গত কয়েক বছরে বঙ্গ রাজনীতিতে রংবদলের নজির কম নেই। কিন্তু অল্প সময়ে একাধিক বার রংবদলের ফলে অনেকে কার্যত ‘কিংবদন্তি’ হয়ে গিয়েছেন। কেউ পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বার দল বদল করেছেন। আবার কেউ পাঁচ বছরে তিনটি দলে গিয়েছেন। শুক্রবার রঙের উৎসবে তেমনই পাঁচ জনের সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার ডট কম। কেউ রং বদলে ফেলে অনুতপ্ত। কেউ তোয়াক্কা করেন না। কারও বক্তব্য, এখন তো আকছার এ সব হয়। কেউ বললেন, দলবদল বা রংবদল নীতির ভিত্তিতে হলে দোষ নেই।
অর্জুন সিংহ
২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ব্যারাকপুরে তৃণমূলের টিকিট না পেয়ে বিজেপিতে চলে গিয়েছিলেন। তৃণমূলের দীনেশ ত্রিবেদীর বিরুদ্ধে অর্জুন সিংহকেই প্রার্থী করেছিল পদ্মশিবির। সেই অর্জুন জিতে নিয়েছিলেন লোকসভা। কিন্তু ২০২২ সালে ফিরে যান তৃণমূলে। ২০২৪ সালে ব্রিগেড থেকে যখন তৃণমূল ৪২টি কেন্দ্রের প্রার্থী ঘোষণা করছে, তখন মঞ্চেই ছিলেন অর্জুন। কিন্তু তাঁকে ব্যারাকপুরের টিকিট দেওয়া হয়নি। প্রার্থী করা হয় পার্থ ভৌমিককে। মঞ্চ থেকে নেমেই অর্জুন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি আবার বিজেপিতে যাচ্ছেন। গিয়েছিলেন। প্রার্থীও হয়েছিলেন। কিন্তু এ বার আর জিততে পারেননি। সেই অর্জুন রংবদলের প্রশ্নে বলছেন, ‘‘এ সবের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। সময় সব কিছুর উত্তর দিয়ে দেবে।’’ তবে চুটিয়ে ‘হোলি’ খেলেছেন। সকাল থেকে শুরু করে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত।
জয়প্রকাশ মজুমদার
ছিলেন কংগ্রেস। ‘মোদীভক্ত’ হয়ে চলে গিয়েছিলেন বিজেপিতে। কিন্তু পদ্মশিবিরে জয়প্রকাশ মজুমদারের অভিজ্ঞতা ভাল নয়। ২০১৯ সালে তাঁকে করিমপুর বিধানসভা উপনির্বাচনে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। ভোটের দিনেই দুষ্কৃতীদের পদাঘাত খেয়ে রাস্তার পাশের কচুবনে মুখ থুবড়ে পড়তে হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, তৃণমূলের লোকজনই জয়প্রকাশকে হেনস্থা করেছিল। যদিও সেই জয়প্রকাশ এখন সেই তৃণমূলে। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীর ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে দলের অন্দরমহলে পরিচয় রয়েছে। জয়প্রকাশ অবশ্য রংবদল বা দলবদলকে নীতির ভিত্তিতে দেখতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘কোন দল কী নীতি নিয়ে চলছে, তা দেখে যদি বদল হয়, তা হলে তার মধ্যে কোনও অন্যায় নেই। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এই বদলের নেপথ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকে। আমি মনে করি উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা উচিত নয়। নীতিগত প্রশ্নে বদল হতেই পারে।’’ শুক্রবার রং খেলেছেন জয়প্রকাশ।
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়
২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল থেকে যে ‘ঝাঁক’ বিজেপিতে গিয়েছিল, তাতে ছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। চার্টার্ড বিমানে দিল্লি গিয়ে অমিত শাহের সঙ্গে দেখা করে পদ্ম-আঁকা উত্তরীয় পরেছিলেন। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর কেন্দ্র ডোমজুড়েই প্রার্থী করেছিল বিজেপি। কিন্তু হেরে যান তিনি। অথচ ২০১৬ সালের ভোটে ডোমজুড়ে গোটা রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবধানে জিতেছিলেন রাজীব। পাঁচ বছরের মধ্যে রং বদলে প্রার্থী হয়ে তিনিই হেরে গেলেন। ভোটের কয়েক মাস পরেই তৃণমূলে ফেরেন তিনি। তখন বিজেপিতে যাওয়া অনেকেই তৃণমূলে ফিরেছিলেন। তবে রাজীবের প্রত্যাবর্তন ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। কারণ, ত্রিপুরার মঞ্চ থেকে রাজীবকে দলে ফিরিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজীবও দোল খেলেছেন শুক্রবার। রং মেখেছেন। মাখিয়েছেনও। তবে নিজের রংবদলকে তিনি ‘অভিমানবশত ভুল’ হিসাবেই দেখেন। তাঁর কথায়, ‘‘অভিমানবশত একটা ভুল করেছিলাম। তার প্রায়শ্চিত্ত করছি। দলে ফিরে এসেছি। দলের কাজ করছি। এখন ভাল আছি।’’
আরও পড়ুন:
রুদ্রনীল ঘোষ
তিনি অভিনেতা। আবার নেতাও বটে। একটা সময়ে ছিলেন সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ের নেতা। সিপিএমের পার্টি সদস্যপদও পেয়েছিলেন। তা নিয়ে রুদ্রনীলের শ্লাঘাও রয়েছে। দ্বিতীয় বার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে আসার পরে রুদ্রনীলের তৃণমূল ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। তিনি হয়ে ওঠেন ‘তৃণমূলপন্থী’। তাঁকে সরকারি পদও দিয়েছিল রাজ্য সরকার। সেই রুদ্রনীল এখন বিজেপির ‘সক্রিয়’ নেতা। তিনি অবশ্য দল বা রংবদল নিয়ে আদৌ কুণ্ঠিত নন। তাঁর কথায়, ‘‘দেশের আইনে তো এমন কথা বলা নেই যে, বদল করা যাবে না। সরকার পাল্টায়, ভোটের শতাংশের হার পাল্টায়, সাধারণ মানুষ তাঁদের মতামত পাল্টান, রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের নীতি বদলায় আর এক জন মানুষ তাঁর মত পাল্টাতে পারেন না?’’ রুদ্রনীল দোলের দুপুরে গিয়েছিলেন সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’ নিয়ে আড্ডায়। সেখানেই অল্পবিস্তর আবির লাগিয়েছেন কপালে।
তাপসী মণ্ডল
দলবদলের ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ সংযোজন হলদিয়ার বিধায়ক। ২০১৬ সালে সিপিএমের টিকিটে জিতেছিলেন তাপসী মণ্ডল। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গেই বিজেপিতে যোগ দেন। একদা ‘কমরেড’ তাপসীকে হলদিয়ায় প্রার্থী করেছিল পদ্মশিবির। তাপসী জিতেছিলেন। দিন তিনেক আগে বিজেপি থেকে যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। পেয়ে গিয়েছেন সরকারি পদও। তাপসী দলবদলকে এখন ‘স্বাভাবিক’ বলেই বর্ণনা করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনীতিতে এই রংবদল এখন আকছার হচ্ছে। নতুন তো নয়। অনেকেই নানা প্রয়োজনে বদল করেন। আমিও হলদিয়াবাসীর প্রয়োজনে বদল করেছি।’’ তবে তাপসী শুক্রবার রং খেলতে পারেননি। জ্বরে গৃহবন্দি ছিলেন দিনভর। তবে পরিচিতেরা তাঁর বাড়িতে গিয়েছেন। ঘরে বসে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন তাপসী।