বছর পঞ্চান্ন বয়স হওয়ার পরে বাবার যখন অ্যালঝাইমার্স ধরা পড়েছিল, মা হারা শ্রীতমার বয়স তখন কুড়ি। আরও কুড়ি বছর বেঁচেছিলেন বাবা। রোজকার ছোট ছোট কাজে পদে পদে ভুল হতো। যখন-তখন বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, চিকিৎসা চলবে চিকিৎসার মতো। কিন্তু এ অসুখকে বেঁধে রাখতে পারে পরিবারের মানুষের যত্ন, শুশ্রূষা, মমতাই। এ ভাবেই বাবার দেখাশোনা চালিয়ে যেতে গিয়ে আর বিয়ে করা হয়নি শ্রীতমার।
পারকিনসন্সে আক্রান্ত স্ত্রী-র দেখাশোনা করতে গিয়ে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করতে হয়েছিল ব্যাঙ্ককর্মী পবিত্র চক্রবর্তীকে। চিকিৎসকের কথা শুনে, আয়ার হাতে সেবার ভার তুলে দিতে মন চায়নি। এ ক্ষেত্রেও নিজের মানুষের সাহচর্য এবং যত্নই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দীর্ঘ দশ বছর ধরে স্ত্রী-র খেয়াল রাখতে রাখতে অবসাদের শিকার পবিত্রবাবু নিজে। নিয়মিত কাউন্সেলিং করাতে হয় তাঁকে।
ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত অমলবাবুর থেকে মুহূর্তের জন্যও দূরে যাওয়া সম্ভব ছিল না স্ত্রী মৌসুমীর। বছর চল্লিশের পরে চোখে ছানি পড়েছিল। অস্ত্রোপচারের সময় পাননি। বাড়াবাড়ি হয়ে যখন প্রায় অন্ধত্বের পর্যায়ে পৌঁছয়, তখন আর ফেরার পথ নেই।
চিকিৎসকেরা বলছেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অ্যালঝাইমার্স, পারকিনসন্স বা ডিমেনশিয়ার মতো রোগের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময়েই দেখা যায়, রোগীর কাছের কোনও মানুষের জীবনে এর বড়সড় প্রভাব পড়েছে। কারণ এ ধরনের যে কোনও স্নায়ুরোগ ধরা পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা ও সেবা দরকার। রোগীর প্রাত্যহিক জীবনের মান বাড়ানো, তাঁকে যথাযথ সম্মান, সঙ্গ এবং সেবা দেওয়া। রোগী ও তাঁর পরিবারের রোজকার কর্মতালিকার মধ্যে সমন্বয় আনার মাধ্যমেই এ সব রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ওষুধের থেকেও এই সেবাই বেশি জরুরি। আর এই সেবা যাঁরা করে থাকেন, তাঁদেরই পোশাকি নাম— ‘কেয়ার গিভার’। ইদানীং বেশ কিছু ঘটনায় এমন রোগীদের কেয়ার গিভারের প্রসঙ্গ সামনে এসেছে। তাঁদের নিয়ে যতটা সচেতন হওয়া দরকার, তার অভাবই বারবার প্রকট হয়ে উঠেছে সে সব ঘটনায়।
‘অ্যালঝাইমার্স অ্যান্ড রিলেটেড ডিসঅর্ডার সোসাইটি’-র সম্পাদক নীলাঞ্জনা মৌলিকের মতও সে রকমই। তিনি জানালেন, এ দেশে এ ধরনের রোগ নিয়ে যতটুকুও বা সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তার কিছুই হয়নি কেয়ার গিভারদের নিয়ে। ‘‘আমরা যেন ধরেই নিই, পরিবারের সদস্যের অসুখ হলে তাঁর সেবা করাটা কর্তব্য। সব অসুখ যে এক নয়, কিছু অসুখের সেবা-যত্ন করা মানুষও যে আলাদা গুরুত্ব দাবি করেন, সেই বোধটাই গড়ে ওঠেনি,’’ বলেন নীলাঞ্জনা।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ধাক্কাটা সব চেয়ে তীব্র হয়, প্রথম অসুখ ধরা পড়ার সময়। এক জন সুস্থ মানুষ হঠাৎ সব খুঁটিনাটি ভুলতে শুরু করেন। ভুলে যান, কেমন করে খাবারের গ্রাসটা তুলে মুখ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। এমনকী বাথরুমে যাওয়ার প্রয়োজন হলে রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। বস্তুত অসহায় হয়ে পড়েন তিনি। সেই সমস্যাগুলো যত্নের সঙ্গে সামলানো, পরিবারের মানুষের পক্ষে খুব কঠিন। কারণ সেই মানুষটাও তো অনভিজ্ঞ।
নীলাঞ্জনা জানালেন, যে মানুষ যত তাড়াতাড়ি কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেন, তিনি তত তাড়াতাড়ি ভাল কেয়ার গিভার হয়ে উঠতে পারেন। অনেকেই বহু বছর ধরে কেয়ার গিভারের ভূমিকা পালন করেও ভাল থাকেন। অনেকে আবার খুব অল্প দিনের কেয়ার গিভিংয়ের পরেই অবসাদে চলে যান। ‘‘বস্তুত, পরিবারের সদস্য থেকে কেয়ার গিভার হয়ে ওঠার পথটা খুব কঠিন। সময়ে খাওয়া-ঘুম ছুটে যায়। শখ-আহ্লাদ ঘুচে যায়। বাড়ি থেকে বেরোনোও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থায়, কেয়ার গিভারকে ভাল রাখতে আশপাশের মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। তাঁদের যথেষ্ট উৎসাহ দেওয়া জরুরি। তাঁদের বোঝানো দরকার, তাঁরা শুধু লড়াই-ই করছেন না, প্রতি মুহূর্তে জিতছেনও,’’ বললেন তিনি।
মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদার দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন এমন রোগী এবং কেয়ার গিভারদের নিয়ে। তিনি জানালেন, ৫০% ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এ ধরনের স্নায়ুরোগীর কেয়ার গিভার যাঁরা, তাঁরা একটা সময়ের পরে অবসাদে আক্রান্ত হন। তাঁদের চিকিৎসা তখন মূল রোগীর থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ‘‘মেয়ে-বৌ-স্বামী-ছেলে থেকে ‘কেয়ার গিভার’ হয়ে ওঠার যাত্রাটা অনেকের জন্যই মসৃণ হয় না,’’ বললেন তিনি।
জ্যোতির্ময়বাবু জানালেন, বিদেশে ‘কেয়ার গিভার’ বিষয়টি একটি পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। টাকার বিনিময়ে কয়েক ঘণ্টার জন্য কেয়ার গিভারের দায়িত্বে রোগীকে রেখে একটু নিজের মতো সময় কাটাতে পারেন পরিবারের সদস্যেরা। সেই ‘কেয়ার গিভার’ও দায়িত্বের নিয়ে যত্ন করেন রোগীর। ‘‘এ দেশে এমন ব্যবস্থা নেই। বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হয় না। আয়া বা নার্সের সঙ্গে কেয়ার গিভারের যে অনেক পার্থক্য, সেই ধারণাই স্পষ্ট নয়। আমরা একটা চেষ্টা শুরুও করেছিলাম, পেশাদার কেয়ার গিভার নিয়োগ করার। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। পেশাদারিত্বের অভাবের অভিযোগও এসেছিল কারও কারও বিরুদ্ধে,’’ বললেন তিনি।
৭৭ বছরের জি রামামূর্তি, চার বছর ধরে এ ভাবেই দেখাশোনা করছেন ডিমেনশিয়া আক্রান্ত স্ত্রী রেখা মুখোপাধ্যায়ের। রামামূর্তি জানালেন, এত প্রাণচঞ্চল মহিলা, যিনি তুখোড় ট্যুর গাইড ছিলেন, অবসরের পরে সুচারু ভাবে সামলেছেন সংসার, তিনি হঠাৎ শিশুর মতো ব্যবহার শুরু করেন। প্রথমে এটা মেনে নিতে পারেননি তিনি। ‘‘এতটা বয়সে পৌঁছে জীবনটা বদলে ফেলতে হয়েছিল রাতারাতি। ও হিংসাত্মক হয়ে উঠত। কারও কথা শুনত না আমার ছাড়া। ধীরে ধীরে অভ্যেস করেছি। আজ আমি এক জন সফল ‘কেয়ার গিভার’।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy