Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Science

ভিনগ্রহে প্রাণ আছে, প্রমাণ মিলবে শীঘ্রই, দাবি বিজ্ঞানীর

বছর আড়াই আগে, পদার্থবিদ্যায় এ বছরের অন্যতম নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মিশেল মেয়রের সঙ্গে, ভিনগ্রহে প্রাণ নিয়ে কথা বলেছিলাম আমরা। সেই প্রতিবেদনটি নতুন করে সামনে আনা হল... (৮ অক্টোবর ২০১৯)আর এক বছরের মধ্যেই আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহ ছাড়াও এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও যে প্রাণ রয়েছে, তা প্রমাণিত হবে। হদিশ মিলবে ভিনগ্রহে প্রাণের। সুদূর জেনিভা থেকে টেলিফোনে এমনটাই দাবি করলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র। আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত টেলিফোন সাক্ষাৎকারে।

প্রথম কোনও ভিনগ্রহের আবিষ্কর্তা মিশেল মেয়র।

প্রথম কোনও ভিনগ্রহের আবিষ্কর্তা মিশেল মেয়র।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ মার্চ ২০১৭ ২২:০০
Share: Save:

আর খুব একটা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটাতে হবে না আমাদের। ভিনগ্রহে প্রাণ খুঁজছেন যে বিজ্ঞানীরা, তাঁদের আর কটাক্ষও শুনতে হবে না- ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছেন! আর অর্থের শ্রাদ্ধ করছেন!’

আর এক বছরের মধ্যেই আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহ ছাড়াও এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও যে প্রাণ রয়েছে, তা প্রমাণিত হবে। হদিশ মিলবে ভিনগ্রহে প্রাণের।

আর কেউ বললে না হয় কথাটা তুড়ি মেরেই উড়িয়ে দেওয়া যেত ‘অসম্ভব স্বপ্ন’ বা ‘কষ্টকল্পনা’ বলে! কিন্তু তা করা যাচ্ছে না, কারণ, সুদূর জেনিভা থেকে টেলিফোনে এমনটাই দাবি করলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র। আজ থেকে ২২ বছর আগে যিনি আমাদের সৌরমণ্ডলের বাইরে প্রথম অন্য একটি নক্ষত্রমণ্ডলে কোনও ভিনগ্রহের সন্ধান দিতে পেরেছিলেন। ১৯৯৫ সালের অক্টোবরে। জেনিভা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিশেল মেয়রের সেই আবিষ্কারের সহযোগী ছিলেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরও এক অধ্যাপক ডিডিয়ার কোয়েলজ্‌। তাঁরা ‘পেগাসিয়াস’ নক্ষত্রপুঞ্জে হদিশ পেয়েছিলেন এমন একটি নক্ষত্রের (৫১ পেগাসি), যাকে পাক মারছে আমাদের বৃহস্পতির মতো চেহারার খুব বড় আর ভারী একটি ভিনগ্রহ ‘৫১ পেগাসি-বি’। পরে যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বেল্লেরোফোন’। এখন যাকে ডাকা হয় ‘ডিমিডিয়াম’ নামে।


জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র ১৯৯৫ সালে প্রথম যে ভিনগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন সেই ‘৫১ পেগাসি-বি’

২০১৭-য় যে সাত ‘পৃথিবী’র নক্ষত্রমণ্ডলের হদিশ মিলল, সেই ট্রাপিস্ট-১

গত ২২ ফেব্রুয়ারি নতুন সাত ‘পৃথিবী’র নক্ষত্রমণ্ডল ‘ট্রাপিস্ট-১’ আবিষ্কারের খবর নাসা ঘোষণা করার পর আনন্দবাজারের তরফে জেনিভায় যোগাযোগ করা হয়েছিল প্রথম ভিনগ্রহের আবিষ্কর্তা জ্যোতির্বিজ্ঞানী মিশেল মেয়রের সঙ্গে।

ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নে নিরুত্তর থাকার পর তাঁর সঙ্গে সরাসরি টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে অধ্যাপক মিশেল মেয়র বলেছেন, ‘‘ট্রাপিস্ট-১ নক্ষত্রমণ্ডলের আবিষ্কার আমার মতো অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানীকেই যথেষ্ট উৎসাহিত করেছে। এই আশাটা আরও জোরালো হয়েছে, ভিনগ্রহে প্রাণের হদিশ মিলবে খুব তাড়াতাড়ি। হয়তো আর এক বছরের মধ্যেই।’’

যে ভিনগ্রহগুলিতে মিলতে পারে প্রাণ: দেখুন ভিডিও

কেন? কী ভাবে অতটা আশা করছেন বিজ্ঞানী মিশেল মেয়র?

জেনিভা থেকে টেলিফোনে অধ্যাপক মেয়র আনন্দবাজারকে বলেছেন, ‘‘তার প্রধান কারণ রয়েছে তিনটি। এক, এখন মহাকাশে থাকা যে টেলিস্কোপগুলি এই নতুন নক্ষত্রমণ্ডলের হদিশ পেয়েছে আর তার পরে নজর রাখতে শুরু করেছে ‘ট্রাপিস্ট-১’-এর ওপর, সেই স্পিৎজার, কেপলার, হাব্‌লের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি শক্তিশালী একটি টেলিস্কোপ নাসা মহাকাশে পাঠাচ্ছে আগামী বছরে। যার নাম- ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ’ বা ‘জেডব্লিউএসটি’। ওই টেলিস্কোপের মাধ্যমে আরও খুঁটিয়ে দেখা যাবে আমাদের থেকে মাত্র ৩৯ আলোকবর্ষ দূরে থাকা সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্রমণ্ডল ‘ট্রাপিস্ট-১’-কে। দুই, এই প্রথম এমন কোনও নক্ষত্রমণ্ডলের হদিশ মিলল, যেখানে একেবারে ‘গোল্ডিলক্‌স জোন’ বা ‘হ্যাবিটেব্‌ল জোন’-এই রয়েছে পৃথিবীর মতো চেহারার সাতটি ভিনগ্রহ। যাদের ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা শূন্য থেকে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩২ ডিগ্রি থেকে ২১২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে। মানে, যে তাপমাত্রায় জল খুব সহজেই থাকতে পারে তরল অবস্থায়। আর প্রাণের জন্ম বা তার বিকাশের পক্ষেও এই তাপমাত্রাটা একেবারেই আদর্শ। ‘প্রক্সিমা সেনটাওরি-বি’ বা ’৫১ পেগাসি-বি’-র মতো ভিনগ্রহগুলির ক্ষেত্রে সেই সুবিধাটা নেই। তিন নম্বর কারণটা হল, এই যে নতুন সাতটি ভিনগ্রহের হদিশ মিলেছে ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে, তার মধ্যে প্রথম ৬টি গ্রহই ‘ট্রাপিস্ট-১-বি থেকে ট্রাপিস্ট-১-জি’) আমাদের পৃথিবীর মতোই পাথুরে। চেহারাতেও অবিকল পৃথিবীর মতোই। আর এখনও পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ থেকে যেটুকু তথ্য মিলেছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে, ওই ৬টি ভিনগ্রহেরই ভূপৃষ্ঠে রয়েছে তরল জলের বিশাল বিশাল সাগর, মহাসাগর। আর সেই সাগর বা মহাসাগর কোনও পুরু বরফের চাদরের তলায় লুকিয়ে নেই। চার, পৃথিবীর অনেক কাছেই রয়েছে এই সদ্য আবিষ্কৃত নক্ষত্রমণ্ডল ‘ট্রাপিস্ট-১’। ফলে আমাদের হাতে থাকা প্রযুক্তি দিয়েই ওই নক্ষত্রমণ্ডলটিকে আরও ভাল ভাবে পর্যবেক্ষণ করার যাবতীয় সুযোগসুবিধা রয়েছে।’’

আরও পড়ুন- আগামী বছরের গোড়ায় চাঁদে নামছে ভারত, জানাল ইসরো


ভিনগ্রহ ‘কেপলার-১০-বি’। শিল্পীর কল্পনায় (ওপরে) আর ভিনগ্রহ ‘এইচডি-২০৯৪৫৮-বি’ (ওসিরিস) (নীচে)


ভিনগ্রহ ‘কেপলার-৪৪৪-বি’

‘ট্রাপিস্ট-১’ আমাদের নতুন কী তথ্য দিতে পারে?

কোনও রাখঢাক না রেখেই প্রথম কোনও ভিনগ্রহের আবিষ্কর্তা মিশেল মেয়র বললেন, ‘‘এই ব্রহ্মাণ্ডে আমরা সত্যি-সত্যিই একা কি না, এ বার সেই উত্তরটা পাওয়া যাবে। আর আমার মনে হয়, সেটা আর এক বছরের মধ্যেই জানা যাবে। আমার জোরালো বিশ্বাস, এই ব্রহ্মাণ্ডে আমরা একা নই। এই ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও প্রাণ রয়েছে। তা আমাদের থেকে উন্নত হতে পারে। হতে পারে তা অণুজীবও। কিন্তু প্রাণ আছেই আছে, এই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।’’

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ কী কী তথ্য দিতে পারে ‘ট্রাপিস্ট-১’ সম্পর্কে?


ভিনগ্রহ ‘এপসিলন-এরিডানি-বি’ (ওপরে) আর ভিনগ্রহ ‘কেপলার-১৮৬-এফ ’ (নীচে)

অধ্যাপক মিশেল মেয়র বলছেন, ‘‘ওই টেলিস্কোপ আমাদের খুব সাহায্য করবে ওই নতুন নক্ষত্রমণ্ডলের অন্তত ৬টি গ্রহের ভূপৃষ্ঠে (সারফেস) কতটা জল রয়েছে, বায়ুমণ্ডলে কতটা কার্বন ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন রয়েছে বা কতটা রয়েছে ওজোন, তা নির্ভুল ভাবে মাপতে। আমি যে প্রথম ভিনগ্রহটি (‘৫১ পেগাসি-বি’)আজ থেকে ২২ বছর আগে আবিষ্কার করেছিলাম, সেটিকে তখন ভেবেছিলাম আমাদের বৃহস্পতির মতোই গ্যাসে ভরা খুব ভারী আর বিশাল চেহারার একটি খুব গরম গ্রহ। যাকে বলে ‘হট জুপিটার’। কিন্তু হালের গবেষণায় (২০১৭-য় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ প্রকাশিত) জানা গিয়েছে, জল রয়েছে সেই ‘৫১ পেগাসি-বি’-তেও। তবে ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলের অন্তত ৬টি গ্রহ হয়তো আমাদের সব প্রত্যাশাকেই ছাপিয়ে যেতে চলেছে। তার বায়ুমণ্ডলে প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় বহু মৌলিক পদার্থ বা রাসায়নিক মিলতে পারে বলে আমাদের প্রাথমিক অনুমান। হয়তো হদিশ মিলতে পারে অক্সিজেনেরও। আর সেটাই হবে প্রাণের অস্তিত্বের অত্যন্ত জোরালো ইঙ্গিত।’’


ভিনগ্রহ ‘কোই-৩১৪-সি’ (ওপরে) আর ভিনগ্রহ ‘গিলেসি-৫৮১-ই’ (নীচে)

এখানেই শেষ নয়, প্রাণ হয়তো আছে আরও কোথাও, আরও আরও কোনওখানে...

অধ্যাপক মিশেল মনে করেন, ‘‘যদি ‘ট্রাপিস্ট-১’ নক্ষত্রমণ্ডলে সত্যি-সত্যিই প্রাণের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা হলে মানতেই হবে, এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণ রয়েছে আরও আরও ভিনগ্রহে, যেগুলির হদিশ আমরা এখনও পাইনি।’’

ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নাসা।

অন্য বিষয়গুলি:

Michel Mayor 51 Pegassi B Exoplanets
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE