বলরামের ‘পাঁউশি অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম’-এর স্কুলে। —নিজস্ব চিত্র।
আঁস্তাকুড়ে উবু হয়ে বসে বিয়েবাড়ির ফেলা পাতা থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে বছর পাঁচেকের একটা বাচ্চা। থমকে দাঁড়ালেন যুবক। এমন দৃশ্যে অনেকেই থমকে যান। তার পর বিষণ্ণ মনে চলে যান যে যাঁর কাজে। যুবক বলরাম করণও চলে গিয়েছিলেন সে দিন। তবে জীবনের নতুন বাঁকে।
বলরামের জীবনের রাস্তার সেই বাঁক আজ বছর তিরিশেক পরে তাঁকে দিয়েছে বিশাল এক একান্নবর্তী পরিবার। পরিবারের সদস্য সংখ্যা একশোরও বেশি। সকলেই এক বাড়িতে থাকেন। খাওয়াদাওয়া সব এক জায়গায়। এই মূল পরিবারকে যদি অতি ঘনিষ্ঠদের শাখাপ্রশাখায় আর একটু ছড়িয়ে ফেলা যায়, তা হলে দেখা যাবে, বলরামের সংসারে সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো সদস্যের বসবাস ও নিত্য আনাগোনা। এক ছাতার তলায় থাকা তাঁর এই পরিবারের নাম ‘পাঁউশি অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম’। পূর্ব মেদিনীপুরে কাঁথির কাছাকাছি গ্রাম পাঁউশি। এ গ্রামেই বলরামের জন্ম। এখানেই তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর স্বপ্নের বাড়ি। তাঁর সাধনার আশ্রম।
কী ভাবে চলে বলরামের সংসার? চলে প্রধানত ভিক্ষার চালে। বছরের পর বছর ধরে মুষ্টিভিক্ষাতেই তাঁর এই বিশাল পরিবার প্রতিপালিত হয়। আজও হচ্ছে। এ ভিক্ষায় গ্লানি নেই। এই বাংলার সাধনসংগ্রামে মাধুকরী স্পর্শ বয়ে চলেছে সেই কোন কাল থেকে।
এই ব্রতে আগে ‘নিজের’ সব কিছু ত্যাগ করতে হয়। বলরামকেও নিজের বসতবাটি, জমি, দোকানপাট সব বিক্রি করতে হয়েছে। বলরাম নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন ভিক্ষুকের ভূমিকায়। আজ স্বপ্নের লিখনটা যখন অনেকটা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে, তখন বলরামের মনে পড়ে সেই দিনটার কথা।
বলরামের আশ্রমে রাখি উৎসব। মিষ্টিমুখর ছোটরা। —নিজস্ব চিত্র।
১৯৯৫ সাল। এক দিন সকালে তিনি গিয়েছেন কাঁথির কাছে কোনও একটা কাজে। তখনই বাচ্চাটিকে দেখতে পান। রাস্তার পাশে আঁস্তাকুড়ে। পাশের বাড়িতে আগের রাতে অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠানবাড়ির ফেলে দেওয়া খাবারের পাতা খুঁটে বাসি খাবার খাচ্ছিল বাচ্চাটি। এ ছবি বলরামের সহ্য হয়নি। এলাকায় খবর নিয়ে জানতে পারেন, বাচ্চাটির কেউ নেই। অনাথ! তার পর আর কিছু না ভেবে তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন। স্ত্রী ছবিও আপত্তি জানাননি। নিজেদের সন্তানের সঙ্গেই মানুষ করার কথা ভাবেন ওই ‘পুত্রসন্তান’কে।
সেই শুরু। একের পর এক সন্তান এসেছে ঘরে। পরের সাতাশ বছরে বলরামের পরিবারের সদস্য হয়েছেন কত শত জন। নিজের সন্তানদের সঙ্গে প্রতিপালন করেছেন এই ছেলেমেয়েদের। অনাথ থেকে তাঁরা হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী। যে সৈকতকে সে দিন আস্তাকুঁড় থেকে তুলে এনে নিজের সন্তানের মর্যাদা দিয়েছিলেন বলরাম, এখন সেই সৈকতই বেঙ্গালুরুতে প্রতিষ্ঠিত মোটর মেকানিক। অন্তত পঁয়ষট্টি জন ‘ছেলেমেয়ে’ বলরামের হাত ধরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে বৃহত্তর সমাজের স্রোতে ফিরে গিয়েছেন। প্রায় চল্লিশ জন ‘মেয়ে’ পেয়েছেন সংসার। তাঁদের বিয়ে দিয়েছেন বলরাম-ছবি। রাস্তার অন্ধকার থেকে আলোয় ফিরেছেন ওই ছেলেমেয়েরা। কথায় কথায় গোপাল মণ্ডলের কথা মনে পড়ে যায় বলরামের। বলতে থাকেন, ‘‘জানেন, একদম ছোট্টবেলায় এসেছিল আমার কাছে। আমার স্ত্রীর স্তন্য পান করত গোপাল।’’ সেই গোপাল এখন সফ্টঅয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। এই মুহূর্তে উচ্চশিক্ষার জন্য বলরামের আশ্রমের বাইশ জন বাইরে রয়েছেন। তাঁদের সমস্ত থাকা-খাওয়া-পড়াশোনার খরচ বলরামই জোগান। ওঁদের কেউ ডাক্তারি পড়ছেন, কেউ ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ বা নার্সিং, কেউ অন্য কিছু।
দলবেঁধে সমুদ্রস্নানে। —নিজস্ব চিত্র।
লড়াইটা মোটেও সহজ ছিল না বলরামের। নিজের পরিবারে অনাথদের ঠাঁই দিতে গিয়ে পড়তে হয়েছিল চরম আর্থিক সমস্যার মুখে। দু’বেলা অন্নবস্ত্র জোগানে ক্রমেই টান পড়তে শুরু করে। বলরামের একটা ছোট্ট ওষুধের দোকান ছিল পাঁউশিতেই। ছোটখাটো বাড়িও ছিল একটা। সে দিনের সেই বাড়ি-দোকান আজ আর কিছুই নেই। কিছু জমিজায়গা ছিল। সে সবও বিক্রি করতে হয়েছে ‘অনাথ’দের ‘নাথ’ হতে গিয়ে।
সে সব গিয়েছে বটে! তবে বছর ছাপ্পান্নর বলরামের ঘরবাড়িতে এখন রয়েছে অনেকগুলি দালান। পুকুর। একই চত্বরে অবৈতনিক স্কুল। যে স্কুলে এখন প্রায় ২৭৫ জন পড়ুয়া। বলরামের এই লড়াই আসলে স্বপ্নকে ধাওয়া করার লড়াই। সেই ধাওয়া করতে গিয়ে বলরাম যেমন অনেক কিছু খুইয়েছেন, পেয়েছেন তার থেকে কয়েক গুণ বেশি। সৈকতের পর একের পর এক অনাথ শিশুকে বাড়িতে আনতে থাকেন বলরাম। সংসার যত বাড়তে থাকে, সঙ্কটও তত। নিজের বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে চাল, আনাজ সংগ্রহ করেই চলতে থাকে তাঁর বাড়তে থাকা সংসার। বলরামের কথায়, ‘‘একের পর এক গ্রাম ঘুরে ২৩৬টা পরিবারে একটা করে মাটির ভাঁড় রেখে এসেছিলাম। বলেছিলাম, আপনারা যখন হাঁড়িতে চাল নেবেন, এক মুঠো করে আমাকে ভিক্ষা দেবেন। সেই ভিক্ষার চালেই দিনের পর দিন চালিয়েছি। তাতেও টাকার টান মেটেনি। বিক্রি করেছি নিজের যা যা ছিল। তবু ওদের ছেড়ে যাইনি।’’
বলরামের স্ত্রী ছবির গর্ভের সন্তান চার জন। তিন মেয়ে ময়না, সায়না, মণি। সবার ছোট ছেলে বিশ্বজিৎ। ময়না জানালেন আর এক ঘটনার কথা— ‘‘বাবা যখন আর সামলাতে পারছে না, তখন আমাকে কলকাতার একটা পরিবারের কাছে তুলে দেয়। আমি তাদের দত্তক সন্তান হয়ে সেখানে চলে যাই। বাবা কিন্তু অন্য কাউকে দত্তক দেয়নি। নিজের সন্তানকেই দিয়েছিল।’’ সেই ময়না এখন ‘বাবা’র আশ্রমেই কাজ করেন। দেখভাল করেন সকলের। নিজের মেয়েকে দত্তক দিয়েছিলেন কেন? বলরামের অকপট জবাব, ‘‘যাদের রাস্তা থেকে তুলে এনে মানুষ করেছি, তাদের কাউকে অন্যের হাতে তুলে দিলে লোকে কী বলত! নিজেকেই বা কী উত্তর দিতাম! তবে ময়নার কপাল খারাপ ছিল। ওর পালক বাবা-মা কিছু দিন পরেই মারা যান। তার পর আবার আমার সংসারে ফিরে আসে।’’
নতুন প্রজন্মকে বড় করার দায়িত্ব নিয়েছেন বলরাম। —নিজস্ব চিত্র।
বলরামের এই লড়াইয়ে এগিয়ে এসেছেন অনেক মানুষ। স্বপ্নকে ধাওয়া করতে গিয়ে অর্থ সংগ্রহে তিনি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বার বার ছুটে গিয়েছেন শহরে। অনেক জায়গাতেই পেয়েছেন ‘অসম্মান’। কোথাও আবার ঝুলিতে পেয়েছেন ‘ভিক্ষা’। দেশ-বিদেশের অনেকেই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ আশ্রমের জন্য ঘর বানিয়ে দিয়েছেন। কেউ বানিয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্যসম্মত রান্নাঘর। কেউ আবার স্কুল চালাতে অর্থসাহায্যও পাঠিয়েছেন। বলরামের এই কর্মযজ্ঞে রয়েছে স্থানীয়দের অবদানও। বলরামের পালিত সন্তানদের মধ্যে যাঁরা আজ প্রতিষ্ঠিত, তাঁরাও প্রতি মাসে সাহায্য পাঠান। তাতেই চলতে থাকে বলরামের সংসার।
এ সংসারেই থাকেন প্রকাশ। বলরামের পদবিই ব্যবহার করেন। প্রকাশের কথায়, ‘‘যে দিন থেকে জ্ঞান হয়েছে, সে দিন থেকেই আমার বাবা-মা বলতে ওঁকেই জানি। আমার নিজের কোনও পদবি জানা নেই। উনিই আমায় পদবি দিয়েছেন। খাওয়া, পরা, পড়াশোনা কোনও কিছুরই অভাব বুঝতে দেননি। কোনও দিনই বুঝতে দেননি আমি অনাথ।’’
একই অনুভূতি মুনমুনের। তাঁরও কোনও পূর্ব-পদবি নেই। বলরামের পদবিই ব্যবহার করেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কোনও নাম-ঠিকানা ছিল না। একটি হোমের হাত ঘুরে এখানে পৌঁছই ছোটবেলায়। তার পর থেকে কোনও দিন আমাকে ভাবতে হয়নি নিজের জন্য। এই আশ্রমই আমার সব। এখন আমি সরকারি হাসপাতালে নার্সিংয়ের চাকরি করছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। এই ঋণ কোনও দিনই ভুলব না।’’
এই সব অনুভূতিই বলরামকে তাঁর অভীষ্ট স্বপ্নের আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। নতুন ভাবে লড়াইটা শুরু করতে চান। তাঁর কথায়, ‘‘দীর্ঘ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছি। তবে এ লড়াই থামার নয়। এত ছেলেমেয়েকে জীবনের মূল স্রোতে ফেরাতে পেরেছি, সেটাই অপার্থিব আনন্দ। এখনও দূরদূরান্ত থেকে বাবা-মা-হারা ছেলেমেয়েরা আসে। তাদের নিয়েই আমার সংসার।’’
সেই সংসার সামলাতে কোনও প্রতিষ্ঠানের অর্থ নেন না বলরাম। স্কুলের মিড-ডে মিলটা স্থানীয় ব্লক প্রশাসন দেয়। নারী-সুরক্ষার হোমও সরকারি সাহায্যে চলে। তবে সে সামান্য। বলরামের এই বিশাল সংসার চলে মূলত ভিক্ষান্নেই। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা নেই। একক শক্তিতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বলরাম যদিও এটাকে একক লড়াই বলতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘‘এ লড়াই, আমার একান্নবর্তী পরিবারের সকলের বেঁচে থাকার লড়াই। ঘটনাচক্রে, আমাকে সামনে থাকতে হয়।’’
দ্বাপরের বলরাম হলধর। কাঁধে তাঁর হল (লাঙল)। কলির এই বলরামের কাঁধে তাঁরই তিল তিল করে গড়ে তোলা এক বিশাল সংসারের হাল। বহু ছেলেমেয়ের বড় হয়ে ওঠার নেপথ্যে এই ‘হালধর’ বলরাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy