Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
International Women's Day

পুরুষরা শাড়ি পরলেই ‘মেয়েলি’! লিঙ্গবৈষম্যের প্রাচীর ভাঙে এমন সাজ, মত সুজয়প্রসাদ, স্যান্ডির

কোনও বিষয়কে কি 'মেয়েলি' বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়? পেশা কিংবা শিল্প, নারী এবং পুরুষ কি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না? নারী দিবসে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

image of Sujoy Prasad and Sandy Saha

ছেলেরা ‘মেয়েদের মতো’ পোশাক পরলে কি মেনে নেয় এই শহর?  ছবি: সংগৃহীত।

সুদীপা দাশগুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ১২:২৯
Share: Save:

নারী দিবস উদ্‌যাপনের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বার বার। বলা হয়, মেয়েরা তো সব সুযোগই পাচ্ছে। নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরছে। বাইরে ঘুরতে যাচ্ছে, আয় করছে, খাচ্ছেদাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ-সুবিধা আদায়ের বিষয়েও পুরুষদের থেকে কোনও অংশেই পিছিয়ে নেই তারা! তা হলে কেন আলাদা করে ‘নারী দিবস’ পালন করা হবে? এ বার তো পুরুষ দিবসে জোর দিতে হবে, না কি! বার বারই আড্ডার আসরে এই প্রশ্ন উঠতেই থাকে। কিন্তু বিষয়টি একটু ঘুরিয়ে দেখলে কেমন হয়? সব সময়ে তো আমরা নারী দিবসে নারীদের না পাওয়া বিষয়গুলি নিয়ে কথা বলি, কখনও আবার নারীদের সফল হওয়ার কাহিনি চলে আসে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে।

নারী খোলামেলা জামা পরলে ছেলেরা কেন সে দিকে তাকিয়ে থাকে, তা নিয়ে কথা হয়। পোশাক দেখে যদি নারীদের চরিত্রের মাপকাঠি নির্ণয় করা হয়, তা হলে তা নিয়ে চলে দারুণ বিতর্ক। নারীদের কেন নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরার স্বাধীনতা নেই— তা নিয়ে তো হামেশাই সরব হন সমাজের বিদ্বজ্জনেরা! আচ্ছা ভেবে বলুন তো, ছেলেদের পোশাক পরার স্বাধীনতায় কি কখনও হস্তক্ষেপ করা হয় না? ছেলেদের কি আছে নিজের মনের মতো পোশাক পরার স্বাধীনতা? চাইলে বলতেই পারেন পুরুষকে পোশাক পরা নিয়ে আবার কবে বাধা পেতে হয়েছে? পেতে হয়েছে বইকি!

এখন যদি আপনার সামনে কোনও পুরুষ শাড়ি পরে আসেন, কিংবা হাত, কান, গলায় গয়না পরে— শুরু হয়ে যায় কোলাহল! কেন নারীর পোশাক পুরুষের পরনে, তা নিয়ে শুরু হয় জোর চর্চা। মনে পড়ে অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের স্কার্ট পরে স্টেজ ওঠার প্রসঙ্গ। সেই ছবি নেটমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর কটাক্ষ! পোশাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসেন অভিনেতা রণবীর সিংহও। স্কার্টের উপরে ব্লেজ়ার পরেই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আসেন রণবীর। অনুষ্ঠানের মাঝেই তাঁকে নিয়ে চলে ঠাট্টা-তামাশা। তবে নিন্দকদের মোটেই পাত্তা দিতে নারাজ অভিনেতা। রণবীর আছেন নিজের মেজাজেই।

Image of Puspak Sen

বিয়েবাড়ি হোক কিংবা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান, মায়ের শাড়িতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন পুষ্পক। ছবি: সংগৃহীত।

ছেলেরা ‘মেয়েদের মতো’ পোশাক পরলে কি মেনে নেয় এই শহর?

গোলাপি আর শুধু মেয়েদের রং নেই। পুরুষের রং শুধু নীল, সাদা কিংবা কালো নয়। হ্যারি স্টাইল থেকে রণবীর সিংহ, ছেলেদের চিরাচরিত ফ্যাশন-ভাবনাকে দুমড়েমুচড়ে ভাঙছেন অনেকেই। পিছিয়ে নেই শহরের ছেলেরাও। শহুরে পোলার পরনে শাড়ি! কপালে লাল টিপ! আঙুলে নেল পালিশ— এমন উদাহরণও আছে। পোশাকশিল্পী ও সমাজমাধ্যমে প্রভাবী পুষ্পক সেন। আদ্যোপান্ত কলকাতার বাঙালি। বাঁধাধরা ফ্যাশনে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে নারাজ। শাড়ি, গলাভর্তি গয়না, কপালে বড় টিপ আর সঙ্গে দাড়ি। তা নিয়েও লোকজনের কাছে কম কটাক্ষ শুনতে হয়নি তাঁকে। তবে হাল ছা়ড়েননি তিনি। গোটা পৃথিবীর মানুষ ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে যেন শাড়িকে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসাবে দেখে, সে প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে চান তিনি। তাই বিয়ে বাড়ি হোক কিংবা বিশেষ কোনও অনুষ্ঠান— মায়ের শাড়িতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন পুষ্পক। আমরা পশ্চিমি পোশাকে স্বচ্ছন্দ, তবে পশ্চিমের দেশগুলি আমাদের পোশাক সম্পর্কে কতটুকু জানে? বিশ্বের দরবারে শাড়ির কদর বাড়াতেই শাড়ি পরে বিদেশের রাস্তাতেও হাঁটেন তিনি। বিশ্বমঞ্চে ভারতীয় পোশাকের সম্ভারকে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখেন পুষ্পক।

Image of Sujoyprasad

সুজয়প্রসাদের নাকে নথ, গলায় মোটা হার, হাতের বালাজোড়াকে কি ভাল চোখে দেখে সমাজ? ছবি: সংগৃহীত।

অভিনেতা সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের সাজগোজ নিয়েও চারদিকে চর্চার শেষ নেই। তাঁর নাকে নথ, গলায় মোটা হার, হাতের বালাজোড়াকে কি ভাল চোখে দেখে সমাজ? সুজয়প্রসাদ বলেন, ‘‘সাবেকি ঐতিহ্যকে সম্মান করে যদি এখনকার প্রজন্ম পোশাক নিয়ে নতুন করে ভাবনাচিন্তা করে, তাতে ক্ষতিটা কোথায়? নারী মানেই শাড়ি— কথাটা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। আমরা নারীকে শাড়িতে দেখতে ভালবাসি, তাঁদের শাড়িতে দেখতে অভ্যস্ত বলেই আমরা ও রকম একটা ভাবনা তৈরি করে ফেলেছি। শাড়ি পরলে মানাবে কি না, সেটা পুরোটাই নির্ভর করে এক জনের ব্যক্তিত্বের উপর। আমি গোয়ায় গিয়ে এক বার শাড়ি পরেছিলাম, তবে শাড়ি পরতে অভ্যস্ত নই বলে ঠিক করে সামলে উঠতে পারিনি। এখন আর খুব একটা শাড়ি পরা হয় না, তবে শাড়ি কেটে ধুতি কিংবা প্যান্ট বানিয়ে পরি। ফ্যাশন আমাদের ব্যক্তিত্বের প্রসার। পোশাক পরে নজর কাড়তে হবে সেই ভাবনার থেকেও বড় বিষয় হল পোশাকটিকে নিজের মতো করে পরার উপলব্ধি।’’

কোনও জামাকাপড় কিনে পরার পর সেটি নিজের হল, না কি পোশাকটা পোশাকই থেকে গেল, সেটা ভাবনার বিষয়। অভিনেতার বক্তব্য, ‘‘আমার পোশাক সমাজ ঠিক করে দিতে পারে না। আমি ছেলে হয়ে শাড়ি পরতে স্বচ্ছন্দ কি না, সেটা বড় বিষয়। প্রথম প্রথম আমার সাজপোশাক সমাজের মাথাব্যথার কারণ হয়েঠিল বটে, তবে আমি এখন আর সেই সব বিষয়কে পাত্তা দিই না। আমাকে দেখে অনেক ছেলেই এখন আমার মতো করে সাজে, সেই বিষয়টি কিন্তু আমার ভীষণ ভাল লাগে। আমি অনেকের পথপ্রদর্শক হতে পেরেছি তাতেই আমি খুশি। যে সব ছেলে পোশাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে চাইছে, তাদের জন্য বলব, সমাজের বিরুদ্ধাচারণ করলে চলবে না, সমাজের সঙ্গে দর কষাকষিতে নামতে হবে। মুখোমুখি দাড়িয়ে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে, এক দিন জয় আসবেই।’’

Image of Sandy Saha

পোশাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসেন স্যান্ডি সাহা। ছবি: সংগৃহীত।

সমাজমাধ্যমে তাঁর ভিডিয়ো দেখে হেসে লুটোপুটি খান মানুষ। ইউটিউবে অনুরাগীর সংখ্য সাড়ে চার লক্ষ ছুঁই ছুঁই। তিনি স্যান্ডি সাহা। পোশাক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে ভালবাসেন তিনিও। কখনও তার পরনে লালপাড় সাদা শাড়ি, কখনও আবার স্কার্ট টপ পরতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন স্যান্ডি। কখনও গাউন, তো কখনও মেয়েদের অন্তর্বাস পরেই ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন তিনি। সবেতেই যেন নজরকাড়া স্যান্ডি! স্যান্ডি বলেন, ‘‘শাড়ি পরা মানেই কিন্তু মেয়ে হতে চাওয়া নয়। অভিতাভ বচ্চন থেকে রণবীর সিংহ, টলিপাড়ার সৌরভ দাসদাও কিন্তু স্কার্ট পরেছেন। তাই বলে তো আর তাঁরা মেয়ে হতে চাইছেন, এমনটা নয়। ভালবাসা আর রামধনুর মতো পোশাকেরও কিন্তু কোনও লিঙ্গপরিচয় থাকতে পারে না। আমি মনে করি সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রেই হোক কিংবা পোশাক বাছাই, নিজের যা মন চায়, তাকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগোঁকা কাম হ্যায় কহনা!’ মেয়েরা প্যান্ট-শার্ট পরে রাস্তায় বেরোলে তো তাঁদের লিঙ্গপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় না? এক জন ছেলে যদি শাড়ি পরে, নাকে নথ ও কানে দুল পরে তা হলে এত কথা কিসের? নিজের পছন্দটাকে গুরুত্ব দাও। লোকে এক দিন বলবে, দু’দিন বলবে, তৃতীয় দিনে তারা বলা বন্ধ করে দেবে। নিজের পরিচিতি অর্জন করার লক্ষ্যে এগোও, লোকে নিজেই তোমার থেকে অনুপ্রেরণা নেবে। হ্যাঁ, আমার মধ্যে কোথাও একটা নারীসত্তা আছে, তাই আমার মেয়েদের মতো করে সাজতে ভাল লাগে, তবে আমি কখনওই রূপান্তরিত হতে চাই না। মন থেকে নারী হলেও পুরুষদের শরীর নিয়েই আমি খুশি। তবে আমি মনে করি পোশাক নিয়ে বাছবিচার করা এ বার বোধ হয় বন্ধ করার সময় এসেছে। যিনি মন থেকে নারী, তিনিও স্বচ্ছন্দ হলে শাড়ি পরুন। আর যে সব পুরুষ ফ্যাশনের ছক ভাঙতে চাইছেন, তাঁরাও ইচ্ছা হলে শাড়ি পরুন, সমাজের পরোয়া না করেই।’’

নারী-পুরুষের খাপে বসানো চিন্তাধারার তোয়াক্কা না করে এই বিশেষ ধরনের পোশাক পরার স্টাইলকে অ্যান্ড্রোজিনাস ফ্যাশন বলে। এই ঘরানায় সাজকে কোনও লিঙ্গের মধ্যে সীমিত রাখতে নারাজ শৌখিন-শৌখিনিরা। ভারতে অনেকে এই ধরনের পোশাক পরা নিয়ে তামাশা করেন, কেউ আবার ছকভাঙা ফ্যাশনধারাকে আপন করে নিয়েছেন। প্রশ্নটা এখনও একটাই সমাজের নজরে কমে স্বীকৃতি পাবে এমন পোশাকের ধারা? কবে লোকে কোনও ছেলেকে শাড়ি পরতে দেখে পিছনে ফিরে তাকাবে না? কবে ছেলেমেয়ের মধ্যে পোশাক নিয়ে ভেদাভেদ মুছে যাবে? প্রশ্ন অনেক, উত্তর এখনও অজানা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy