কোভিড-১৯ সংক্রান্ত টেস্ট করালে পরামর্শ নিতেই হবে চিকিৎসকের। ফাইল ছবি
আতঙ্ক নয়, বরং দরকার সচেতনতা। নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। করোনা নিয়ে বারবার চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীরা এ কথাই বলে আসছেন। পাশের বাড়িতে কারও করোনা হলেই যে আপনার হবে, এটা কখনওই নয়। তবে সতর্ক থাকতে হবে। কন্টেনমেন্ট জোনের আশপাশে বাড়ি হলে, জ্বর-কাশি, গলা ব্যথা, ঘ্রাণ কিংবা স্বাদে সমস্যা এ জাতীয় উপসর্গ দেখা গেলে কোভিড পজিটিভ কি না জানতে পরীক্ষা করা জরুরি। কিন্তু এটা কি সঠিকভাবে মানা হচ্ছে?
আমি ঠিক আছি তো? এইটা মাথায় রেখেই এখন অনেকেই এমনিই টেস্ট করাতে চাইছেন। তিনি করোনা আক্রান্ত কি না, তা দেখে নিতে চাইছেন। এটা কি ঠিক? চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটা কি করা সম্ভব?
কোনওরকম উপসর্গ নেই, অর্থাৎ জ্বর-কফ-কাশি কিছুই নেই, তবুও নিজে থেকে করোনা পরীক্ষার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন মেডিসিনের চিকিৎসক কল্লোল সেনগুপ্ত। বরং হেলথ কেয়ার সেন্টারে গিয়ে, বা গবেষণাগারে গিয়ে করোনা আক্রান্তের সংস্পর্শে এসে সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে সুস্থ ব্যক্তিদের। অনেক ক্ষেত্রে বাড়িতে এসেও স্বাস্থ্য কর্মীরা পরীক্ষা করছেন। সে ক্ষেত্রে একজন সুস্থ মানুষের এই পরীক্ষা করার কোনও যৌক্তিকতা নেই বলেই মনে করেন কল্লোল বাবু।
আরও পড়ুন: করোনার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকে থাকতে কী কী প্রয়োজন? কী বললেন চিকিৎসকেরা?
আরটিপিসিআরে নেগেটিভ, এদিকে উপসর্গ আছে। সে ক্ষেত্রে ফের টেস্ট করতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শে। ফাইল ছবি
পজিটিভ হলেই করোনা আক্রান্ত?
পজিটিভ হলে যে করোনা আক্রান্ত এ কথা ১০০ শতাংশ নিশ্চিতভাবে কখনও বলা সম্ভব নয়। ফলস নেগেটিভ বা ফলস পজিটিভ দুইই হতে পারে। সুস্থ ব্যক্তিরও সেক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়বে। আরটিপিসিআর-এর ক্ষেত্রে সে কারণেই দেখেশুনে পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়াও সম্পূর্ণ সুস্থ, উপসর্গহীন ব্যক্তিরা বহুল পরিমাণে টেস্টের ফলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর এখন অযথা চাপও পড়তে পারে। এমনই জানান কল্লোল বাবু।
রিপোর্টে পজিটিভ কিন্তু উপসর্গ নেই, তাহলে?
তাহলে কিছুদিন ব্যবধানে পরীক্ষা করবেন চিকিৎসক। তাকে বাড়িতেই থাকতে বলা হবে। সেই সময়ে কোনও উপসর্গ দেখা না দিলে কিছুদিন ব্যবধানে ফের আরটিপিসিআর পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়াও কয়েকদিন পর অ্যান্টিবডি টেস্ট আইজিজি বা আইজিএম পরীক্ষা করা যেতে পারে। কিন্তু সবটাই চিকিৎসকের পরামর্শমতো এমনই মত কল্লোল বাবুর।
যদিও গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু হয়েছে, সে কথা ভেবে কেউ যদি এই পরীক্ষা করাতে চান, তার ইতিবাচক দিক রয়েছে। বোঝা যাবে যে সচেতনতা বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন লাগবে অবশ্যই। এ কথা বলেন মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস।
তবে যে কটা গবেষণাগার আছে, তার মান সমতুল হওয়া চাই। কারণ ফলস পজিটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্ট আসতেও পারে। কোনও ফলাফল নেই, মাঝামাঝি মান, এমনও হয়েছে আরটিপিসিআরের ক্ষেত্রে। সে ক্ষেত্রে ফের পরীক্ষা করতে হবে। তবুও খুব প্রয়োজন পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন: সাপ্লিমেন্টস নয়, রোজকার এই সব খাবারেই বাড়বে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
গবেষণাগারের মান পরীক্ষার জন্য, সঠিক রিপোর্ট যাতে আসে তা দেখার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে। নিয়োগ করতে হবে পরিদর্শকদের দল, যাঁরা প্রতিটি ল্যাবরেটরিতে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে সন্দেহ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষা করতে হবে জানান চিকিৎসক।
অ্যান্টিবডি কিটের ক্ষেত্রে কী হয়? রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়?
দেশে তৈরি হওয়া কিটের ক্ষেত্রে ৯২.৪ শতাংশ সেনসিটিভিটি রয়েছে, ৯৭.৯ শতাংশ স্পেসিফিসিটি রয়েছে। মে মাসেই ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ একটি সেরোপ্রিভ্যালেন্স স্টাডি করেছিল এই কিটের মাধ্যমে। তাতে জানা গিয়েছে, সংক্রমণের মাত্রা ০.৭৩ শতাংশ। আরটিপিসিআর সেনসিটিভ স্পেসিফিক দুটোই। কিছু ক্ষেত্রে ফলস পজিটিভ আসে। কারণ পরীক্ষা সবে চলছে। অসুখটাও নতুন। প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে অ্যান্টিবডি টেস্টও। আইজিজি বলছে, রোগীর কিছুদিন আগে সংক্রমণ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে পজিটিভ থাকলে বোঝা যাবে যে করোনা হয়েছে অতীতে।অ্যান্টিবডি লেভেলও মাপা যাবে সে ক্ষেত্রে। দিল্লিতে এবং ধারাভিতে অ্যান্টিবডি টেস্ট করে সংক্রমণের মাত্রাও দেখেছে আইসিএমআর। একটা স্টাডির সঙ্গে অন্য স্টাডির তফাত দেখাও যাচ্ছে এই কারণেই। পুরোটাই জায়মান দশায় রয়েছে, তাই সেই বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এমনটাই উল্লেখ করেন কল্লোল বাবু।
অ্যান্টিবডি টেস্টে (আইজিজি-তে) পজিটিভ আসা মানে নিশ্চিত যে অতীতে সংক্রমণ হয়েছে, সেই কারণেই অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে।
রোগী জ্বর নিয়ে এলে কোভিড কি না তা দেখতে আরটিপিসিআর করতেই হবে। কিন্তু যাঁরা রোজ বাইরে বেরচ্ছেন, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, ডাক্তার, সাংবাদিক এঁদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি টেস্ট করে দেখা যেতেই পারে যে অতীতে উপসর্গহীন সংক্রমণ হয়েছে কি না, হয়তো তাঁরা সেরে গিয়েছেন অজান্তেই।
আরও পড়ুন: কম ঘুমচ্ছেন না তো? রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্ব দিতেই হবে ঘুমকে
নিজে থেকে টেস্ট মানে কি সচেতনতা?
সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দীর মত, আতঙ্ক নয়, সচেতনতাই কাম্য। টেস্ট একটা ইতিবাচক দিক। মানুষ প্রথমে ভয় পেয়েছিল পরীক্ষা করতে। পরীক্ষা করে পজিটিভ এলে সমাজচ্যুত করে দেবে, এমন একটা আতঙ্কও রয়েছে। কিন্তু সেই আতঙ্ককে জয় করতে পারে টেস্ট। তার মানে খানিকটা হলেও সাহস বেড়েছে। সমাজ ওই জায়গায় যাক, যেখানে রক্তে শর্করার পরিমাণ মাপতে যেমন যেতে হয়, তেমনই হোক এই পরীক্ষার ক্ষেত্রেও। তাহলে সংকোচ, কুৎসা, ঘৃণা এগুলির হাত থেকে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারবে। এভাবে এটাকে দেখতে হবে। তবে অবশ্যই পরামর্শ নিতে হবে চিকিৎসকের।
অকারণ টেস্টে পরিকাঠামোয় প্রভাব?
যাঁদের বাড়ি কন্টেনমেন্ট জোনে নয়, যাঁদের কোনও উপসর্গ নেই, তাঁদের পরীক্ষা করানোর কোনও মানে নেই। বরং এতে যাঁদের প্রয়োজন, তাঁদের কাছে টেস্ট অপ্রতুল হয়ে উঠবে, এমনই মত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবর্ণ গোস্বামীর। কোনও পজিটিভ ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অবশ্যই টেস্ট করাতে হবে। কিন্তু আতঙ্ক নয়।
খুব চিন্তায় পড়লে
উপসর্গ নেই, কিন্তু কোনও কারণে সন্দেহ হচ্ছে বা হাঁচি কাশি সামান্য রয়েছে, সে ক্ষেত্রে আরটিপিসিআর করাতে হবে। উপসর্গ না থাকলে ফলস নেগেটিভ আসতে পারে আরটিপিসিআরে। তাই সিদ্ধান্ত একা নেওয়া যাবে না। কোনও চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে, এমনই বলেন সুবর্ণ বাবু।
টেস্ট করে নেগেটিভ মানেই কি একদম নিশ্চিন্ত?
ধরুন কারও জ্বর, হাঁচি-কাশি হয়েছে, টেস্ট করিয়েছেন সচেতনতা থেকেই। তবে রিপোর্টে এল নেগেটিভ। নেগেটিভ হলেও আবার যে হবে না, তার মানে নেই। সপ্তাহ দুই অপেক্ষা করে আবারও করাতে হবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে। আরটিপিসিআর-প্রায় নিখুঁতই বলা যায়। এমনই বলেন বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালের চিকিৎসক যোগীরাজ রায়।
আরটিপিসিআর পদ্ধতিতে জানা যাবে করোনা আক্রান্ত কি না। ছবি: শাটারস্টক
কাদের ক্ষেত্রে নিজে থেকে টেস্ট করা উচিত?
এটা স্বাস্থ্য দফতরের সিদ্ধান্ত। নির্ণয় কম হচ্ছে বলেই মৃত্যু বাড়ছে, এ কথাও ঠিক। সর্দি-হাঁচি-কাশি হলে টেস্ট করানোই ভাল। টেস্টে পজিটিভ এলে বাড়িতে থাকতে হবে। অক্সিজেনের সমস্যা হলে হাসপাতালে যেতে হবে।
অল্প বয়সিদের ক্ষেত্রে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু কারও বাড়িতে বয়স্ক মানুষ রয়েছেন। বাড়ির অল্প বয়সি সদস্যটিকে বেরতে হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে টেস্ট করাতে হবেই। ডাক্তারের পরামর্শও নিতে হবে। টেস্টের বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই নিতে পরামর্শ দিয়েছেন যোগীরাজবাবু। তবে টেস্টের সংখ্যা সীমিত, তাই সবদিক বিবেচনা করতে হবে। একইসঙ্গে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও বারবার হাত ধোওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে বলেছেন সব চিকিৎসকরাই।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy