কোলসাণ্ডা গ্রামে স্বাস্থ্য শিবিরে ভিড়।
জ্বরে দু’জনের মৃত্যু এবং এলাকার বেশ কয়েক জন জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পরে এনসেফ্যালাইটিসের ছায়া দেখা দিয়েছে মেদিনীপুর শহর লাগোয়া শিরোমণি পঞ্চায়েতের কোলসাণ্ডা গ্রামে। শুক্রবার এলাকার দু’জন মেদিনীপুর মেডিক্যালে মারা গিয়েছেন। জ্বর নিয়ে মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন আরও এক বৃদ্ধ। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, এ ক্ষেত্রে তীব্র জ্বর, খিঁচুনি, মাথা ব্যথার মতো যে সব উপসর্গ দেখা দিয়েছে, তা থেকে রোগটি অ্যাকিউট এনসেফ্যালাইটিস সিন্ড্রোম (এইএস) বলেই মনে হচ্ছে। তবে মৃতদের ডেথ সার্টিফিকেটে এইএস-এর উল্লেখ নেই। স্বাস্থ্যকর্তারাও মুখে এইএস-এর কথা বলছেন না।
এলাকায় অবশ্য এনেফ্যালাইটিস নিয়ে প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে। বলা হচ্ছে, এনসেফ্যালাইটিস কী, এই রোগের লক্ষ্মণ কী, চিকিৎসা পদ্ধতিই বা কী, রোগ প্রতিরোধের কী কী উপায় রয়েছে। স্বাস্থ্য কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝাচ্ছেন, রোগটি যেহেতু মশাবাহিত, তাই আগে দরকার মশা নিয়ন্ত্রণ। এ জন্য শুয়োর চাষের এলাকায় ডিডিটি বা অন্য মশানিধনকারী স্প্রে করতে হবে। শুয়োরের বাসস্থানের চারদিকে ব্লিচিং পাউডার ও চুন ১:৯ অনুপাতে মিশিয়ে ছড়াতে হবে। জমা জলে ফরমালিন স্প্রে করা যেতে পারে। শুয়োরের বাসস্থান সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাসস্থানের আশপাশে জমা জল থাকতে দেওয়া যাবে না। কারণ, সেখানে মশার বংশবৃদ্ধি ঘটে।
রবিবার সকালে কোলসাণ্ডায় গিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা। তিনি বলেন, “মৃতদের জ্বর এবং খিঁচুনির উপসর্গ ছিল। এনসেফ্যালাইটিস কি না দেখছি।” এ দিন থেকে এলাকায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির এবং সচেতনতা শিবির শুরু হয়েছে। গিরীশবাবু জানান, আগামী সাত দিন এই শিবির চলবে। স্বাস্থ্য কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাবেন।
কোলসাণ্ডায় বেশ কিছু শুয়োর রয়েছে। শুয়োরগুলো অবাধে ঘুরে বেড়ায়। এই শুয়োরই এসেফ্যালাইটিসের অন্যতম বাহক। এদের শরীরে বাসা বাঁধে সেই ভাইরাস যা কি না কিউলেক্স বিশনোই প্রজাতির মশার কামড়ে মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এই ভাইরাস যুক্ত বিশনোই মশা কোনও মানুষকে কামড়ালে তার এনসেফ্যালাইটিস হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। যে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের নাম অর্জুন হাঁসদা (৩৫) এবং বদ্রীনাথ কিস্কু (৪২)। গত বুধবার এঁদের মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শুক্রবার মারা যান। মৃত অর্জুন হাঁসদার স্ত্রী ভারতী হাঁসদা বলেন, “হঠাৎই জ্বর আসে। খিঁচুনি শুরু হয়। বুধবারই ওঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল।” কোলসাণ্ডার বাসিন্দা জলধর হাঁসদা নামে বছর ষাটের এক বৃদ্ধকে রবিবারই মেদিনীপুর মেডিক্যালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁর গায়েও জ্বর রয়েছে।
এ দিন সকালে এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্রবাবু। সঙ্গে ছিলেন জেলার উপ-মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রবীন্দ্রনাথ প্রধান, বিএমওএইচ মৌসুমী সোম প্রমুখ। কোলসাণ্ডা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনেই শিবির করে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা শুরু হয়। রক্তের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়। যে দু’জন মারা গিয়েছেন, তাঁরা কোলসাণ্ডারই সোলারডাঙ্গা পাড়ার বাসিন্দা। এখানে সব মিলিয়ে ১৭টি পরিবারের বসবাস। এই পরিবারগুলোয় থাকেন সবমিলিয়ে ৮২ জন। এঁদের সকলেরই রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এনসেফ্যালাইটিস প্রতিরোধের জন্য ‘শুয়োর হঠাও’ অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই মতো রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় শুয়োর ধরার কাজ শুরুও হয়। অবশ্য পশ্চিম মেদিনীপুরে এই অভিযান হয়নি। বদলে সচেতনতা প্রচারের উপরই বেশি জোর দেওয়া হয়। শুয়োরদের টিকাকরণের কাজ শুরু হয়। সরকারি হিসেবে অনুযায়ী এ জেলায় ৯৫,২৫৩ টি শুয়োর রয়েছে। এরমধ্যে মেদিনীপুরে (সদর) রয়েছে ৭,৮৯৭টি। মাস কয়েক আগে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় এনসেফ্যালাইটিসের প্রভাব দেখা দেয়। উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে আক্রান্তদের অধিকাংশের দেহে যে সব রোগ-জীবাণু হামলা চালিয়েছে তার অন্যতম বাহক হল জল। এ ক্ষেত্রে সংক্রমণের হারও দ্রুততর হয়।
ওই গ্রামেই ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োর।
কোলসাণ্ডা এলাকাও কিছু অপরিষ্কার জলাধার রয়েছে। অন্যদিকে, বেশ কিছু বাড়িতে শুয়োরও রয়েছে। বেশ কিছু বাড়িতে শুয়োর থাকার কথা মানছেন স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য কালীরাম সরেন। এদিন তিনি বলেন, “কিছু বাড়িতে শুয়োর রয়েছে। আগেই শুয়োর পালকদের সতর্ক করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে তো আর এলাকা শুয়োরমুক্ত করা সম্ভব নয়।”
জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “এনসেফ্যালাইটিস একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ। এই ভাইরাস শুয়োর বা বকজাতীয় প্রাণীর দেহে ঢুকলে সংখ্যায় বহুগুণ বেড়ে যায়। ওই এলাকায় সচেতনতামূলক প্রচার চলছে। সচেতনতাই তো রোগ নিরাময়ের আদর্শ উপায়।”এ দিনের স্বাস্থ্য শিবিরে অনেকেই জ্বর গায়ে এসেছিলেন। কোলসাণ্ডা ও তার আশপাশে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস। এ দিন প্রায় আড়াইশো জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এলাকার জলাধারগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখারও নির্দেশ দেন উপস্থিত স্বাস্থ্য- কর্তারা। জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার কথায়, “এই সময় বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়ই। আক্রান্তদের সঠিক চিকিৎসা যাতে ঠিক মতো হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য-কর্মীরা খোঁজ নিতে শুরু করেছেন, এলাকার কেউ জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। আক্রান্তদের সকলেরই রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হবে।”
ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy