বছর তেরোর অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী তৃষার পরীক্ষার ফল লাগাতার খারাপ হচ্ছে। নিয়মিত গানের স্কুলেও যেতে চায় না। স্কুল থেকে ফিরেই সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে স্মার্টফোনে ডিজিটাল গেম। বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতেও আগ্রহ নেই। কয়েক মাস পরে তৃষার মা তাঁর চিকিৎসক বন্ধুকে সমস্যার কথা জানালে তিনি জানান, ‘গেম-অ্যাডিকশন’-এ ভুগছে ওই ছাত্রী।
দশম শ্রেণির পড়ুয়া শৌভিকের বাবাকে বার চারেক তলব করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। শৌভিক লুকিয়ে ফোন নিয়ে যায় স্কুলে। বাড়িতেও টানা তিন থেকে চার ঘণ্টা সে স্মার্টফোনে মজে থাকে, জানান শৌভিকের মা। কোনও জরুরি কাজেও পর্দা থেকে চোখ সরে না। স্কুল শিক্ষকদের পরামর্শেই ছেলেকে মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক জানান, মদ কিংবা মাদকে আসক্তির মতোই শৌভিকও ‘কম্পিউটার গেমে’ আসক্ত।
সম্প্রতি ভিডিয়ো গেম কিংবা ডিজিটাল গেমের প্রতি আসক্তিকে ‘মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা’ তকমা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কলকাতার মতো বড় শহরের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও ভিডিয়ো গেম কিংবা ডিজিটাল গেমে আসক্তি বাড়ছে। ফলে আচরণগত পরিবর্তন হচ্ছে। ১২-২০ বছর বয়সিদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে।
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের কথায়, ‘‘এই আসক্তি সম্পর্কে সতর্ক হওয়া জরুরি। তবে আসক্তির মাপকাঠি সম্পর্কেও অভিভাবকদের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। মোবাইল ব্যবহার কিংবা ভিডিয়ো গেম খেললেই আসক্ত তকমা দেওয়া ঠিক নয়। তাতে অন্য সমস্যা তৈরি হবে।’’
হু-এর তরফে এই আসক্তির মাপকাঠিও জানানো হয়েছে। দিনের মধ্যে ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ভিডিয়ো গেম খেললে কাউকে আসক্ত বলে মনে করা হবে। খেলার কারণে পরিবার কিংবা পড়াশোনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগ্রহ হারানোও আসক্তির অন্যতম লক্ষণ। এ ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের হাঁটাচলা, দৌড়নোর মতো কাজ কমতে থাকে, ফলে শারীরিক দক্ষতা কমে। ঘুম কমে যায় বলে জীবনযাপনের ধারাও বদলাতে থাকে। মনোরোগ চিকিৎসক সুজিত সরখেল জানাচ্ছেন, নিত্যদিনের কাজে পড়ুয়ারা যত সময় কম দেবে, আসক্তির মাত্রা ততই বেশি বলে বোঝা যাবে। তাঁর কথায়, ‘‘কম বয়সিদের একাংশ দিনে প্রায় ছ’ঘণ্টা ডিজিটাল গেমে বরাদ্দ করছে। যা দৈনন্দিন রুটিনে বদল আনছে।’’
যষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পড়ুয়া বিশেষত ছাত্রদের মধ্যে গেমে আসক্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি বলে জানাচ্ছেন যাদবপুর বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক পরিমল ভট্টাচার্য। তিনি জানান, স্কুলে স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। নিয়ম ভাঙলে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলা হয়। কর্মশালার আয়োজন করে পড়ুয়াদের ডিজিটাল আসক্তি সম্পর্কে সচেতন করা হয়।
এ দিকে নজর রেখেই স্মার্টফোন ব্যবহার নীতি তৈরি হয়েছে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে। স্কুলের তরফে কৃষ্ণ দামানি জানান, বছর তিনেক আগেই এ বিষয়ে নজরদারি চালিয়ে কর্তৃপক্ষ স্মার্টফোনে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত নেন।
স্কুলের পাশাপাশি আসক্তি ঠেকাতে অভিভাবকদের নজরদারিও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। স্কুলে স্মার্টফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাড়িতে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। অনেক সময়ে সন্তানদের হাতে মোবাইল তুলে দিয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছেন বাবা-মায়েরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাড়িতেই আসক্তি তৈরি হয়। মনোরোগ চিকিৎসক পারমিত সোনি জানান, অনেক প়ড়ুয়ার পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ থাকে না। তাই গেমে আসক্ত হয়, আবার অনেকে গেমে আসক্ত হওয়ায় পড়ায় মনোযোগ হারায়। সেটা নজরে রেখে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। এই ধরনের খেলায় সহজেই সাফল্য পাওয়া যায়, তাই আসক্তি দ্রুত বাড়ে। এ জন্য নানা থেরাপি রয়েছে। তবে প্রথমেই প্রয়োজন স্মার্টফোন কিংবা ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ কমানো।
এ শহরে এখনও ডিজিটাল আসক্তি মুক্তি কেন্দ্র তৈরি হয়নি। তবে আসক্তি যে হারে বাড়ছে, তাতে অচিরেই এরকম কেন্দ্র তৈরির প্রয়োজন হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy