নিমেষ লামা সাগিনা মাহাতো নন। ঝান্ডা ধরা বা না-ধরা শ্রমিকনেতা নন তিনি। কিন্তু চা-বাগানের শ্রমিকদের দুর্দশার জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে, ডাকাবুকো ‘নায়ক’ না হলেও এক ধীরস্থির অধিনায়কের মতো কাজ করে চলেছেন নিমেষ। মদ্যপ, জুয়াড়িদের আড্ডাখানাকে যে ভাবে শিশুদের ‘বই-ঠক’খানায় বদলে ফেলেছেন, সে ভাবেই আরও বড় কাজ করতে চান চুপচাপ।
পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্সে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ৮৩টি চা-বাগান। সেই সব বাগানে নানাবিধ সমস্যা। এক এক বাগানের সমস্যার চরিত্র এক এক রকমের। তবে একটা জায়গায় এসে সব বাগানই মিলে যায়— শ্রমিকের দুর্দশা। আর হ্যাঁ, শ্রমিক-সন্তানের শিক্ষাদীক্ষা সর্বত্রই অবহেলিত। তবে দশক দুয়েক আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। অন্যান্য সমস্যার ভিড়ে চাপা পড়ে যাওয়া লেখাপড়া চা-বাগানে এখন অনেকটাই গুরুত্ব পায়। তবে সম্পূর্ণত নয়। চা-বাগানের ছেলেমেয়েরাও এখন পড়াশোনায় অন্যদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জায়গায় আসছে। যদিও তাদের সংখ্যা যথেষ্ট কম। বেশির ভাগই মাঝপথে স্কুল ছেড়ে উপার্জনের দিকে চলে যায়। এটাই দস্তুর চা-বাগানে। তবে এখন আর কেউই প্রায় বংশপরম্পরায় চা-বাগানে কাজ করতে চায় না। আসলে কে-ই বা চায় দুর্দশার সুড়ঙ্গে হাঁটতে!
চা-বাগানের কচিকাঁচাদের অন্য পথে হাঁটাতে চাইছেন বছর চব্বিশের নিমেষ। আলিপুরদুয়ারের কালচিনির বাসিন্দা। বাসিধুরার গোদামধুরা গ্রামে চা-বাগানেরই একটি কোয়ার্টারে সপরিবার থাকেন। ছোটবেলা থেকেই দেখেছেন পরিবারের আর্থিক সঙ্কট। নিমেষ তখন খুব ছোট। তাঁর বাবা কোথায় যেন চলে গিয়েছিলেন। আজও তাঁর কোনও খোঁজ নেই। বাড়িতে অভিভাবক বলতে দুই দাদু, দাদা আর মা। দাদা এবং মা এখনও চা-বাগানের শ্রমিক। আর্থিক ‘সংগ্রাম’ নিজে চোখে দেখেছেন। তবে পড়াশোনা ছেড়ে দেননি। অনেক কষ্টের মধ্যেও ভাবেননি ছেড়ে দেওয়ার কথা। ইতিহাসে স্নাতকোত্তরের পর এখন উচ্চতর শিক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন নিমেষ। তবে তিনি তাঁর অর্জিত শিক্ষা নিজের মধ্যে না রেখে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন চা-বলয়ে।
কচিকাঁচা থেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া— সকলের ঠিকানা, ‘ওপেন লাইব্রেরি’। নিজস্ব চিত্র।
গোদামধুরা গ্রামেরই খ্যাতনামা ‘ইউরোপিয়ান মাঠ’। ব্রিটিশ আমলে এখানে সাহেবরা গল্ফ খেলতেন। বিশাল মাঠ। তার এক কোণে একটা বিশাল পাকুড় গাছ। বহু বছর ধরে সেই গাছতলায় মদ ও জুয়ার আসর বসত। মদ্যপদের দিনরাতের ঠেক। সে এক বিপরীত দৃশ্য। এক পাশে ছেলেরা খেলছে। অন্য দিকে, এলাকারই কয়েক জন সেখানে দিনরাত মত্ত। নিমেষের যুদ্ধের শুরু সেখান থেকেই। একটা সময়ে তাঁর মাথায় আসে গাছ-লাইব্রেরির কথা। নিমেষের মনে হয়েছিল, এতে এক দিকে যেমন গাছতলাকে নেশাড়ুমুক্ত করা যাবে, তেমনই মুক্ত-পাঠাগারের কারণে ছেলেমেয়েরা আবার স্কুলমুখী হবে। সেই বিশ্বাস থেকেই প্রথমে পাকুড় গাছের চারপাশ পরিষ্কার করা হয়। পরিবেশের কথা মাথায় রেখে কোনও প্লাস্টিক ব্যবহার না-করে গাছকে ঘিরেই তৈরি হল পাঠাগার। দড়ি ও কাঠের সাহায্যে মাস ছয়েক আগে গাছ জুড়ে বই রেখে শুরু হল পথ চলা। প্রথম দিকে ছেলেমেয়েরা খুব একটা কাছে না এলেও হাল ছেড়ে দেননি নিমেষ। মাত্র ছ’মাস হয়েছে। ইতিমধ্যেই নিমেষের গাছ-পাঠাগার সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা গ্রামে। এখন কচিকাঁচা থেকে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া— সকলের ঠিকানা, ‘ওপেন লাইব্রেরি’।
তবে এখানেই থেমে থাকতে চান না নিমেষ। তাঁর ভাবনায় অন্য জগৎ ঘুরে বেড়ায়। নিমেষের ভাবনার সেই জগতে কোনও বঞ্চনা নেই। নেই কোনও অভাব। নেই কোনও বৈষম্য। তিনি শুধু নিজের গ্রাম নয়, গোটা চা-বাগানের সমস্যার মূলে আঘাত করতে চান। পড়াশোনা দিয়ে ঘোচাতে চান সমস্ত অন্ধকার। ইতিহাসের ছাত্রের একটাই ইচ্ছে, সমস্ত অন্ধকার পড়াশোনা দিয়ে জিতে নিক চা-বাগানের শ্রমিকের সন্তানেরা। তাঁর কথায়, ‘‘ইতিহাস নিয়ে আমার বরাবরের আগ্রহ। ইচ্ছে ছিল, একটা মিউজ়িয়াম গড়ে তুলব। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে রয়েছি, সেখানে এটা বিলাসি-স্বপ্ন! আসলে বিপ্লবীদের নীতি, আদর্শ আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। তাঁদের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী পালনের বাইরে বাকি সবটা পড়ে থাকে ইতিহাসের খাতায়। ওই ব্যক্তিত্বদের আরও কাছ থেকে মানুষকে চেনাতে চাই। কেন তাঁরা শুধু ইতিহাসের পাতায় থাকবেন?’’ এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই নিমেষ আবিষ্কার করেন, মানুষ বইয়ের কাছাকাছি নেই। যতটুকু প্রয়োজন, পরীক্ষায় পাশ করার জন্য, ব্যস সেটুকুই। নিমেষ বলছেন, ‘‘মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়া যেন একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে চা-বাগানে। সে ধারণা পাল্টে দিতেই আমার যুদ্ধ শুরু।’’
গাছ-পাঠাগার সাড়া ফেলে দিয়েছে গোটা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র।
নিমেষের যুদ্ধ যে নিমেষে শেষ হওয়ার নয়, তা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এখন। মাস ছয়েক বাদে স্বপ্নের একটা ধাপ পেরিয়েছেন। কাজটা যে কঠিন ছিল, সে কথা মেনে নিচ্ছেন নিমেষও। তাঁর কথায়, ‘‘নেশাড়ুদের ঠেক উঠিয়ে সেখানে এ কাজ করা খুব একটা সহজ ছিল না। নানা রকমের বাধা এসেছে। কিন্তু প্রথম থেকেই আমার কয়েক জন শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তাঁরা সমর্থন জুগিয়েছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ওপেন প্লাটফর্ম তৈরি করেছি। সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রতি রবিবার এখানে পারফর্ম করেন। সব থেকে জরুরি, যাঁরা এখানে মাদকে মাততেন, তাঁদের ছেলেমেয়েরাই এখন এই লাইব্রেরিতে আসে। আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েরা বই আনিয়ে পড়ছে। গত ছ’মাসে কেউ স্কুল কামাই করেনি।’’ এখনও অনেক পথ বাকি। নিমেষও জানেন, এ তো সবে শুরু।
গল্পের সাগিনা শেষমেশ হারিয়ে গিয়েছিলেন জীবন থেকে। তার আগে ডুবে গিয়েছিলেন ‘রাজনীতির পাঁকে’। নিমেষ বাংলার সে গল্প না-পড়লেও দেখেছেন দিলীপ কুমার অভিনীত সিনেমা ‘সাগিনা মাহাতো’। সাগিনার মতো হেরে যেতে চান না তিনি। তাই নিজেকে মুক্ত রেখেছেন রাজনীতি থেকে। কয়েক জন শুভাকাঙ্ক্ষী সঙ্গে আছেন। আর আছেন গ্রামের সকলে। সেটাই ‘যুদ্ধ’ জয়ের মূল চাবিকাঠি বলেই মনে করেন নিমেষ। তাঁর কথায়, ‘‘আমার স্বপ্নে রাজনীতি জুড়ে গেলে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ব।’’
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy