এক ‘এম’-র পাশে দাঁড়াতে গিয়ে অন্য ‘এম’কে বিড়ম্বনায় ফেললেন ‘ডবল এম’!
সাংসদ হয়েছেন দেড় বছর। সংসদ চত্বরে লাল ডায়েরি, কালো শাল বা হাঁড়ি নিয়ে বিক্ষোভের কোরাসে কখনও কখনও গলা মিলিয়েছেন। তার বাইরে তাঁর রাজনৈতিক কণ্ঠ বিশেষ শোনা যায়নি। দেশ জু়ড়ে এখন যে অসহিষ্ণুতার আবহ নিয়ে চরম বিতর্ক, তা-ই নিয়েই এ বার মুখ খুললেন বাঁকুড়ার তৃণমূল সাংসদ মুনমুন সেন। এবং প্রায় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিলেন তৃণমূলের সহিষ্ণুতাকে!
তৃণমূলের অভিনেত্রী-সাংসদ মনে করেন, অসহিষ্ণুতা ভারতীয় সমাজে বহু কাল আগেও ছিল। এখন প্রচারের নতুন নতুন মাধ্যম এসে পড়েছে বলে তা নিয়ে বেশি হইচই হচ্ছে মাত্র। ক্রিকেটের সমঝদার সাংসদ শুধু এখানেই থামেননি। আরও বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে বসেছেন! নরেন্দ্র মোদীর কাজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, বিরোধিতা করার আগে প্রধানমন্ত্রীকে আরও সময় দেওয়া উচিত। যা এই মুহূর্তে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত অবস্থানের বাইরে!
অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন বলিউড তারকা এবং বাংলার ব্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খান। তার জন্য বলিউডের বাদশাকে ‘দেশদ্রোহী’র তকমা দিয়ে বসেছেন বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক তথা এ রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়! এমন অসহিষ্ণু মন্তব্যের জন্য তৃণমূলের তরফে কৈলাসকে এক হাত নিয়েছেন তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন। সেই বিবৃতি জারি করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে মুনমুনের মন্তব্য। বিশেষ ‘অসহিষ্ণুতা’র পথে না গিয়ে ডেরেক অবশ্য তাঁর সহকর্মী সাংসদদের মন্তব্য প্রসঙ্গে শুধু বলেছেন, ‘‘নিশ্চিত ভাবেই এটা দলের বক্তব্য নয়। ওঁর ব্যক্তিগত মত হতে পারে।’’ আর দলের এক শীর্ষ নেতা একান্তে মেনে নিচ্ছেন, ‘‘অরাজনৈতিক লোকজনকে ধরে ধরে সাংসদ-বিধায়ক করলে এই রকমই হয়!’’
ঘটনাচক্রে, কয়েক মাস আগে ডেরেকের মাধ্যমে তৃণমূল একই বিবৃতি জারি করেছিল দলের বর্ষীয়ান সাংসদ সৌগত রায়ের মুখ বন্ধ করতে! ললিত মোদী-কাণ্ডে সৌগত সে বার বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের ইস্তফা দাবি করেছিলেন। ডেরেককে তখন বলতে হয়েছিল, ‘‘ওটা সৌগতবাবুর ব্যক্তিগত মত।’’ যার মানে দাঁড়িয়েছিল, তৃণমূলের দলীয় মত তখন বিজেপি-র পক্ষেই ছিল! এখন আবার বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে আর এক সাংসদ মুনমুনের মন্তব্য সেই ‘ব্যক্তিগত মতে’র বন্ধনীতেই ঢুকেছে। পরিস্থিতি বুঝে তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থানও যে পেন্ডুলামের মতো— স্বভাবতই বলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে বিরোধীরা!
বাম ও কংগ্রেস নেতারা যেমন মুনমুনের এ দিনের মন্তব্যকে হাতিয়ার করতে ছাড়ছেন না। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম যেমন বলছেন, ‘‘মুনমুন সেন হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছেন! তৃণমূলের অন্দরমহলের কথা বহির্মহলে এনে ফেলেছেন। তাঁর কথায় একেবারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ জেটলির প্রতিধ্বনি! বিজেপি-র বিরুদ্ধে তৃণমূলের মাঝে মাঝে মুখ খোলা যে লোক-দেখানো, আসল কথাটা হল বিজেপি-কে বিরক্ত না করা, এটাই মুনমুনের মন্তব্যে প্রকাশ হয়ে গিয়েছে!’’ সিপিএম সাংসদের আরও কটাক্ষ, ‘‘উনি অভিনেত্রী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো পাকা রাজনীতিক নন। তাই কোনটা বলতে নেই, বুঝতে পারেননি!’’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও টিপ্পনী, ‘‘দিদি আর মোদীর সখ্য আবার সামনে এসে পড়ল!’’
পরে রাতে মুনমুন অবশ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন, একটি টিভি চ্যানেলের পক্ষ থেকে বাংলায় তাঁকে ‘কঠিন কঠিন প্রশ্ন’ করা হয়েছিল। তিনি অনেকটাই না বুঝে কিছু কথা বলে ফেলেছেন। মোদী পাঁচ বছরের জন্য জনাদেশ নিয়ে এসেছেন। তাই তাঁর কাজের বিচার পাঁচ বছর পরেই হওয়া উচিত— এইটুকুই শুধু তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন। তত ক্ষণে অবশ্য বিড়ম্বনা যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে!
ঠিক কী বলেছেন মুনমুন? কলকাতায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব সংক্রান্ত সাংবাদিক সম্মেলনের শেষে তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল, গোমাংস-বিতর্ক এবং দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতার পরিবেশের প্রতিবাদে শিল্পী-সাহিত্যিক এবং তাঁর পেশাগত অনেক সহকর্মীও পুরস্কার ফিরিয়ে দিচ্ছেন। আরও নানা ভাবে প্রতিবাদ করছেন। তিনি কী মনে করেন? মুনমুন প্রথমে বলেন, যাঁরা প্রতিবাদ করছেন, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত অধিকার। তবে এ সব আগেও হয়েছে। এর পরেই তাঁর মন্তব্য, ‘‘অসহিষ্ণুতা তো চিরকালই ছিল! এখন মিডিয়া আছে। ক্যামেরা আছে। তাই ঘটনাগুলো জানাজানি হচ্ছে এবং তা নিয়ে হইচই হচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে, আগের থেকে এখন বেশি হচ্ছে।’’ মুনমুন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘বাল্য বিবাহ ছিল না? এখনও তো সতী হচ্ছে! এখন কম্পিউটার আছে। তোমরা (সাংবাদিকরা) আছ। তোমরা জানাচ্ছ। আমার মনে হয়, প্রতিবাদেও নতুনত্ব কিছু নেই।’’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় মোদীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তৃণমূলের তারকা-সাংসদের সাফ কথা, ‘‘আমার মনে হয় ওঁকে (নরেন্দ্র মোদীকে) আরও সুযোগ দেওয়া উচিত। উনি দারুণ কাজের মধ্য দিয়ে মানুষের মন জয় করছেন। ওঁর নিজের দল ওঁকে সুযোগ দিচ্ছে না। আমাদের ওঁকে পাঁচ বছর কাজের সুযোগ দেওয়া উচিত। তার পরে না হয় বিরোধিতা করব!’’
নিজের দলকে তো বিড়ম্বনায় ফেলেছেনই। বিজেপি-র জন্যও বিশুদ্ধ স্বস্তি রাখেননি মুনমুন। বিজেপি-র বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য যে কারণে তৃণমূল সাংসদের বক্তব্যের প্রথম অংশকে স্বাগত জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘‘তৃণমূলের চেয়ে অসহিষ্ণু কেউ আছে না কি? তারা ওদের দলের সাংসদের কথাই যুক্তি দিয়ে ভাবলে মঙ্গল!’’ কিন্তু মুনমুন তো বলেছেন, বিজেপি মোদীকে ঠিকমতো কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে না? এ বার শমীকের মন্তব্য, ‘‘উনি এত বড় রাজনীতিক এখনও হয়ে ওঠেননি যে, বিজেপি-র অভ্যন্তরের কথা বুঝে ফেলবেন!’’
বিরল মুখ খুলে সকলেরই সহিষ্ণুতার প্রায় পরীক্ষা নিয়ে ছা়ড়লেন তৃণমূলের তারকা-ব্রিগেডের অন্যতম সদস্যা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy