Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

ক্রিকেটের মুখ ঢেকেছে কুৎসার যুদ্ধে

নিজের দেশকে উগ্র সমর্থন করতে গিয়ে কদর্যতার আশ্রয় এবং দেশপ্রেম— এ দু’টি বিষয়কে এক আসনে রাখতে নারাজ কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও সম্পাদনার জায়গা থাকে না। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নেয় অশালীনতা।

আজ মহারণ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। তারই আগে সরগরম জার্সির দোকান। শনিবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

আজ মহারণ। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে মুখোমুখি ভারত ও পাকিস্তান। তারই আগে সরগরম জার্সির দোকান। শনিবার, ধর্মতলায়। নিজস্ব চিত্র

তিয়াষ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ১২:৫০
Share: Save:

উপলক্ষ একটা ক্রিকেট ম্যাচ। কিন্তু তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন যুদ্ধের উপক্রম। সে যুদ্ধের অস্ত্র, দেওয়াল উপচে পড়া রাশি রাশি উস্কানিমূলক এবং অশালীন পোস্ট।

যে কোনও সংবেদনশীল বিষয়কে নিয়েই সমাজে কিছু মত-পাল্টা মত তৈরি হয়। এ অভ্যাস চিরকালীন। কিন্তু, তার প্রকাশ এত নগ্ন এবং লাগামছাড়া হওয়ার সুযোগ ছিল না প্রাক্-সোশ্যাল মিডিয়া যুগে। তা কোনও বিশেষ এলাকার
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অভাবই হোক, বা সাম্প্রতিকতম ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচই হোক। ইদানীং প্রতিটা বিষয় নিয়ে নানা রকম কদর্য পোস্টে ভরে ওঠা সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল। তা এতই তীব্র, যে কখনও ধর্ষণের সঙ্গে তুলনা করা হয় খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের হারকে। কখনও চূড়ান্ত অপমানজনক ব্যক্তিগত আক্রমণে বিদ্ধ করা হয় কোনও খেলোয়াড়কে। প্রতিবাদ বা পাল্টা মত এলে, অবাধে ছোটানো যায় কদর্যতর গালি।

প্রশ্ন ওঠে, মতাদর্শের পার্থক্য যতই থাকুক, সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই পার্থক্য প্রকাশ করতে গিয়ে কি বিদ্বেষের আশ্রয় নেওয়া জরুরি? মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কি ন্যূনতম সংযম আশা করা যায় না নেটিজেনদের কাছ থেকে?

সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় যেমন জানাচ্ছেন, খেলার মাঠে রাজনীতির প্রবেশ না ঘটাই বাঞ্ছনীয়। খেলার সঙ্গে জাতিবিদ্বেষকে মিশিয়ে ফেললে তা মানবতার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক। তাঁর কথায়, ‘‘শুধু খেলা নয়, যে কোনও বিষয়েই নিজের মত দাঁড় করানোর জন্য বা অপরের মতকে খণ্ডন করার জন্য, অপরকে অপমান করা অন্যায়।’’

বিশিষ্টরা বলছেন, অপরকে ছোট করার আদিম প্রবৃত্তি মানুষের ভিতরেই লুকিয়ে থাকে। ইদানীং হাতের সামনে সোশ্যাল মিডিয়ার অবাধ ব্যবহারের সুযোগে সে প্রবৃত্তি আজ নগ্ন হয়ে পড়েছে। সঙ্গীতশিল্পী লোপামুদ্রা মিত্র ভারত পাকিস্তান ম্যাচের আগে তৈরি হওয়া উস্কানিমূলক নানা পোস্টের আধিক্য দেখে বলছেন, ‘‘খেলার নিজস্ব ‘স্পিরিট’ বজায় রাখার দায়িত্ব দর্শকদেরও নিতে হবে।’’

সমাজতত্ত্ববিদ প্রশান্ত রায়ের ব্যাখ্যা, ‘‘অশালীনতার মাধ্যমে নিজের গুরুত্ব বাড়াতে চান মানুষ। এ ক্ষেত্রেও তাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় অপরকে ছোট করতে গিয়ে অশালীন ইঙ্গিত করতে পারলে সহজে নজর কাড়া যায়!’’

নিজের দেশকে উগ্র সমর্থন করতে গিয়ে কদর্যতার আশ্রয় এবং দেশপ্রেম— এ দু’টি বিষয়কে এক আসনে রাখতে নারাজ কবি শ্রীজাত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও সম্পাদনার জায়গা থাকে না। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নেয় অশালীনতা। বহু মানুষ ধর্ম, জাতি, দেশ নিয়ে নিজের ভিতরে পুষে রাখা অসূয়া এবং ঘৃণাকে না-বুঝেই উগরে দেন সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়ালে। কারণ উগরে দেওয়ার সুযোগ অবাধ। ‘‘বিরোধিতা মানেই গালি দেওয়া নয়। সমালোচনাতেও শালীনতা থাকা জরুরি।’’— বললেন শ্রীজাত।

মনস্তত্ত্ববিদ জয়রঞ্জন রাম আবার বলছেন, ‘‘কুকথার আধিক্য তো আধুনিক রাজনীতিরই অঙ্গ হয়ে উঠেছে। সে ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কাছে সংযম আশা করাটাই বাড়াবাড়ি। প্রকাশ্য সভায় যখন কোনও নেতার কথায় লাগাম থাকে না, তখন সাধারণ মানুষও সোশ্যাল মিডিয়ার নিজস্ব পেজে মত রাখার সময় লাগাম পরাবে না।— এটাই স্বাভাবিক মনস্তত্ত্ব।’’

তবে পাল্টা মতও আছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি জনপ্রিয় পেজের অ্যাডমিন, জেন ওয়াইয়ের প্রতিনিধি অপূর্ব রায় যেমন জানাচ্ছেন, বিষয়টি এত তোলপাড় করার মতো নয়। তিনি বলছেন, ‘‘অনেক সময়েই কোনও ঘটনার তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় ও প্রতিক্রিয়ায় নানা রকম পোস্ট তৈরি হয়। সেগুলি আবার হারিয়েও যায়। সব ক্ষেত্রেই যে নীতিগত বিদ্বেষ প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য, তা কিন্তু নয়।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE