Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Ignaz Semmelweis

কী ভাবে শুরু হয়েছিল হাত ধোওয়া, কতটা জরুরি এখন

হাত ধোওয়া এই মুহূর্তে কতটা জরুরি সবাই মোটামুটি জেনে গিয়েছেন। কিন্তু এই হাত ধোওয়ার অভ্যাস কীভাবে তৈরি হল?

হাত ধোওয়া বাধ্যতমূলক, মানুষ বুঝতে পেরেছে এখন। ফাইল ছবি।

হাত ধোওয়া বাধ্যতমূলক, মানুষ বুঝতে পেরেছে এখন। ফাইল ছবি।

সুজাতা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২০ ১৩:২৪
Share: Save:

করোনা এসে শুচিবায়ুগ্রস্ত বানিয়ে দিয়েছে আমাদের। খাওয়ার আগে-পরে, শৌচাগার থেকে এসে তো বটেই, টেবিল-চেয়ার ছুঁয়ে দিলেও হাত ধোওয়া, নাকে-মুখে হাত লেগে গেলেও হাত ধোওয়া। সব কিছুর উপরই ঘাপটি মেরে আছে জীবাণু, হাত দিলেই লাগবে হাতে। সেখান থেকে ঢুকবে শরীরে। আর যদি উঠতে-বসতে হাত ধোওয়া যায়, তা হলেই আর সমস্যা নেই। এ কি বিজ্ঞান, না পাগলামি! হাত ধোওয়া এই মুহূর্তে কতটা জরুরি সবাই মোটামুটি জেনে গিয়েছেন। কিন্তু এই হাত ধোওয়ার অভ্যাস কীভাবে তৈরি হল?

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়। ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে চাইল্ড বেড ফিভার যেন ছেঁকে ধরছিল। প্রসূতি মায়েরা মারা যাচ্ছিলেন দলে দলে। কিন্তু কেন? কারণ খুঁজতে বসলেন হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ ফিলিপ স্যামেলওয়াইজ। তাঁর মনে হল, এর কারণ অপরিচ্ছন্নতা নয় তো! ফলে চিকিৎসকদের জন্য নতুন নিয়ম জারি করলেন তিনি। বললেন, অন্তঃসত্ত্বাদের পরীক্ষা করার আগে হাত ভাল করে ধুয়ে নিতে হবে ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে। ধুতে হবে যন্ত্রপাতিও। তার পর দেখা যাবে, সমস্যা কমে কি কমে না।

শুরু হল হাত ধোওয়া, যন্ত্র ধোওয়ার পর্ব। অবাক কাণ্ড, ফল পাওয়া গেল হাতে হাতে। গোটা বছরে এক জনেরও মৃত্যু হল না। স্যামেলওয়াইজ বুঝে গেলেন, তাঁর ধারণাই ঠিক । ঝামেলার মূলে আছে অপরিচ্ছন্নতাই। ফলে যাবতীয় পরিসংখ্যান দিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্র-পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু তখনও 'জীবাণু' বলে যে কিছু একটা আছে, তা নিয়ে ধারণা ছিল না কারও। ফলে হাত ধোওয়া এবং না ধোওয়ার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ব্যখ্যা করতে পারলেন না তিনি। রেগে আগুন হয়ে গেলেন সবাই। রোগীমৃত্যুর দায় তিনি ডাক্তারদের উপর চাপাচ্ছেন! পরিস্থিতি এমন হল যে, চাকরি ছেড়ে তাঁকে ফিরে যেতে হল হাঙ্গেরিতে।

আরও পড়ুন: কোমরের ব্যথায় ইচ্ছে মতো ওষুধ খান? কতটা ক্ষতি করছেন জানেন​

হাতে কাজ নেই। ভাঙা মন। কিন্তু তিনি প্রমাণ করবেন রোগীদের সারিয়ে তোলার এটাও এক রাস্তা। শুরু করলেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। ১৮৬১ সালে, নামকরা এক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশ করলেন গবেষণামূলক প্রবন্ধ। জানালেন, রোগীকে পরীক্ষা বা অস্ত্রোপচার করার আগে ডাক্তারদের উচিত হাত ভাল করে ধুয়ে নেওয়া। কারণ তিনি দেখেছেন, মর্গে মৃতদেহ ঘাঁটার পর হাত না ধুয়ে রোগী দেখলে মৃত্যু বেশি হয়। নিশ্চয়ই মৃতদেহ থেকে ডাক্তারের হাত মারফত এমন কিছু ভয়ঙ্কর উপাদান রোগীর মধ্যে আসে, যা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ভাল করে হাত ধুলে যে এ বিপদ এড়ানো যায়, তারও অসংখ্য পরিসংখ্যান দিলেন তিনি। লাভ হল না।

আরও পড়ুন: করোনা হয়নি, প্রবল জ্বরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েছি, আর কী বললেন সেরে ওঠা রোগী

সাধারণ মানুষের পাশাপাশি অনেক ডিগ্রিধারীও তখন বিশ্বাস করতেন, রোগ-শোক-মৃত্যুর মূলে রয়েছে দুষ্টু আত্মা। মানুষের সাধ্য নেই তাকে অতিক্রম করে। স্যামেলওয়াইজ পাগলের প্রলাপ বকছেন।

এবার চিকিৎসকদের চিঠি পাঠাতে শুরু করলেন তিনি। অনুরোধ করলেন, "একবার তো নিয়ম মেনে দেখুন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর এটাই এক বড় রাস্তা। আর যদি তা না করেন, ধরে নিতে হবে মানুষ খুন করছেন আপনারা।"

পরিস্থিতি চরমে উঠল। ঘরে-বাইরে সবাই ভাবতে শুরু করলেন, তিনি পাগল হয়ে গেছেন। গভীর একাকীত্ব ও হতাশা গ্রাস করল তাঁকে। ভুগতে শুরু করলেন অবসাদে। তখন তাঁকে পাঠানো হল মানসিক হাসপাতালে। ১৮৬৫ সাল সেটা। বলা হল ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে তাঁর, কেউ বললেন ভর করেছে প্রেতাত্মা।

আরও পড়ুন: বর্ষার আবহে করোনা দোসর, জামাকাপড় যত্নে রাখতে এই সব মানতেই হবে

হাসপাতালে শুরু হল অশরীরী ছাড়ানোর চিকিৎসা। মারধর। দিনের পর দিন। ক্ষত-বিক্ষত শরীর বিষিয়ে উঠতে লাগল। বিষ ছড়াল সারা শরীরে, রক্তে। এবং কার্যত বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৮৬৫ সালের ১৩ আগস্ট সেপটিসিমিয়ায় মারা গেলেন তিনি।

বার বার হাত ধোওয়াই সুস্থ থাকার একমাত্র চাবিকাঠি। ছবি: শাটারস্টক।

তাঁর মৃত্যুতে কেউ শোক প্রকাশ করলেন না। শেষকৃত্যে এলেন না কোনও চিকিৎসকও। হাঙ্গেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটিও ব্রাত্য করে দিল তাঁকে। তিনি হারিয়েই গেলেন।

দীর্ঘদিন পর প্রতিষ্ঠিত হল জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ জীবাণু থেকে রোগ হতে পারে তা মেনে নিলেন বিজ্ঞানীরা, আবার বেঁচে উঠলেন তিনি, আর এক মহামতি, লুই পাস্তুরের হাত ধরে। স্বীকৃতি পেল তাঁর গবেষণা। বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল তাঁর নাম। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট আজও তার স্বাক্ষর বহন করছে।

আরও পড়ুন: শুধু পান করবেন কেন, কফি ব্যবহার করুন এ ভাবেও

স্যামেলওয়াইজ প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করলেন, সুস্থ থাকতে গেলে হাত ধোওয়া বাধ্যতামূলক। এটা পাগলামি নয়, বিজ্ঞান। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নিয়ে সব চেয়ে বেশি সচেতনতা তৈরি হল করোনা কালে। এই তত্ত্বকে আরও অনেক বেশি জোরদার করল এই ক্ষুদ্র ভাইরাস। মেডিসিনের চিকিত্সক সুকমার মুখোপাধ্যায় বলেন, মাস্ক পরার সঙ্গে সঙ্গে বার বার হাত ধোওয়াই সুস্থ থাকার একমাত্র চাবিকাঠি এই মুহূর্তে। তাই হাত ধোওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়া মানেই সংক্রমণকে আহ্বান জানানো। চিকিত্সকের পরামর্শে সুস্থ থাকুন। ভাল থাকুন।

(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।

• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy