Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘বাতিকগ্রস্ত শুচিবাইয়ের রোগী’ বলে ব্যঙ্গের খোরাক! কেন হয় এ সমস্যা?

হাত ধুচ্ছেন তো ধুচ্ছেনই, পরিষ্কার জিনিসও মুছে চলেছেন, জল ঘাঁটছেন সকাল-রাত, সকলের কাছে ‘বাতিকগ্রস্ত শুচিবাইয়ের রোগী’ বলে ব্যঙ্গের খোরাক। সমস্যা নিয়ে লিখেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুপর্ণা রায়চট্টোপাধ্যায় এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, ওসিডি খুবই মারাত্মক একটি রোগ এবং পৃথিবীর দশটা রোগের মধ্য এর স্থান তৃতীয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে রোজগার করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ফলে জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়।

শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:১০
Share: Save:

একই কাজ বারে-বারে করে চলেছেন। মন ছটফট সব সময়। শুচিবাইয়ে অস্থির। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘অবসেসিভ কম্পালশিভ ডিসঅর্ডার’ বা ওসিডি। যদি কোনও একটি কাজে কেউ দিনে আট ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ব্যয় করে তখন তা চরম পর্যায়ে চলে যায়। বহু মানুষের শুচিবাই এমন স্তরে পৌঁছে যায় যেখান থেকে তিনি প্রবল উদ্বেগ ও অবসাদ বা ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকেন।

ওসিডি-আক্রান্তের অস্থিরতা নানা রকমের হতে পারে। কখনও তাঁর মনে হয় হাতটা ভাল করে ধোওয়া হল না। কিছুতেই তেল যাচ্ছে না। তখন তিনি বার-বার হাত ধুতেই থাকবেন। বাড়ির কাজের লোক ঘর মোছার পর মনে হবে, মোছাটা ভাল হয়নি। সব দিতে নোংরা রয়ে গিয়েছে। তখন তিনি বার-বার মোছা ঘর মুছতেই থাকবেন। এক বার টাকা গোনা হয়ে গেলে তাঁর মনে হয়, ভাল করে গোনা হল না। বার বার গুনতেই হবে। কেউ বার বার ঠাকুরকে প্রনাম করতেই থাকেন। দরজায় তালা দেওয়ার পরও মনে হয় তালাটা দেওয়া হয়নি। ধূপ নিভিয়ে বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর মনে হবে ভাল করে নিভল না। তখন আবার বাড়ি ফিরে এসে পরীক্ষা করে অনেকেই দেখেন তালা দেওয়া হয়েছে কিনা বা ধূপ নেভানো আছে কিনা। সেটা না-করলে তাঁর ভিতরে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়। অবসেশনগুলি রোগীর মাথায় গেঁথে যায়। বার-বার না চাইতেও চিন্তাগুলি এসে যায়। চাইলেও এর বাইরে বেরোতে পারেন না।

এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মত অনুযায়ী, ওসিডি খুবই মারাত্মক একটি রোগ এবং পৃথিবীর দশটা রোগের মধ্য এর স্থান তৃতীয়। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে রোজগার করার ক্ষমতা হারিয়ে যায়। ফলে জীবনযাত্রার মানের অবনতি হয়। এমনকি, ওসিডি মানুষকে এতটাই যন্ত্রণা দেয় যে, তার ফলে মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতার জন্ম হয়। ধরা যাক কারও মনে হলো, তাঁর হাতে বা গায়ে ময়লা লেগে আছে। যদিও তিনি ভাল করেই জানেন কোথাও ময়লা নেই, কিন্তু চিন্তাটি বার বার আসতে থাকে এবং তিনি বার বার হাত ধুতে যান। বার বার সাবান ব্যবহার করতে থাকেন। ময়লার ভাবনাটা মনে চিরস্থায়ী ভাবে গেঁথে যাবে। ফলে তাঁর সঙ্গে কেউ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি সে দিকে মনোযোগ দিতে পারবেন না। তাঁর মনের কোনে ভেসে উঠবে নোংরা হাতের চিত্র। এটি মানুষের সামাজিক জীবন, কর্মজীবন ও পড়াশোনার জগতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে।

বাতিক নিয়ে কিছু কথা

• ওসিডি-র ফলে মানুষের মনে এমন এক বদ্ধমূল ধারণার জন্ম হয়, যা তার কাছে শেষ পর্যন্ত অভ্যাসে পরিণত হয়। বাধ্য হয়ে এই সময় মানুষ একটা কাজ বার বার করতে থাকে।

• রোগী নিজে জানেন যে, হেন আচরণের কোনও অর্থই হয় না, সেটা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং বাড়াবাড়ি। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

• ওসিডি-র লক্ষণগুলি বেশ জটিল এবং এর বহিঃপ্রকাশ এক-এক জনের ক্ষেত্রে এক-এক রকম হয়।

• সব কিছুর মধ্যেই দূষণের সম্ভাবনা দেখা এবং তা দূর করার জন্য বারবা র ধোয়া-মোছার প্রবণতা যেমন ওসিডি-র পূর্বাভাস হিসেবে চিহ্নিত হয়

• ওসিডি-র আরেকটি লক্ষণ হল, দৈনন্দিন কাজের ক্ষেত্রে সন্দেহ দানা বাঁধা, এক কাজ বার বার করা বা তা যথাযথ হয়েছে কি না তা ক্রমাগত পরীক্ষা করা।

• শিশুদের মধ্যেও ওসিডি-র সমস্যা হতে পারে এবং তার প্রভাব তার যৌবনকাল পর্যন্ত স্থায়ী থাকতে পারে। ১০০ জন শিশুর মধ্যে ১ জনের মধ্যে ওসিডি-র লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।

এখানে ময়লার চিন্তাটি হলো ‘অবসেশন’, আর হাত ধোয়াকে বলা হবে ‘কম্পালশান’। এ দুটি মিলিয়েই রোগের নাম ‘অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার’ যাকে বাংলায় ‘শুচিবায়ু’ বলা হয়। এক জন ছাত্র বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে একটি বইয়ের একটি পৃষ্ঠাই বার বার পড়েছে। কারণ, পরের পৃষ্ঠায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে হচ্ছে, আগের পৃষ্ঠা ভাল ভাবে পড়া হয়নি। উদ্বেগ কমাতে গিয়ে কম্পালশনের আশ্রয় নেন মানুষ। তখন সে একই কাজ বার বার করতে থাকে। সমীক্ষায় প্রকাশ, অবসেশনে ভুগতে থাকা ৯৬ শতাংশ রোগীই বুঝতে পারেন, তিনি ঠিক করছেন না, তবুও করেই যান। এই অবস্থাও খুব ভয়ঙ্কর। এতে করে বাইরের জগত নিয়ে রোগী ভাবেন না।

এই রোগে আক্রান্ত পড়ুয়ারা পরীক্ষার হলে গিয়ে কয়েকটা অঙ্ক করার পরেই সেগুলি ঠিক হয়েছে কিনা বার বার হিসেব কষে দেখতে থাকে। ফলে বাকি অঙ্কগুলো করতেই পারে না। তার আগেই পরীক্ষা শেষের ঘণ্টা বেজে যায়। এরা অনেকসময় অবসাদে চলে যান, বার বার হাত ধোওয়া বা জল ঘাঁটার জন্য চামড়া সাদা হয়ে যায়। হাত-পায়ে ঘা হয়, ঘুম কমে যায়। অনেকে আবার মাথায় চুল ছেঁড়েন। নখ কামড়ান। চামড়া তোলেন। চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে মাথায় অনেকের টাক পড়ে যায়।

ওষুধে অনেক ক্ষেত্রে রোগী পুরোপুরি ভাল হয়ে যায়। অন্তত ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।

চিকিৎসা বিজ্ঞান জানাচ্ছে, শতকরা ৪৫ থেকে ৬৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জিনগত কারণে এই রোগ হয়। পরিবেশগত কারণ তো রয়েছেই। যেমন, এক জন ছোট বেলায় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, বড় হয়ে তিনি সময় ভাবতে থাকেন, কী ভাবে সে শুদ্ধ হবে, সেই পন্থা খুঁজতে গিয়ে তিনি অবসেসিভ কম্পালশন ডিসঅর্ডারের শিকার হয়ে পড়েন। আধুনিক চিকিৎসায় এ থেকে বের হওয়ার অনেক পন্থা রয়েছে। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি এ ক্ষেত্রে ভাল কাজ দেয়। অনেক ওষুধরও রয়েছে। মস্তিষ্কের যে অংশ রোগীকে একই কাজ বার বার করাচ্ছে ওষুধগুলি সেই অংশে ক্রিয়া করে। রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। রোগ আরও বেড়ে গেলে ইলেকট্রো কনভালসিভ থেরাপি, সার্জিক্যাল থেরাপি দেওয়া হয়। শেষের দুটির জন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়।

শুচিবায়ুতে নাজেহাল ছোটরাও

• কেউ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালবাসেন নাকি তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত কী করে তা বোঝা যাবে?

উত্তর: কেউ যদি একই কাজ দিনে এক ঘণ্টা বা তার বেশি সময় ধরে করতে থাকেন তা হলে তাঁকে শুচিবায়ুগ্রস্ত বলে ধরা হবে।

• বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কি এই সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: অবশ্যই হতে পারে। দশ বছরের নীচে অনেক শিশুই এই সমস্যা নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে আমাদের চেম্বারে আসে ।

স্কিৎজোফ্রেনিয়া বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারের থেকেও ওসিডি অনেক প্রচলিত একটি অসুখ।

• অনেকে স্নানে ঢুকলে আর বার হতে চান না। প্রচুর জল অপচয় করেন। কী করণীয়?

উত্তর: ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ ছাড়াও আচরণগত কিছু থেরাপি আছে। তা করা যেতে পারে।

• অনেকেই বার বার কিছু মুছে বা ধুয়েই চলেছেন। এটা কী ভাবে সামলানো যাবে?

উত্তর: এটাও এক ধরনের অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার। বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছলে অবশ্যই মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

ওসিডি-র সমস্যা খুব ছোট আকারে দেখা দেয় এবং বেশির ভাগ সময়েই তা সঠিক ভাবে চিহ্নিত হয় না।

• অনেকের ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক রয়েছে। ভাবেন, জিনিসপত্র সব এঁটো হয়ে গেল বা তাঁদের শরীর, জামাকাপড় অপবিত্র হয়ে গেল। কী করণীয়?

উত্তর: কেউ এটা করলে ভাবতে হবে তিনি মানসিক ভাবে পুরোপুরি সুস্থ হন। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

• এটা কি বংশগত?

উত্তর: অনেক ক্ষেত্রেই বংশগত। বাবা-মায়ের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা থাকলে সন্তানের মধ্যেও তা আসতে পারে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE