রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র
প্রশ্ন: সামনে রঙের উৎসব, দোলের সময় চোখে রং ঢোকা নিয়ে অনেকেই আপনাদের কাছে আসেন?
উত্তর: হ্যাঁ, দোলের দিন বা পরের দিন অনেকেই চোখ লাল করে আমাদের কাছে আসে। ছোটদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চোখের বিপদ আসে পিছন থেকে। আসলে বন্ধুদের চমক দিতে গিয়ে পিছন দিক থেকে দৌড়ে এসে মুখে রং মাখাতে গিয়ে চোখে আবির ঢুকে যায়। চোখে কিছু ঢুকলেই সহজাত রিফ্লেক্সে হাত চলে যায় চোখে। চোখ রগড়ে রং বের করার চেষ্টা করা একটা সহজাত প্রবৃত্তি। আর সেখানেই বিপদ বাড়ে বই কমে না। আবার অনেক সময় দূর থেকেও উড়ে আসে বিপদ রং। রং ভরা বেলুন দূর থেকে ছুঁড়লে তা-ও কারুর চোখে লাগতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু রং ঢুকে নয়, আঘাতজনিত কারণেও চোখের ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন: রং চোখে ঢুকলে চোখের কী কী ক্ষতি হতে পারে?
উত্তর: চোখ মানুষের শরীরের এমন এক অঙ্গ যেখানে কোনও কিছু ঢুকলেই সমস্যা হতে পারে। রং ঢুকলে তো বটেই। এখন বাজারে বেশিরভাগই সিন্থেটিক রং। এগুলি চোখের পক্ষে মারাত্মক। আবিরেও সমস্যা হতে পারে। রং ঢুকলেই চোখ জ্বালা করে, যন্ত্রণাও হতে পারে। চোখ কড়কড় করবে। তাকাতে সমস্যা হবে। চোখ দিয়ে জল বের হবে। দ্রুত সমস্যার সমাধান না হলে পরে তা থেকে সংক্রমণ বা প্রদাহ হতে পারে।
প্রশ্ন: রং না আবির কোনটা বেশি ক্ষতি করে?
উত্তর: দু’টোই। আবিরে থাকা অভ্র বা কাচের গুঁড়োয় চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবির মূলত ক্ষারধর্মী। অ্যালাকালাইনের প্রভাবে চোখের সংবেদনশীল অংশ ঝলসে যাওয়ার একটা ঝুঁকি থাকে। অনেক ক্ষেত্রেই কর্নিয়াল বার্নের অন্যতম কারণ আবির। চোখের মধ্যে যে এপিথেলিয়াল টিস্যু থাকে শুকনো আবির তাকেও পুড়িয়ে দিতে পারে। দোলের রং থেকে চোখের বিভিন্ন অংশের টেমপোরারি কেমিক্যাল বার্নের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। তাই এই ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। মুখে আবির মাখান, পিছন থেকে আচমকা অনিচ্ছুককে চোখমুখে রং মাখানোর চেষ্টা করবেন না। এতে বিপদ হতে পারে।
প্রশ্ন: রং ভরা বেলুনে কীভাবে চোখের ক্ষতি হয়?
উত্তর: রং ভরা বেলুন চোখে লাগলে তা খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। কারণ ওই আঘাত সরাসরি রেটিনায় হওয়ার ঝুঁকিই বেশি। এ ক্ষেত্রে চোখে জলের ঝাপটা দিলে আরও ক্ষতি হতে পারে। চোখ বন্ধ রেখে কোনও ভাবে কাছের কোনও হাসপাতালে পৌঁছে যাওয়াই শ্রেয়। ছোট-ছোট দানাদার চিকচিকে রংও চোখের পক্ষে বিপজ্জনক। কারণ রাসায়নিক ওই দানাগুলি কর্নিয়ার ক্ষতি করে। এ ক্ষেত্রে কোনও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে না গেলে পরবর্তী সময়ে চোখে সংক্রমণ হতে পারে।
প্রশ্ন: শিশুর চোখে রং ঢুকলে কী ক্ষতি হয়?
উত্তর: তৎক্ষনাত চোখ লাল হয়ে যায়, ফুলে যায়, চোখের ভিতর একটা অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। খুব বেশি হলে দৃষ্টিশক্তিও হারাতে হতে পারে। লাল রঙে থাকা মার্কারির যৌগ চোখে গেলে চোখ ফুলে উঠে জল পড়ে, ভয়ানক ব্যাথা করে। সবুজ রঙে থাকা কপার সালফেটের প্রভাবে চোখ ফুলে লাল হয়ে যায়, অনবরত চোখ করকর করে। অ্যালার্জির কারণে চোখে এমনই সমস্যা হয় যে চোখ খুলে রাখা দুষ্কর হয়ে যায়। উজ্জ্বল হলুদ রঙে থাকা লেড নার্ভ ড্যামেজ করে অন্ধত্ব ডেকে আনে। নীল রঙে আছে প্রুসিয়ান ব্লু, এটি চোখের পাতা-সহ সমস্ত চোখ জুড়ে এমন ইরিটেশন সৃষ্টি করে যে চোখ খুলে তাকানোই যায় না।
প্রশ্ন: শিশুর চোখকে কীভাবে এদিন নিরাপদ রাখা সম্ভব?
উত্তর: চোখকে নিরাপদ রেখে রঙের উৎসবে শামিল হওয়া যেতেই পারে। চশমা বা গগলস জাতীয় কিছু পরা যেতে পারে। অন্য কেউ রঙ মাখাতে এলে চোখ বন্ধ করে রাখতে হবে, যাতে চোখের মধ্যে রং না ঢুকতে পারে। চোখের মধ্যে রং ঢুকে গেলে বেশি না কচলিয়ে প্রথমেই পরিস্রুত পানীয় জলের ঝাপটা দেওয়া উচিত। তবে কখনই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া চোখে কোনও ওষুধ ব্যবহার করা ঠিক নয়। অ্যান্টিবায়োটিক ড্রপ রয়েছে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। অনেকে দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিজেরাই ব্যবহার করেন,এতে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন: বড়রা কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করবেন?
উত্তর: সাবধানতা একই রকম। সচেতন থাকতে হবে। কেউ রঙ দিতে এলে তখন চোখ বন্ধ রাখাটাই শ্রেয়। কনট্যাক্ট লেন্স কোনওভাবেই পরা যাবে না। রং খেলার পরে ঈষদুষ্ণ জল দিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলা ভাল। রং খেলার আগে মাথার চুলে ভাল করে নারকেল তেল মেখে নিলে ক্ষতিকর রঙের প্রভাব থেকে এক দিকে যেমন চোখ বাঁচবে, তেমনই স্নানের সময়ে চোখে রং ঢোকার ভয়ও খানিকটা কমবে। অনেক সময়ে রং দিতে গিয়ে আঙুলের খোঁচা লেগেও কর্নিয়া বা কনজাংটিভায় ক্ষত তৈরি হতে পারে। এ ছাড়া কিছু কিছু রং কর্নিয়ায় আটকে থাকে। সেটা তোলার ব্যবস্থা না করলে পরবর্তী সময়ে দৃষ্টিশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রশ্ন: সতর্কতা সত্ত্বেও যদি কোনওভাবে রং ঢুকে যায় তাহলে কী করা উচিত?
উত্তর: চোখে রঙ লাগলে রগড়াবেন না। নিজে জোর করে রঙ তোলার চেষ্টাও করবেন না। ডাক্তারের কাছে যান। চোখে রং গেলে কেমিক্যাল কনজাঙ্কটিভাইটিস হতে পারে। কর্নিয়ায় লাগলে কেরাটাইটিস হতে পারে। অসাবধানতাবশত চোখে রং ঢুকে গেলে কলের জল দিয়ে ধুয়ে নিন। খুব জোরে ঝাপটা না দেওয়াই ভাল। বিশেষ করে বাচ্চাদের চোখের সমস্যা হলে বড়দের সামলে দেওয়া দরকার। অনেক সময় আবির চোখের পাতার নীচে আটকে থাকে বলে জল দিয়ে বারে বারে ধুলেও কষ্ট ও ব্যথা কমে না। সাবধানে ওপর ও নীচের চোখের পাতা উল্টে নিয়ে জল দিয়ে ধুয়ে ফেললে সমস্যা কমবে। আবিরে চোখ ভীষণ ভাবে শুকিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে বারে বারে চোখে জল দেওয়া প্রয়োজন। চোখে জল রং ঢুকে গেলেও বারে বারে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। একই সঙ্গে অ্যান্টি অ্যালার্জিক আই ড্রপ ও টিয়ার্স ড্রপ বারে বারে লাগানো দরকার। চোখের পাতার তলা ও কোণে নরম বাডস দিয়ে পরিষ্কার করা যেতে পারে। জল দিয়ে ধুয়ে এবং ড্রপ দিয়েও চোখের ব্যথা ও ফোলা না কমলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
প্রশ্ন: আপনারা সাধারণত এক্ষেত্রে কী করেন?
উত্তর: অনেক সময়ে আমাদের কাছে এমন লাল, ফোলা চোখ নিয়ে অনেকে আসেন যে বাধ্য হয়ে স্টেরয়েড দিতে হয়। ব্যথা কমানোর জন্যে অ্যানেস্থেটিক ড্রপ ব্যবহার করে দু’বোতল স্যালাইন ওয়াটারের সাহায্যে চোখের মধ্যেকার রং বের করে দেওয়া হয়। সাময়িক ভাবে দৃষ্টিশক্তি চলে গেলে আতঙ্কিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কোনও ভাবে রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হলে রেটিনায় অস্ত্রোপচার করার প্রয়োজন হতে পারে। চোখ জ্বালা করলে লুব্রিকেটিং ড্রপ দিলেও আরাম পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: রং খেলার আগে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর: আমরা জানি, ‘প্রিভেনশন ইজ বেটার দ্যান কিওর’। রং লাগার পরে নয় আগে থেকেই সাবধান হোন। বাচ্চাদের সামলানোর দায়িত্ব বড়দের। ছোটদের একা রং না খেলতে পাঠানোই ভালো। বড়রা সঙ্গে থাকবেন। একদম খুদেদের হাতে রং না দেওয়াই ভাল। বড়রাও সচেতন থাকুন। অনিচ্ছুকদের রং মাখানোর চেষ্টা করে অযথা বিপদ ডেকে আনবেন না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy