Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
International News

ভারতে এসে বাণিজ্যে লাভ হবে না, বুঝে গিয়েছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প তাঁর মেয়াদকালের প্রায় অন্তিম লগ্নে ভারত সফরে আসছেন কি বিনা স্বার্থে? তা তো নয়।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সব্যসাচী বসু রায়চৌধুরী
কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৫:৪১
Share: Save:

ভারতের একটি ইংরেজি দৈনিকের কার্টুনে দেখা যাচ্ছে, এক সরকারি আধিকারিক তাঁর মন্ত্রীকে বলছেন, আসন্ন বৈঠকে তো তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ! সে ক্ষেত্রে দুই দেশের নেতার পক্ষে অন্তত তিন ঘণ্টা ধরে করমর্দন করাই শ্রেয়!

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন প্রথম ভারত সফরের পরিণতিও কি এমনটাই হতে চলেছে? এমন প্রশ্ন ওঠা কিন্তু একেবারে অসঙ্গত নয়।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প তাঁর মেয়াদকালের প্রায় অন্তিম লগ্নে ভারত সফরে আসছেন কি বিনা স্বার্থে? তা তো নয়।

এই বছরটা আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর। সেই নির্বাচনে ট্রাম্পই রিপাবলিকান দলের প্রার্থী হতে চলেছেন। তাই আমেরিকার মানুষের পক্ষে লাভজনক কিছু ভারত সফরে এসে জোগাড় করার প্রত্যাশা ট্রাম্পের পক্ষে স্বাভাবিকই। বিশেষত, বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে চিন-মার্কিন বাণিজ্য সঙ্ঘাত যে পর্যায়ে গিয়েছে, তার প্রেক্ষিতে এমনটা আরওই প্রত্যাশিত।

ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে ঘাটতি কম নয়

২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৪ হাজার তিনশো কোটি ডলার। ভারতের রফতানির পরিমাণ আট হাজার ৩৯০ কোটি ডলার হলেও আমদানির পরিমাণ পাঁচ হাজার ৮৭০ কোটি ডলার। অর্থাৎ, ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে আমেরিকার ঘাটতির পরিমাণ দুই হাজার ৫২০ কোটি ডলার। এই ঘাটতি কমানো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভারত সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।

‘বন্ধু’ ট্রাম্পের সমর্থনে মোদী। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নামে হোর্ডিং। গত বছর, হিউস্টনে।

‘ছিল’ বলছি, কারণ, সেই প্রত্যাশা এই সফরে পূরণ হওয়ার নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিগত আমেরিকা সফর ‘হাউডি মোদী’র জের টেনেই এ বার প্রায় ৩৬ ঘণ্টার ভারত সফর ট্রাম্পের। এই সফর ঘিরে নয়াদিল্লির উদ্দীপনাও দেখার মতো। দুই দেশই একটি বড় অঙ্কের বাণিজ্য চুক্তির প্রত্যাশী ছিল। কিন্তু কয়েক দিন আগেই সুর কাটতে আরম্ভ করে।

মার্কিন দুগ্ধজাত পণ্যে ভারতের ‘না’

বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর উদ্দেশ্যে আমেরিকা এ দেশে তার দুগ্ধজাত পণ্য রফতানি করতে যথেষ্ট আগ্রহী ছিল। কিন্তু নয়াদিল্লির পক্ষ থেকে কার্যত জানিয়ে দেওয়া হয় যে, আমেরিকার গবাদি পশু অনেক ক্ষেত্রেই আমিষ খাদ্য গ্রহণ করে বলে সেই গবাদি পশুর দুধও আমিষ বলে বিবেচিত হবে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর।

‘বন্ধু’ আসবেন বলে। তৈরি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর গুজরাত।

এই পরিস্থিতিতে ভারতে আমেরিকার দুগ্ধজাত পণ্যের আমদানি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

বাতিল হল লাইটহাইজারের সফর

অন্য দিকে, ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির চূড়ান্ত রূপ দিতে ভারতে আসার কথা ছিল মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি রবার্ট লাইটহাইজারের। তাঁর সেই নির্ধারিত সফরের মাত্র চার দিন আগে ওয়াশিংটন তা বাতিল করায় বহুচর্চিত বাণিজ্য চুক্তির ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।

ভারতের ব্যবহারে তুষ্ট নন ট্রাম্প!

তার পর সফর শুরুর প্রায় প্রাক মুহূর্তে খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খেদ প্রকাশ করলেন যে, প্রধানমন্ত্রী মোদীকে তিনি খুব পছন্দ করলেও ভারতের কাছ থেকে আমেরিকা ভাল ব্যবহার পায়নি। তাঁর এই মন্তব্য যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

অতীতের অ্যালবাম থেকে। তখন চলছে দহরম মহরম। গত বছর, টেক্সাসে।

কারণ, একই সঙ্গে ট্রাম্পের উক্তি: ‘‘ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি আমরা করব। কিন্তু সেটা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকছে।’’ এটাও তিনি জানিয়েছেন, মার্কিন নির্বাচনের আগে তা হবে কি না, তা তাঁর জানা নেই।

ট্রাম্পের আশার গুড়ে বালি!

বস্তুত, আমেরিকা চেয়েছিল বিনা শুল্কে রফতানি করার সুযোগ নিতে গেলে ভারতকে আরও বেশি করে নানা রকমের বাদাম, ফল ও কৃষিপণ্য কিনতে হবে। ভারতে মার্কিন সংস্থা ‘হার্লে ডেভিডসন’-এর জন্য শুল্কের চড়া হারও ওয়াশিংটনের উষ্মার কারণ। ভারতের দাবি ছিল, আমেরিকায় ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের রফতানির পথ সুগম করা। আপাতত, সে গুড়ে বালি!

আরও পড়ুন: ‘মোদী তো বললেন এক কোটি মানুষ আমাকে অভ্যর্থনা জানাবেন আমদাবাদে!’

আরও পড়ুন: সিএএ, ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে ট্রাম্পের প্রশ্নের মুখে পড়তে পারেন মোদী​

কাছে আসার বদলে দূরে চলে যাওয়া

উল্লেখ্য, এ বারের বাজেটে নয়াদিল্লি হৃদরোগের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় স্টেন্ট আমদানির উপর শুল্কের পরিমাণ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা আমেরিকার বিরক্তির অন্যতম কারণ। গত মাসে আমেরিকাও ভারত থেকে আমদানি করা ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের উপর শুল্কের হার বাড়ানোয় নয়াদিল্লিও একই রকম ভাবে ক্ষুব্ধ।

তখন সুসময়। দু’জনে কাছাকাছি। গত বছর হিউস্টনে।

গত বছরেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতকে উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য প্রযোজ্য শুল্ক-ছাড়ের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ায় নয়াদিল্লির ক্ষোভ তো ছিলই। অর্থাৎ, দু’পক্ষের প্রত্যাশা ক্রমবর্ধমান হলেও দুই দেশের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ যথেষ্টই বিপরীতমুখী হয়েছে। দেশের জনসাধারণের মন রাখা আর অন্য দিকে অন্য দেশের সঙ্গে সম্পর্কের হিসাবনিকেশ, এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখার লড়াইয়ে তাই এখন দীর্ণ সম্ভবত দু’টি দেশই।

ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ আর মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’, এই দুই নীতির মধ্যে সঙ্ঘাতই নতুন ভারত-মার্কিন বাণিজ্য চুক্তির পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সফর কি শুধুই প্রদর্শনী?

এই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বহু প্রতীক্ষিত এই সফর কি শেষ পর্যন্ত এক নয়নলোভন প্রদর্শনীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?

লক্ষণীয়, ট্রাম্প আমদাবাদে প্রথম পদার্পণ করবেন বলে সেই শহরের রূপ ফেরাতে কোটি কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ করা তো হয়েছেই, এমনকি, যাত্রাপথের বস্তি যাতে বিদেশি অতিথির কাছে দৃশ্যদূষণে পর্যবসিত না হয়, সে জন্য তা ঢাকতে প্রাচীর নির্মাণের বন্দোবস্তও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী নাকি মার্কিন প্রেসিডেন্টকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, ভারতে এক কোটি লোক তাঁকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত থাকবেন।

চিনের জন্য ভারতকেও তো ছাড়া যায় না!

তবে এ বারের সফরের কেন্দ্রবিন্দুতে বাণিজ্য ও অর্থনীতি থাকলেও আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান ও সর্বোপরি চিনের সাপেক্ষে ভারত-মার্কিন শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মেধাসত্ত্বের আলোচনাও সম্ভাব্যের তালিকায়। প্রধানত, ওষুধ শিল্পকে কেন্দ্র করেই মেধাসত্ত্বের গুরুত্ব। দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, বিশেষ করে, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে এবং তাদের উপকূলবর্তী দেশগুলিতে চিনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি ও প্রভাব ভারত ও মার্কিন সরকারকে উদ্বিগ্ন করেছে। আর তাই, ইন্দো-প্যাসিফিক সংক্রান্ত আলোচনাও প্রাসঙ্গিক বই কি। ভুললে চলবে না, ভারতের আর্থিক উদারীকরণ ও ক্রমবর্ধমান বাজার ছাড়াই চিনের বিভিন্ন পদক্ষেপ ইদানীং কালে দিল্লি ও ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠতা উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়িয়েছে। কার্যত, অনেক সময়েই পারিপার্শ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি ভারত ও আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতিকে প্রভাবিত করেছে।

ট্রাম্প সিএএ, কাশ্মীর তুললে দিল্লির বিড়ম্বনা বাড়বে

ভারত সফরে এসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যদি শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বা প্রকাশ্যে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ), জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) বা কাশ্মীর প্রসঙ্গ তোলেন, তা নিংসন্দেহেই দিল্লির বিড়ম্বনা বাড়াবে। এর পরেও সাকুল্যে নতুন কয়েকটি সামরিক বোঝাপড়া বা কয়েকটি সামরিক পণ্যের প্রাপ্তি ছাড়া ভারতের ঝুলি শূন্য থাকার আশঙ্কাই এ বার প্রবল।

লেখক রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক

ফাইল ছবি

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE