নারীর লড়াই নিয়ে যতটা মুখর হয় চারপাশ, কিছু ক্ষেত্রে কি পুরুষের লড়াই ঢাকা পড়ে যায় সেই কলরবে? প্রতীকী ছবি।
পেশার সঙ্গে লিঙ্গ পরিচয়ের কি কোনও সম্পর্ক আছে? এ প্রশ্নটি মনের গহিনে জন্ম নিয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে, একটি ঘটনার সূত্র মারফত। নৃত্যকলায় যতই উদয়শংকর, বিরজু মহারাজদের গৌরবের ঔজ্জ্বল্য থাক, নাচের সঙ্গে একমাত্র নারীরই যেন অমোঘ যোগ। পুরুষ হয়ে দশটা-পাঁচটার সরকারি চাকরি না করে, নাচের মতো এমন ‘মেয়েলি’ পেশাকে বেছে নেন যাঁরা, তাঁদের কতটা কোণঠাসা হতে হয়, সেটা অনেকেরই জানা।
শুধু নাচ নয়, সমাজে এমন বেশ কিছু কাজের বিকল্প রয়েছে, যে ক্ষেত্রগুলিতে মেয়েদের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের আবহে সে কথা জেনে মনে একটা তৃপ্তি হয় বটে। যে ভূমিকায় নারীকে দেখতে স্বচ্ছন্দ সমাজ, সেই পেশায় ছেলেদের লড়াই কতটা? অন্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে ভাবে নারীকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়, সেই একই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কি যেতে হয় পুরুষকেও?
নার্স বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে নারীর অবয়ব। সেবা আর যত্ন যে নারীর হাতেই ভাল হয়। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত নার্স হিসাবে মহিলাদের প্রাধান্য ছিল সবচেয়ে বেশি। সময় বদলেছে। পাল্টেছে যুগ। নার্সের পেশায় এগিয়ে আসছেন পুরুষরাও। ইদানীং এই সংখ্যা আরও বেড়েছে।
এম আর বাঙুর হাসপাতালের ‘ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট’-এ ‘ব্রাদার’ (পুরুষ নার্সদের এই নামেই ডাকা হয়) হিসাবে দীর্ঘ ৭ বছর ধরে কাজ করছেন আব্দুল কাইম। এমন একটি পেশা বেছে নেবেন শুনে প্রথম বাড়ির লোক একটু নাক সিঁটকেছিলেন। কিন্তু মানুষের সেবা যে পেশার আসল লক্ষ্য, সেই পথে হাঁটতে আর বাধা দেননি বাবা-মা। বাড়িতে কোনও বাধা না পেলেও কর্মক্ষেত্রে কি কোনও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি? অনেক সময় রোগী যদি মহিলা হন, সে ক্ষেত্রে একজন মহিলা নার্সের সেবা নিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। রোগী কিংবা তাঁর পরিবারের তরফে এমন কোনও আপত্তি কি কখনও পেয়েছেন আব্দুল? তাঁর কথায়, ‘‘এখনও পর্যন্ত এমন কোনও পরিস্থিতি আসেনি, যাতে মনে হয়েছে এই পেশায় এসে ভুল করেছি। নার্স হিসাবে মহিলাদের একটা প্রাধান্য আছে বটে। কিন্তু পুরুষদেরও কম নেই। আমি এমন একটি বিভাগের দায়িত্বে রয়েছি, যেখানে লিঙ্গ নয়, দক্ষতাই একমাত্র বিচার্য। তবে এটা ঠিক যে, মহিলা নার্সদের কাছে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করেন মহিলা রোগীরা। কিন্তু কারও যদি শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়, এমন রোগীর দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই দেওয়া হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মনে করেন, সঙ্কটপূর্ণ রোগীকে সামলাতে পুরুষরা বেশি সমর্থ।’’
নারীর দক্ষতা নিয়ে এই অনুসন্ধিৎসা যেন চিরন্তন। দক্ষতার সঙ্গে নারীর যেন আজীবনের বিচ্ছেদ। কোনও একটা ক্ষেত্রে নারী এগিয়ে আছে মনে হলেও দিনের শেষে সেই জিতে যান পুরুষরাই। মালদহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ব্রাদার হিসাবে বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন রাজ্জাক টিপু। আব্দুলের মতো তাঁর কর্মক্ষেত্রেও খুব যে অসুবিধা হয়েছে তা নয়। দু’-একটা ছোটখাটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সে সব নেহাতই মামুলি। সেগুলি থেকে কোনও সিদ্ধান্তে আসা ঠিক নয় বলেই মনে করেন তিনি। টিপুর কথায়, ‘‘আমি নার্স হতে চাই শুনে, আমার মা বলেছিলেন, এ সব তো মেয়েদের কাজ। তুই কী করে করবি? অনেকেই এমন ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু আমরা যাঁরা এই পেশার সঙ্গে যুক্ত, লিঙ্গপরিচয় দিয়ে আমরা বিচার করি না। আমাদের কাছে প্রত্যেকেই রোগী। অসুস্থতার পর্যায় থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সেবাযত্ন করে সুস্থতার পথে ফিরিয়ে আনাই আমাদের কাজ। পুরুষ হিসাবে যে আমরা এই পেশাতে ব্রাত্য, সত্যি এমন কখনও মনে হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে ব্রাদারদের চাহিদা অনেক বেশি থাকে মহিলা নার্সদের তুলনায়।’’
নারীর লড়াই নিয়ে যতটা মুখর হয় চারপাশ, কিছু ক্ষেত্রে কি পুরুষের লড়াই ঢাকা পড়ে যায় সেই কলরবে? তেমনটা অবশ্য মনে করেন স্ত্রী রোগ চিকিৎসক শৌভিক হাজরা। পাশ করার পর কয়েক বছর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করেছিলেন। বর্তমানে তিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। সপ্তাহে তিন দিন চেম্বারে বসেন তিনি। কিন্তু রোগী আসেন হাতেগোনা কয়েক জন। মেয়েলি রোগের চিকিৎসা করাতে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে আসতে কি লজ্জা পান মহিলারা? চিকিৎসক বলেন, ‘‘হতে পারে। নিজেদের শারীরিক সমস্যা নিয়ে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে খোলাখুলি আলোচনা করতে অস্বস্তি বোধ করেন অনেকেই। আমার এক জন মহিলা সহকারী রয়েছেন। তা সত্ত্বেও এই অস্বস্তি কাটতে চায় না রোগীদের।’’ এমবিবিএসের পর স্ত্রীরোগ নিয়ে পড়ার কথা শুনেই বাড়ি থেকে প্রথমে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু শৌভিক শোনেননি। জোর করে পড়েছিলেন। তা নিয়ে অবশ্য কোনও আফশোস নেই তাঁর। তিনি বিশ্বাস করেন, যে কজন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসতে চান, তাঁদেরই চিকিৎসা করবেন। রোগীরও একশো শতাংশ অধিকার রয়েছে কোনও চিকিৎসকে তাঁকে সুস্থ করে তোলার ভার দেবেন, তা বেছে নেওয়ার।
চিকিৎসকের কথার অনুরণন শোনা গেল অন্য এক স্ত্রী রোগের চিকিৎসক বাসব মুখোপাধ্যায়ের গলাতেও। পরিবারে তিনি প্রথম নন, তাঁর আগের তিন পুরুষও স্ত্রী রোগের নামজাদা চিকিৎসক ছিলেন। তাঁদের কোনও অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়েছিল কি না জানা নেই। কিন্তু প্র্যাকটিস শুরুর প্রথম দিকে, বেশ কয়েক বার এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসকের নাম বোধহয় খেয়াল করেননি আগে। দেখাতে এসে ঘরে পুরুষ চিকিৎসককে দেখে পালিয়ে গিয়েছেন মহিলা রোগী। যে রোগের কথা খানিক কানে কানে বললেই ভাল হয়, তা নিয়ে পুরুষ চিকিৎসকের কাছে অকপট হতে পারেন না অনেকেই। চিকিৎসক জীবনে ফলে এমন কিছু ঘটনা ঘটেই যায়। চিকিৎসক বলেন, ‘‘এমনও হয়েছে, গর্ভাবস্থার ৯ মাস আমিই চিকিৎসা করেছি। কিন্তু অস্ত্রোপচার আমার কাছে করাতে চাননি। মহিলা কোনও চিকিৎসককে ঠিক করে দিতে বলেছেন। আমি মেনে নিয়েছি। জোর করে তো কিছু হয় না। তা ছাড়া রোগীর স্বাচ্ছন্দ্যটাই আসল। আমরা জোর করতে পারি না। নারী হোক বা পুরুষ, সব পেশাতেই সকলেরই একটা লড়াই থাকে। তা নিয়ে বসে থাকা বোকামি। এখন বলে নয়, আমি যখন এই বিষয়টি নিয়ে এমডি করছিলাম, সেখানেও আমার মহিলা সহপাঠীরা বেশি সুযোগ পেতেন। বিষয়টা যে কিছুটা এ রকম হবে, তার আভাস আগেই পেয়েছিলাম। এখন সেগুলির মুখোমুখি হচ্ছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy