কথাটা শুনে বাবা খানিক ভাবলেন। তার পর শিবনারায়ণ রায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি ওঁকে ক্ষমা করতে পারলাম না। এমনই দৃঢ়, ভেতরে ভেতরে কঠোর মনের মানুষ ছিলেন বাবা। কোথাও কোনও সমঝোতা করেননি। অথচ সেই বাবাই আমায় শিখিয়েছিলেন সজনীকান্তের মেয়ের সঙ্গে আমেরিকায় দেখা হলে বন্ধুসুলভ আচরণ করতে। বাবা বলেছিলেন, ‘‘আমরা ইতালিয়ান নই যে প্রজন্মের পর প্রজন্ম শত্রুতা টানব।’’
পত্রিকা: বাংলাদেশের কবিদের অনেক কবিতাও ‘কবিতা’ পত্রিকায় বেরিয়েছে। ওখানে বুদ্ধদেব বসুর প্রতি অনুরাগ এখনও প্রগাঢ়...
দময়ন্তী: বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবিরা আমাকে নিজেরাই বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ কেমন করে পড়ব, তা শিখিয়েছেন বুদ্ধদেব। আবার জীবনানন্দ কেমন করে বুঝব, তাও জানিয়েছেন তিনিই। অন্য দিকে অমিয় চক্রবর্তীকেও বুদ্ধদেবের জন্যই চেনা।
পত্রিকা: দু’জন প্রতিভাবান মানুষের সন্তান আপনি। মা, না বাবা, কাকে আগে রাখবেন?
দময়ন্তী: মা-বাবাকে কখনও কি আগে পরে করা যায়! তবে বাবার জন্য মন কেমন বড্ড বেশি। এত দেশ তো ঘুরলাম, কত জ্ঞানীগুণী মানুষও দেখলাম। আমার বাবার মতো অমন অসূয়াহীনচিত্ত আর একজনকেও পেলাম না।
আজ মনে হয়, ‘প্রথম পার্থ’র সেই কর্ণ আর কেউ নয়, আমার বাবা-ই। লোহার বর্ম পিঠে নিয়ে অগুনতি সৈন্যের মাঝে লড়ছেন নিজের লড়াই। কেউ যদি সত্যিকারের গুণগ্রাহিতা নিয়ে বাবাকে পড়েন, তা হলে দেখবেন, উনি কী
ভাবে ক্রমশ পরিণত হয়েছেন।
আবেগে ভেসে না গিয়ে যে আঁধার আলোর অধিক, সেই জায়গায় নিজেকে পৌঁছে দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy