০৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Extraordinary Person of the Month

তাঁর মায়ায় ডুবেছে স্কুল আর গ্রাম, দুর্গার মতো ‘দশ হাত’ চালাতেও পারেন ‘বড়দিমণি’ মহামায়া

পড়ুয়াদের নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। বইপত্রের ব্যবস্থা করছেন। খেয়াল রাখছেন তাদের পরিবারের দিকেও। এলাকায় কেউ আর্থিক সমস্যায় পড়লেও তিনি সাধ্যমতো আছেন। মহামায়ার কাজ এখানেই শেষ নয়...

মহামায়া কিছুই ছোটান না। তিনি হাঁটতে শেখান। এই কন্যার সঙ্গে হাঁটছে চাঁপাহাটিও।

মহামায়া কিছুই ছোটান না। তিনি হাঁটতে শেখান। এই কন্যার সঙ্গে হাঁটছে চাঁপাহাটিও। —নিজস্ব চিত্র।

বিদিশা সরকার
চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০২২ ০৭:২৮
Share: Save:

ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের অনেকেই না খেয়ে স্কুলে আসে প্রায় দিন। পরম মমতায় তাদের নিজের হাতে খাইয়ে দেন দিদিমণি। নাম আর চরিত্রের এমন ‘মায়া’বন্ধন যে সম্ভব তা, মহামায়াকে দেখেই জেনেছে হুগলির চাঁপাহাটি গ্রাম।

জন্মেছিলেন মহালয়ার দিন। মা নাম রেখেছিলেন মহামায়া। মহামায়া বিশ্বাস। শুধু মায়া আর আদরে ভরিয়ে রাখাই নয়, কেবল তাঁর স্কুলের খুদেদেরই সামলানো নয়, দুর্গার সমনামী কন্যে ‘দশ ভুজে’ সামলান স্কুলের আশপাশের এলাকার আরও অনেক মানুষকেও।

পড়ুয়াদের নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। তাদের বইপত্রের ব্যবস্থা করছেন। খেয়াল রাখছেন তাদের পরিবারের দিকেও। এলাকায় কেউ আর্থিক সমস্যায় পড়লেও তিনি সাধ্যমতো আছেন। আবার সকলকে নিয়ে মেতে উঠছেন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আঙিনায়। মাথায় থাকে সমষ্টি উন্নয়নের ভাবনাও। পড়ুয়া থেকে অভিভাবক, আদতে গোটা গ্রামই মহামায়ায় আচ্ছন্ন বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।

বাড়ি হুগলির চুঁচুড়ায়। সবে ঊনচল্লিশের গণ্ডি টপকেছেন। গত প্রায় ১১ বছর ধরে মহামায়া চাঁপাহাটি সিদ্ধেশ্বরী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। চাকরি পেয়েছেন তারও এক বছর আগে। ২০১০ সাল। কাজে যোগ দিয়েছিলেন ধনেখালির এক স্কুলে। পরে বদলি নিয়ে এই চাঁপাহাটি। তখন থেকেই রয়ে গিয়েছেন। আর কোথাও যাননি। কোথায়ই বা যাবেন! এ গ্রামেই তো সর্ব ক্ষণ তাঁর মন পড়ে থাকে। অতিমারী কালেও রোজ স্কুলে এসেছেন স্কুটি চালিয়ে। স্কুল বলাটা সরকারি ভাবে ঠিক হল না। আসলে গ্রামে এসেছেন। পড়ানোর কাজটা নিয়মিত করে গিয়েছেন। শুধু কি পড়ানো! বাচ্চাদের খাবারদাবার, বইপত্র, তাদের পরিবারের অভাব-অনটনের পাশে দাঁড়ানো— হ্যাঁ, সবটাই মহামায়া সামলেছেন নিজের হাতে।

 পড়ুয়া থেকে অভিভাবক, আদতে গোটা গ্রামই মহামায়ায় আচ্ছন্ন বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।

পড়ুয়া থেকে অভিভাবক, আদতে গোটা গ্রামই মহামায়ায় আচ্ছন্ন বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। —নিজস্ব চিত্র।

মহামায়ার স্কুলে চাঁপাহাটির যে বাচ্চারা পড়তে আসে, তাদের প্রায় সকলেরই পরিবার অত্যন্ত দুঃস্থ। শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম— সব মিলিয়ে এখন ৩৭৬ জন পড়ুয়া। ৮০ শতাংশই সংখ্যালঘু। কী করে‌ন এই সব পড়ুয়ার বাবারা? অনেকে চাষাবাদ করেন। সেটাও সংখ্যায় অনেক কম। একটা বড় অংশ ট্রেনের মরসুমি ফেরিওয়ালা। অন্য সময়টা লোহাভাঙা, কাচভাঙা, টিনভাঙা কিনে বেড়ান পাড়ায় পাড়ায়। তার পর চাঁপাহাটির আড়তে বিক্রি। সামান্য সেই পয়সাতেই সংসার চলে। কেউ কেউ তো কেনার ক্ষমতাও রাখেন না। তাঁরা ভাঙাচোরা প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য জিনিসপত্র বিভিন্ন এলাকা থেকে কুড়িয়ে এনে বিক্রি করেন। রেললাইনের পাড়ে যে বস্তি, সেখানকার কয়েক জন তো আবার লাইনের পাড়ে পড়ে থাকা মরা গবাদিপশুর কঙ্কাল বিক্রি করেও রোজগার করেন। আর তাতেই পেটের দেখভাল। কিন্তু অতিরিক্ত তেমন পয়সা থাকে না, যা দিয়ে বাচ্চার লেখাপড়ার দেখভাল হবে!

এ তো গেল বাবাদের কথা। আর মায়েরা? কেউ কেউ অন্যের বাড়ি কাজ করেন। কেউ বা শুধুই ‘হোম মেকার’। আর এখানেই মহামায়া পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরির দায়িত্ব নিয়ে ঢুকে পড়েন ওই পরিবারে। বাড়ে বিশ্বাস। আর অর্জিত সেই বিশ্বাসেই মহামায়া গ্রামের মানুষের কাছে কখন যেন হয়ে উঠেছেন সকলের ‘বড়দিমণি’!

চুঁচুড়া থেকে ট্রেনে সিমলাগড়। স্টেশনে নেমে সাইকেলে তিন কিলোমিটার গেলেই মহামায়াদের স্কুল। সেখানে তখন অপেক্ষা করে প্রায় সাড়ে তিনশো বাচ্চা। এদের কয়েক জনকে তো মিড ডে মিলের খাবার পর্যন্ত খাইয়ে দিতে হয় মহামায়াকে। তাদেরই অন্যতম শেখ নিরাজুল। এখন সে ক্লাস ওয়ানে উঠেছে। শিশুশ্রেণি থেকেই এই স্কুলে। দিদিমণি নয়, মহামায়াকে সে ডাকে ‘বড়মা’ বলে। মহামায়ার কথায়, ‘‘দুপুরের খাওয়ার সময়টায় ওর মা আসেন প্রতি দিন। কিন্তু নিরাজুলকে খাইয়ে দিতে হয় আমাকেই। ও কারও কাছে খাবে না। অন্যদের থেকে একটু আলাদা তো! কথাটাও ভাল করে বলতে পারে না এখনও। আরও কয়েক জনকে খাইয়ে দিতে হয়। আমার বেশ ভাল লাগে। ওরাই তো আমার সন্তান।’’

বাচ্চাদের খাবারদাবার, বইপত্র, তাদের পরিবারের অভাব-অনটনের পাশে দাঁড়ানো, সবটাই মহামায়া সামলেছেন নিজের হাতে।

বাচ্চাদের খাবারদাবার, বইপত্র, তাদের পরিবারের অভাব-অনটনের পাশে দাঁড়ানো, সবটাই মহামায়া সামলেছেন নিজের হাতে। —নিজস্ব চিত্র।

নিরাজুলের মা সুলতানা বিবিও তাঁর ছেলের মতো ‘বড়মা’তে মুগ্ধ। তিনি বলেন, ‘‘বাচ্চার খাওয়ার সময় স্কুলে থাকতে বলা হয়েছিল। তা বাড়ির কাজকম্ম সামলে দুপুরের দিকে আমার যেতে মাঝেমাঝেই দেরি হয়। তবে বেশির ভাগ দিনই গিয়ে দেখি ও বড়দিমণির কোলে বসে খাচ্ছে। বড়দিমণিও ওকে আদর করে খাইয়ে দিচ্ছেন। আমার তো দেখে খুব ভাল লাগে। বড়দিমণি ওর আর এক মা।’’

‘বড়দিমণি’ বলে সকলে ডাকলেও মহামায়া কিন্তু সহকারী শিক্ষক। তাঁর স্কুলে এক জন হেডস্যর আছেন। তিনি বাসুদেব ভূমিজ। বাসুদেববাবুও মহামায়ায় মুগ্ধ। তিনি বলছেন, ‘‘আসলে উনি এই গ্রাম ও স্কুলের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন, ওঁকে বড়দিমণির সম্মান না জানানোটা আমাদের অন্যায় হবে। আমরা অন্য শিক্ষকেরা ওঁর সঙ্গেই আছি।’’ এখানেই থেমে গেলেন না হেডস্যর। বলছেন, ‘‘আসলে উনি আমাদের পথপ্রদর্শক। স্কুলের মধ্যমণি। সমস্ত ব্যাপারেই ওঁর একটা ভাবনা আছে। উনি সেটা প্রস্তাব আকারে আমাদের বলেন। আমরা সেটা মেনে নিয়ে এগোই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্য পাই।’’ মহামায়া আবার এ সব শুনে একটু বিড়ম্বনায় পড়েন। সলজ্জ মুখে বলেন, ‘‘স্যর একটু বাড়িয়েই বলেন। আমরা সাত জন শিক্ষক আছি এখানে। সবাই মিলেই এ সব করি।’’

মহামায়া স্কুলে শুধু পড়ান না। মিড ডে মিলের খাবার বাচ্চাদের খাইয়ে বাড়িও চলে যান না দায়িত্ব ফুরোল বলে। তিনি থেকে যান। কারণ, এর পরেই তো ক্লাবের কাজ হয় স্কুলে। ক্লাবের নাম ‘প্রস্ফুরণ’। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অনুমোদনেই সাংস্কৃতিক সেই ক্লাব চলে স্কুলে। মহামায়া তার ইনচার্জ। রাজস্থান আর তেলঙ্গানা থেকে এ বিষয়ে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন। দু’দফায় এই ক্লাবের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সাড়ে সাত হাজার করে টাকাও দিয়েছে। কী কাজ এই স্কুল-ক্লাবের? মহামায়া বললেন, ‘‘এটা কাজ নয়। ভালবাসা।’’ ভালবাসা? হ্যাঁ, সংস্কৃতির প্রতি। নিজেদের সংস্কৃতি। চিরাচরিত শিল্পকলাকে বাঁচিয়ে রাখাই এই ক্লাবের মূল লক্ষ্য। হাতের কাজ থেকে লোকনৃত্য, প্রাদেশিক গান থেকে আবৃত্তি— সব, সবেরই চর্চা হয় প্রস্ফুরণে। সদস্য কারা? বর্তমান পড়ুয়া, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা, প্রাক্তনী এবং পড়ুয়াদের অভিভাবকেরা। সরকারের টাকা আর আসে না বটে। কিন্তু নিজের উদ্যোগেই ‘প্রস্ফুরণ’ চালিয়ে যাচ্ছেন মহামায়া। সহযোগিতায় বাসুদেব-সহ তাঁর অন্য সহকর্মীরা।

স্কুলে একটা কমিউনিটি লাইব্রেরিও তৈরি করেছেন মহামায়া। এলাকার বিভিন্ন ক্লাসের দুঃস্থ পড়ুয়ারা এসে বইপত্র নিয়ে যায়। চাঁপাহাটিতে অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে। এই লাইব্রেরি তাঁদের জন্য মুক্তাঙ্গন। বইয়ের পাশাপাশি স্কুলের অফিসঘরে দুটো বড় আলমারিও রয়েছে। সেই আলমারি ঠাসা জামাকাপড়ে। নতুন, পুরনো মিলিয়েই রয়েছে। পুজোর সময় একপ্রস্ত বিলি করা হয়েছে। পড়ুয়াদের পাশাপাশি গ্রামের সকলে প্রয়োজন মতো এ সব নিয়ে যেতে পারেন। বই আর পোশাক কেনা কি সরকারি আনুকূল্যে? মহামায়া হেসে বললেন, ‘‘না না, এ সব সরকারের পয়সায় নয়। ব্যক্তিগত ভাবে সংগৃহীত। আমাদের পড়ুয়ারা রাখি বানায়। অন্যান্য হাতের কাজও করে। সে সব বিক্রি করে যে অর্থ সংগৃহীত হয়েছে, তাতেই কিনেছি। আরও কিছুটা পয়সার প্রয়োজন পড়েছে বটে, সে সবে আমার বেশ কয়েক জন স্কুলের বন্ধু হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।’’

এমন বন্ধু সত্যিই আর কে আছে! 

এমন বন্ধু সত্যিই আর কে আছে!  —নিজস্ব চিত্র।

চাঁপাহাটির ‘দশভুজা’ এ সবের ফাঁকেই অন্য সহকর্মীদের নিয়ে ঘুরে বেড়ান বাড়ি বাড়ি। কার কোথায় কী সমস্যা, কেন বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো যাচ্ছে না, কার বাড়ি কে অসুস্থ, কার ঘরে টাকার জন্য হাঁড়ি চড়েনি— এ সব খেয়াল করেন। তার পর সাধ্যমতো সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে ধরেন। সায়ন বাগ, দোয়েল মল্লিক, গীতা হেমব্রমেরা যেমন তাদের ‘বড়দিমণি’তে খুশি, তেমন আপ্লুত তাদের বাবা-মায়েরাও। এমন বন্ধু সত্যিই আর কে আছে!

মহামায়ার গত ১১ বছর এ ভাবেই চলছে। নিজের মাইনের টাকা যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করার আগেই খরচ হয়ে যায়। তাতে কোনও আফসোস নেই। বাড়িতে রয়েছেন বাবা আর মা। বাবা বিমল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। মা লতিকা বাড়ি সামলান। মহামায়ার ৮টি পোষ্যও রয়েছে। ৬টি কুকুর আর দু’টি বেড়াল। স্কুল থেকে রাতের দিকে ফিরে ওই পোষ্যদের দেখভাল চলে। নিজের হাতে রেঁধে খাওয়ান ওদের।

চার বোনের মধ্যে মেজো মহামায়া। তাঁর পরে যে বোন, তিনি রেলগাড়ি ছোটান দুটো সমান্তরাল লাইনে— লোকো পাইলট। মহামায়া কিছুই ছোটান না। তিনি হাঁটতে শেখান। এই কন্যার সঙ্গে হাঁটছে চাঁপাহাটিও।

(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy