আরবি শব্দ ‘আনোয়ার’। বাংলা অর্থ আলোকোজ্জ্বল। নতুন বছরে আনোয়ারের মতো অ-সাধারণ আলোকরশ্মিরা সমাজের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক।
বছর শেষ! পিছন ফিরে দেখা হচ্ছে চলে যাওয়া ৩৬৪ দিনকে। সাইপ্রাসের প্রবাসী বাঙালি চৈতালি বাগ হালদার ফিরে গিয়েছেন গত মার্চ মাসের একটা দিনে। ২৮ মার্চ, ২০২২। হুগলির শ্রীরামপুরে বল্লভপুর শ্মশান সে দিন এক বিরল ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল। চৈতালির বাবা সুজিত হালদারের মৃত্যুর পর তাঁর মুখাগ্নি করছেন আনোয়ার। মহম্মদ আনোয়ার আলি। আলিবাবা যে ভাবে গুহাভর্তি ধনরত্ন দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল, আনোয়ার আলিকে মুখাগ্নি করতে দেখে তেমনই বিস্ফারিত হয়েছিল অনেকের চোখ। কেউ কেউ ভুরুও কুঁচকেছিলেন। সে সব অবশ্য গায়ে মাখেনি চৈতালি বা আনোয়ারের পরিবার।
এই বিস্ময়ের নেপথ্যে রয়েছে অনেক বিস্ময়ের কাহিনি। আনোয়ারের সেবাব্রতে সে সব কাহিনি মায়া, মমতা, কর্তব্যবোধে ঢাকা এক একটা অনন্য উদাহরণ। কারও শরীরে রক্ত কমে গিয়েছে, কারও জটিল অস্ত্রোপচার প্রয়োজন, কঠিন রোগের চিকিৎসায় ভিন্রাজ্যের হাসপাতালে যেতে হবে কাউকে, কেউ টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না— এমন সময়ে আনোয়ারকে পেয়ে গেলে অর্ধেক মুশকিল আসান। এখানে জাত, ধর্মের বেড়া নেই। আনোয়ার সঙ্গে থাকেন। যত রকম ভাবে থাকা সম্ভব।
হুগলির শ্রীরামপুরে বাড়ি আনোয়ারের। বয়স জিজ্ঞেস করতেই একটু হাসেন। বলেন, ‘‘কত মনে হয়?’’ তার পর প্রত্যুত্তরের সময় না দিয়ে নিজেই জবাব দেন, ‘‘আটচল্লিশ।’’ পেশায় মিস্ত্রি। মেঝেতে মার্বল বসানোর কাজ করেন। দেওয়ালে বসান ‘গ্লেজ টাইল্স’। এখন অবশ্য বছরের বেশির ভাগ সময় আর নিজে কাজ করার সময় পান না। কাজের বরাত জোগাড় করেন। তার পর মিস্ত্রি-জোগাড়ে রেখে সেই কাজ শেষ করান। তাতে মুনাফার অঙ্ক তলানিতে এসে ঠেকেছে। আনোয়ারের কথায়, ‘‘লোক দিয়ে কাজ করিয়ে কি আর বেশি লাভ হয়? তবে যেটুকু যা হয়, তাতে আমাদের চলে যায়।’’ আনোয়ারের এই ‘আমরা’ শুধু তাঁর পরিবার নয়, তা ছাড়িয়ে অনেক দূরে প্রসারিত। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘সে এক বড় পরিবার।’’
আনোয়ারের ‘পরিবার’ সত্যিই অনেক বড়। গোটা দেশে ছড়িয়ে। কী করে হল এমনটা? কোথা থেকে এই কাহিনির শুরু? আনোয়ার জানালেন, তখন তাঁর বছর তেইশ বয়স। বাবা শেখ আনসার আলি তখনও কর্মঠ। মার্বল মিস্ত্রি হিসাবে এলাকায় তাঁর খুবই সুনাম। আনোয়ার তখনও তাঁর পেশার কাজকর্ম শুরুই করেননি। প্রতিবেশী এক বৃদ্ধা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। কেউ দেখার নেই। সাহায্য করার মতো কোনও অবলম্বন নেই। বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে আনোয়ার ওই বৃদ্ধাকে নিয়ে যান হাসপাতালে। কয়েক দিনের চিকিৎসার পর সুস্থ করিয়ে বাড়ি ফেরান তাঁকে। এই পর্বেই তাঁর উপলব্ধি হয়— কত মানুষ অসুস্থ অবস্থায় অসহায়ের মতো পড়ে থাকেন। কাউকে পাশে না পেয়ে হয়তো বিনা চিকিৎসাতেই মারা যান। আনোয়ারের পরবর্তী জীবনের বীজ যেন পোঁতা হয়ে যায় ওখানেই। আজ তাঁর কাজ শাখাপ্রশাখা ছড়িয়েছে চারপাশ জুড়ে, দূরদূরান্তেও।
উপকার পাওয়া মানুষজনের মুখে মুখেই ছড়িয়ে পড়েছে আনোয়ারের নাম। সাহায্য চেয়ে ফোন এলেই চেনা-অচেনা না দেখে পরমাত্মীয়ের মতো পাশে গিয়ে দাঁড়ান। মুমূর্ষু রোগী নিয়ে ছুটে বেড়ান এ হাসপাতাল থেকে ও হাসপাতাল। শ্রীরামপুর থেকে কলকাতার সমস্ত সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, এমনকি, চিকিৎসার জন্য চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ— গত পঁচিশ বছর ধরে মানুষের জন্য ছুটেই চলেছেন তিনি। এখনও পর্যন্ত বিভিন্ন হাসপাতালে হাজারেরও বেশি রোগীর চিকিৎসা করিয়েছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রয়ে গিয়েছে আনোয়ারের।
রোগীদের চিকিৎসার ভার তো কাঁধে। কিন্তু আর্থিক বল? এ বার মুখটা কেমন কাচুমাচু হয়ে যায় আনোয়ারের। সঙ্কোচ কাটাতে একটু সময় লাগে। তার পর খুব নিচু স্বরে বলেন, ‘‘গরিব হলে আমিই দিই।’’ আর বাকিদের? আনোয়ার গলাটা আর তোলেন না। বলেন, ‘‘অনেকে ধার নেন। আস্তে আস্তে শোধ করেন।’’ কাজ তো কমিয়ে দিয়েছেন। তা হলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে কি সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়েছে? কিছু বলতেই চান না আনোয়ার। বার কয়েকের প্রশ্নে অস্ফুটে বলেন, ‘‘হ্যাঁ।’’ তার পরেই স্বর একটু তুলে বলেন, ‘‘ওটা নিয়ে ভাবি না। সঞ্চয় তো আর খারাপ কাজে ভাঙাচ্ছি না! ওঁরা যে নতুন জীবন পাচ্ছেন। আর বাবা ছোটবেলা থেকে বলতেন, মানুষের পাশে দাঁড়ানোই এক জন মানুষের প্রকৃত কাজ। আমি সেটা মেনেই চলি।’’
কিন্তু অনেককে শত চেষ্টাতেও বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি আনোয়ার। সে কথা বলতে গিয়েই চোখটা খানিক ছলছল। বলতে থাকেন সুজিত হালদারের কথা। পেশায় গবেষক ও বিজ্ঞানী সুজিত কর্মসূত্রে থাকতেন দিল্লিতে। এক আত্মীয়ের পরামর্শে শ্রীরামপুরে একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলেন। চাকরিজীবনে অবসরের পর বছরের একটা সময় তিনি এখানেই থাকতেন স্ত্রী শিপ্রাকে নিয়ে। একমাত্র কন্যা চৈতালি বিবাহ এবং কর্মসূত্রে বিদেশে। দিল্লিতে থাকাকালীন সুজিতের প্রস্টেট ক্যানসার ধরা পড়ে। চিকিৎসাও করাচ্ছিলেন সেখানে। কিন্তু লকডাউনে শ্রীরামপুরে এসে আটকে পড়েন ২০২০ সালে। আনোয়ারের সঙ্গে তখনই পরিচয় হয়। রক্ত প্রয়োজন ছিল সুজিতের। আনোয়ার তাঁকে কলকাতা থেকে মোটর বাইকে করে রক্ত এনে দেন। সেই শুরু। এর পর গোটা লকডাউনে সুজিতের সমস্ত চিকিৎসা আনোয়ারের হাত ধরেই। গত ২৮ মার্চ সুজিত মারা যান। আর এই মৃত্যুর পরেই আনোয়ারের জীবনে এক অনন্য অভিজ্ঞতার স্পর্শ লাগে। সুজিতের মেয়ে চৈতালি আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘তার আগের দিন আমার জন্মদিন ছিল। পর দিন রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ মা ফোন করে জানায়, বাবা আর নেই। তার ঠিক পরের ফোনটাই ছিল আনোয়ার’দার।’’
কী কথা হয়েছিল দু’জনের?
— তুমি কি আসবে? না কি আমরা দাহকাজ সম্পন্ন করব?
— তাই করে দাও। আমি চাই না, বাবাকে আরও সহ্য করতে হোক।
— কাকিমা বলছে, আমাকেই সবটা করতে। তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?
— তুমিই তো করবে। আমার কোনও আপত্তি নেই। তুমিই বাবার মুখাগ্নি করবে আনোয়ার’দা।
এর পর আনোয়ার তাঁর বাবা আনসারের কাছে অনুমতি চান। তিনি এক কথায় অনুমতি দেন। হিন্দু ধর্ম মতে সুজিতের সমস্ত কাজ করেন আনোয়ার। মুখাগ্নি থেকে শুরু করে মস্তক মুণ্ডন পর্যন্ত। আনসার ২০১১ সালে সস্ত্রীক হজ করে এসেছেন। তিনি মসজিদ আর বাড়ি ছাড়া এখন আর অন্য কোথাও সে ভাবে যান না। তাঁর স্ত্রীও ধর্মপ্রাণা মুসলমান। কিন্তু দু’জনের কেউই আনোয়ারকে বাধা দেননি। আনসারের কথায়, ‘‘ছেলে তো অন্যায় কিছু করেনি। মানবতা বলেও তো একটা ধর্ম রয়েছে। সে ধর্ম সবার উপরে।’’ সেই ধর্ম মেনেই এখন ‘কাকিমা’ শিপ্রার দেখাশোনা করেন আনোয়ারই। চৈতালি সম্প্রতি সাইপ্রাস থেকে ভারতে এসেছেন একটা গবেষণার কাজে। এই মুহূর্তে দিল্লিতে। ফোনে তিনি বললেন, ‘‘আগামী মার্চে বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। সেই বাৎসরিক কাজও তো আনোয়ার’দা করবেন। ওঁর থেকে বড় সুহৃদ আর কে-ই বা আছেন আমাদের পরিবারে! আমিও থাকব।’’
আনোয়ারের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছে, তখন তিনি শ্রীরামপুরেরই একটি ফিজিয়োথেরাপি সেন্টারে। অঞ্জু মণ্ডল নামে এক মহিলার কোমরে অস্ত্রোপচার করিয়ে এনেছেন সদ্য। তাঁরই ফিজিয়োথেরাপি চলছে। আনোয়ার বললেন, ‘‘আসলে ফিজিয়োথেরাপি না করলে এই সব অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক সময় অস্ত্রোপচারটাই সফল হয় না। তাই এই ফলোআপটা রাখতেই হয়।’’ পাশে বসে থাকা অঞ্জুর চোখটা চিকচিক করে উঠল। তিনি বললেন, ‘‘আনোয়ার না থাকলে, এই অপারেশনটা করাতেই পারতাম না। আমার কাছে তো অত টাকা ছিল না। পঞ্চাশ হাজারের মতো কুড়িয়েবাড়িয়ে জোগাড় করেছিলাম। বাকিটা ও দিয়েছে।’’ অঞ্জুই জানালেন, তাঁর অস্ত্রোপচারে খরচ হয়েছে দু’লাখের বেশি টাকা।
জানুয়ারির শুরুতেই নৈনিতালের এক অসহায় রোগীকে নিয়ে ভেলোর যাচ্ছেন আনোয়ার। ফিরতে ফিরতে মাসখানেক তো বটেই। তত দিন ব্যবসা দেখবেন অন্য কেউ। আর সংসার? আনোয়ারের জবাব, ‘‘বাবা-মা ছাড়া তো কেউ নেই সংসারে। আমরা পাঁচ ভাই। সকলেই আলাদা। বাবা-মা আমার কাছে থাকেন।’’ বিয়ে করেননি? এ বার হেসেই ফেললেন আনোয়ার। বললেন, ‘‘বিয়ে করলে এমন বাঁধনছাড়া থাকতে পারতাম! সে জন্যই তো বিয়ে করিনি। করবও না। নিজের এমন জীবনে অন্যকে জড়িয়ে লাভ কী!’’
আরবি শব্দ ‘আনোয়ার’। নুর বা আলো থেকে এ শব্দের জন্ম। বাংলা অর্থ আলোকোজ্জ্বল। নতুন বছরে আনোয়ারের মতো অ-সাধারণ আলোকরশ্মিরা সমাজের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ুক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy