প্রবল আঁশটে গন্ধের সঙ্গেই এদের সহবাস। মচ্ছিমারনগরের ভিতরের ঘিঞ্জি গলিঘুঁজির বাসিন্দাদের জীবনে এই গন্ধ তো নিত্যসঙ্গী। কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের সাহেবদেরও তো দেখা যাচ্ছে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই! এখানে প্রায় প্রত্যেক দিনই তাঁদের ভিড় লেগে রয়েছে। দামি ক্যামেরা নিয়ে জঞ্জাল টপকে তাঁরা লেন্স বন্দি করে থাকেন এই বিশেষ সমুদ্রতটটিকে। কারণ এটিই আজমল কসাব ও তার বাহিনীর ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’! যদিও মুম্বইয়ের ভোটবাজারে ব্রাত্য।
“পিকনিক স্পট হয়ে গিয়েছে আমাদের এই গ্রাম। কোনও ভাল কারণে নয়। বদনামের জন্যই।” দৃষ্টি আরব সাগরের দিকে, মুখে একরাশ বিরক্তি দামোদর তান্ডেলের। অখিল ভারতীয় মচ্ছিমার কৃতি সমিতির সভাপতি এবং এই মৎস্যগ্রামের প্রধান পুরুষ। এনসিপি-র দক্ষিণ মুম্বইয়ের কর্তাও বটে।
বেলা পড়ে আসছে আর অশান্ত হচ্ছে সমুদ্র। ঠিক সাড়ে পাঁচ বছর আগের সেই কালরাত্রিতে কি এমনই অশান্ত ছিল জল? যখন ন’জনকে নিয়ে আজমল কসাবের ডিঙ্গা ভিড়েছিল এই তটে!
এত দিন হয়ে গিয়েছে কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত এবং বিদেশের মানুষের ঔৎসুক্য কিন্তু আদৌ কমেনি এই সমুদ্রতীর নিয়ে। বরং বেড়েছে। এখানকার জন্য বিশেষ করে তৈরি হয়েছে নতুন পুলিশ চৌকিও। কিন্তু এই ‘সন্ত্রাস-পর্যটনে’ লাভ কিছু হয়নি এই গরিবগুর্বো মানুষগুলির। কাদা জঞ্জাল পাথর টপকে কসাবের ‘এন্ট্রি পয়েন্ট’ দেখিয়ে এখানকার ছেলে ছোকরারা কিছু বিদেশি নোট রোজগার করছে বটে। তবে ওইটুকুই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে হতাশা আরও বাড়ছে। বাদওয়ার পার্কের এই মচ্ছিমারনগরের উপর তাও কিছুটা প্রচারের আলো পড়েছে, কসাবের কল্যাণে! কিন্তু মুম্বইয়ের লাগোয়া সাগরতটের ৩৬টি এবং সমুদ্র থেকে দূরে আরও ৮০টি জেলে গ্রাম যথেষ্ট উপেক্ষিত ভোটবাজারে। অন্তত সম্মিলিত কণ্ঠের হতাশা তাই বলছে।
ঘর বলতে দু’টি বেহাল নৌকো জোড়া দিয়ে তার মাথায় বাঁশ টাঙানো একটা ছাউনি। এতেই সংসার নির্বাহ অশোক বাঘেলের। গত তিরিশ বছর ধরে মাছ ধরছেন। বীতশ্রদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলির বক্তৃতা আর আশ্বাসে। এলাকাটি দক্ষিণ মুম্বইয়ের মধ্যে পড়ে, যার বর্তমান সাংসদ মিলিন্দ দেওরা। সংসদে যাঁকে আমরা দেখে অভ্যস্ত বিভিন্ন বিষয়ে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা নিতে। এই ভগ্নপ্রায় গ্রামে তাঁর যে কোনও উপস্থিতিই নেই তা বোঝা গেল বাঘেলের কথায়। বললেন, “গত পাঁচ বছরে তাঁর টিকিটিও দেখিনি। এক বারের জন্য কোনও পার্টি আসে না। এমনকী ভোট চাইতেও নয়। আমাদের কথা শোনারই কেউ নেই। যার টাকার জোর রয়েছে, সেই ভোট জেতে।”
‘আব কি বার মোদী সরকার’ পুণের পর মুম্বই এসেও এই মন্ত্রটিই শুনছি। কিন্তু এখানে মোদ্দা বিষয়টি যা দাঁড়াচ্ছে তা হল, মোদীর উপরেও কিন্তু খুশি নয় এখানকার জেলে গ্রামগুলি। বরং গুজরাতের উন্নয়নের যে মডেল মোদী অকাতরে বিতরণ করে যাচ্ছেন তাঁর বিভিন্ন সভা সমাবেশে, তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসেছে মচ্ছিমারনগর। দু’দিন আগেই মুম্বই প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক বৈঠক করে সে কথা জানিয়েওছে অখিল ভারতীয় মচ্ছিমার কৃতি সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি তান্ডেলের অভিযোগ, গত এক দশকে গুজরাত থেকে জলপথে প্রায় দশ হাজার মৎস্যজীবী মুম্বইয়ে ঢুকেছেন। তান্ডেলের কথায়, “আমরা ওদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করেছি, সাহায্য করেছি। কিন্তু দিনের পর দিন তো এমনটা চলতে পারে না। আমাদের পেটে যে টান পড়ছে তার ব্যবস্থা কে করবে? আর গুজরাত যদি এতটাই ভাল হবে তা হলে তাদের রাজ্যের জেলেরা এখানে এসে কাজের জন্য আশ্রয় নেয় কেন?” গোটা দেশে মৎস্যজীবী সম্প্রদায়কে উপজাতির মর্যাদা দেওয়া হলেও মহারাষ্ট্রে তা দেওয়া হয় না। ফলে সেই সুবিধা সংরক্ষণ পাওয়া সম্ভব হয় না।
মুম্বই আক্রমণের সেই আতঙ্ক এখনও থানা গেড়ে বসে রয়েছে মচ্ছিমারনগরে। এই গ্রামেই পড়াশোনা করে এখন ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন দেবেন্দ্র তান্ডেল। অবসর সময়ে মাছ ধরায় হাত লাগান। জানাচ্ছেন, কয়েক মাস আগেই উপকূলবর্তী সেনার সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হয়েছে। “একটি গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তারা খতিয়ে দেখেছে যে এই অঞ্চলে একই নামে, একই রঙের একাধিক নৌকো রয়েছে। সব চেয়ে বিপদের কথা হল বাংলাদেশি এবং নেপালি মৎস্যজীবীরা বেনামে এই নৌকাগুলি চালাচ্ছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে সাবধান করে বলা হয়েছে যে আবার নাকি ধামাকা হতে পারে।” পুলিশ কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর। তবে এখন যেহেতু ভোট চলছে, অন্য কোনও দিকে সময় দেওয়া যাচ্ছে না। ভোটের পর অভিযানে নামা হবে।
২০০৮-এর নভেম্বরের যে রাতে এসেছিল কসাবরা, গ্রামের আর পাঁচ জনের মত ভরত তান্ডেল আর ভরত তামোরি কিন্তু ঘরে বসে ডে অ্যান্ড নাইট ক্রিকেট ম্যাচ দেখছিলেন না। তাঁরা ছিলেন সমুদ্রের ধারে। তাঁদের কথায়, গত ছ’মাস ধরে এই জায়গাটির মানুষের জীবনযাপনের গতিপ্রকৃতির উপর নজর রাখা হয়েছিল। কসাব নিজেও এসেছিল রেকি করতে। যেখানে নৌকো ভেড়ানো হয়, সে দিকে আঙুল দেখিয়ে ভরত তমোরি বললেন, “ওখানে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা বসি। কিন্তু যে দিন ডে অ্যান্ড নাইট ওয়ান ডে ম্যাচ টিভিতে দেখায় সে দিন কেউ থাকে না। সেটা ওরা জানত। সে দিনও ম্যাচ ছিল। কিন্তু আমরা যাইনি। অচেনা লোকেদের ব্যাগ নিয়ে নামতে দেখে এগিয়ে গিয়ে বিষয়টা জানতেও চেয়েছিলাম। চড়া মেজাজে এক জন বলেছিল, বেশি কথা বললে ওখানেই ঠুকে দেবে। আমরা আর সাহস পাইনি।” বাকিটা ইতিহাস। গোটা রাত ঘুমোতে পারেনি মচ্ছিমারনগর। হয়তো কোনও এক অপরাধবোধে।
কয়েকশো ফুট দূরেই কোলাবার অভিজাত পাড়া। যেখানে সেই লিওপোল্ড কাফে। আজও যার দেওয়ালের বুলেট চিহ্নগুলি বিয়ার পান করতে যাওয়া ভিন শহরের মানুষের বাড়তি আকর্ষণ। ওই ধনী এলাকা থেকে সামান্য দূরেই এই আঁশগন্ধের নরক। যেখানে বেশির ভাগ মানুষেরই বাড়িতে শৌচাগার পর্যন্ত নেই। বাইরের সমুদ্রই ভরসা। “এর ফলে মাছ খারাপ হয়ে যাচ্ছে। নানা রকম সংক্রমণ হচ্ছে জলে।” জানালেন দেবেন্দ্র। যত বারই সুযোগ পেয়েছেন রাজ্য নেতৃত্বকে নিজেদের দাবি দাওয়ার কথা বলেছেন এখানকার প্রতিনিধিরা। যার মধ্যে রয়েছে বড় বড় রাজনৈতিক নেতার কাছে খুঁটি বাঁধা ধনী ট্রলার মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ। যাঁরা বড় মাছ ধরার নামে বেআইনি ভাবে ছোট ছিদ্রের জাল ব্যবহার করে কুচো মাছও তুলে নেয়। জলে মাছ আর বাড়তে দেয় না। মাছের কোনও ন্যূনতম দাম সরকার বেঁধে না দেওয়ায়, মাঝের ফড়েরা লাভের গুড়টুকু খেয়ে নেয়। তান্ডেলের কথায়, “অনেক ক্ষেত্রে মাসে মাত্র হাজার টাকা আয় হয়, এখানকার মৎস্যজীবীদের। এতে কি চলে?”
দেশের নিরাপত্তার জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এমন হতাশা আর সরকারের উপর ক্ষোভ? কংগ্রেস, এনসিপি বা বিজেপি কেউই এ বারের ভোটে বিষয়টি মাথায় রাখছে বলে তো মনে হল না।
গ্রামটি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, এই হতাশাকে অর্থ দিয়ে কিনে নেওয়া কোনও বিদেশি অনিষ্টকারী শক্তির কাছে কি একেবারেই অসম্ভব? যেখানকার সামান্যতম সহযোগিতা তছনছ করে দিতে পারে মুম্বই তথা দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy