অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।
ইন্দিরা গাঁধী কি বামপন্থী ছিলেন?
প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধবন বলেছেন, না। না। উনি আসলে বামপন্থী ছিলেন না, ছিলেন না ডানপন্থীও। উনি ইন্দিরা গাঁধী ছিলেন। এখানেই থামেননি ধবন। বলেছেন, পি এন হাকসারই আসলে ওঁকে বামপন্থী ঘরানায় পরিচালিত করেন। ওটা আসলে হাকসারের এক মস্ত বড় ভুল। তাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইন্দিরার প্রথম অধ্যায়টি আসলে পি এন হাকসারের অধ্যায়। পরে তিনি নিজস্বতা নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে মা দুর্গা হয়ে ওঠেন। এ হল ধবনের (আর কে ডি) বক্তব্য।
পি এন হাকসার ১৯৬৭তে মাত্র ৫৪ বছর বয়সী এক প্রবল পরাক্রান্ত আমলা। তিনি ইন্দিরার প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওই পদে আসীন থাকেন। ঝকঝকে দেখতে। শিক্ষিত, অভিজাত কাশ্মীরি পণ্ডিত। ফিরোজ গাঁধীর বন্ধু ছিলেন। বার অ্যাট ল। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের স্নাতক। ওই কূটনীতিককে সবাই বাব্বু হাকসার বলে ডাকত।
এ হেন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আর কে ডি যা-ই বলুন না কেন, আমি নিজে কিন্তু এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি না। ইন্দিরার বাহ্যত বামপন্থী ভাবমূর্তির নির্মাণ আসলে হাকসারের অঙ্গুলিহেলনে! বিশ্বাস করি না। এমনকী, নেহরু নিজেও নিজেকে কমিউনিস্ট নয়, সমাজতন্ত্রী আখ্যা দিয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে নেহরু নিজের জীবনে ফেবিয়ান সমাজতন্ত্রের প্রভাব স্বীকার করেন। ইন্দিরা গাঁধী যে মতাদর্শগত ভাবে নেহরুর মতো সমাজতন্ত্রী ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু, তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে সেই সময়ের দাবি মেটাতে এবং দলের অভ্যন্তরে সিন্ডিকেট নামক এক সামন্ততান্ত্রিক জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে দিতে সমাজতন্ত্রী বামপন্থী দৃষ্টিভঙ্গিকে ব্যবহার করেছেন।
ভুবনেশ্বরে এক সভায় জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।
ইন্দিরা ’৬৯ সালে যখন ব্যাঙ্কের জাতীয়করণ করেন, তখন প্রবীণ সাংবাদিক ইন্দর মলহোত্র এই সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানতে দিল্লির রাজপথে ভিড়ের মধ্যে আমজনতার সঙ্গে কথা বলেন। পথে পথে তখন চলছে উৎসব। সাংবাদিক ইন্দর নিজেই সে কথা স্বীকার করেছেন। তিনি এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি কোনও দিন ব্যাঙ্কে গিয়েছে? সে বলল, না। তা হলে এই গরিব মানুষেরা রাস্তায় নামছে কেন? তোমরা কি এ বার ব্যাঙ্কে যাবে? ‘না’। তা হলে এত আনন্দ কেন? নাচছ কেন তোমরা? জবাবে সেই রিকশাওয়ালা বলেছিলেন, ‘বুঝছ না? শেষ পর্যন্ত গরিব মানুষের জন্য কেউ কিছু করল। এ বার বড়লোকদের শিক্ষা হবে।’
এ ভাবেই, এই ঘটনার মাধ্যমে ইন্দিরা গাঁধী হয়ে উঠেছিলেন জনগণের প্রধানমন্ত্রী। আসলে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, খনির জাতীয়করণ, তার পর সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারত রাষ্ট্রের চরিত্রে ‘সমাজতন্ত্রী’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ যোগ করা। এ সবই তো তিনি করেছিলেন। এক ঢিলে আসলে অনেক পাখিই তিনি মেরেছিলেন।
ইন্দিরার আমলে অর্থমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি দেশাই। তিনি তাঁর দক্ষিণপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তা ছাড়া ইন্দিরার নেতৃত্বেও ছিল তাঁর ঘোরতর অনাস্থা। এই মোরারজি দেশাই-ই তো ইন্দিরাকে ‘গুঙ্গি গুড়িয়া’ বলেছিলেন। তার পর সেই মোরারজি যখন সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, ইন্দিরার বিরোধিতা শুরু করেন। এখানেই শেষ নয়, তিনি সিন্ডিকেটের নেতা হিসাবে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের বিরোধিতা করেন। আর ইন্দিরা ব্যাঙ্ক জাতীয়করণকে গরিব মানুষের অগ্রাধিকার, এই আওয়াজ তুলে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকেই মোরারজিকে সরিয়ে দেন। ইন্দিরা এর পর স্লোগান তোলেন, ‘গরিবি হঠাও’। তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রিভি কাউন্সিলের অনুমোদিত রাজন্য ভাতা, যা গোটা দেশের আমজনতার কাছে এক বিরাট বিষয় হয়ে ওঠে।
দেশভাগের পর প্রিন্সলি স্টেটগুলি ভারতের শাসনের অধীনে থাকবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক হয়। বল্লভভাই পটেল সংবিধান পরিষদেও আশ্বাস দিয়েছিলেন দেশীয় রাজাদের। কংগ্রেসের সেই আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশীয় রাজারা একত্রিত ভারতের অঙ্গ হন। তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের সম্পত্তির অধিকার থাকবে, রাজন্য অধিকার সুরক্ষিত হবে। ইন্দিরা উল্টো পথে হেঁটে সম্পত্তির অধিকারকেই মৌলিক অধিকারের তালিকা থেকে বাদ দিলেন।
এর ফলে তিনি দেশের মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক শ্রেণি ও গ্রামীণ গরিব মানুষের মধ্যে বিভাজন বা মেরুকরণ করতে সক্ষম হন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এটা মার্কসীয় শ্রেণি সংঘাত নয়, কিন্তু এই সিদ্ধান্তসমূহ সমাজের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষের কাছে তাঁকে নয়নের মণি করে তুলবে। ১৯৭০ সালে সংবিধান সংশোধন বিল সংসদে এনে ইন্দিরা প্রিভি সম্পত্তির অধিকার যখন ঘুচিয়ে দিলেন তখন দেশ তোলপাড়। লোকসভায় পাশ হলেও রাজ্যসভায় বিলটি হেরে যায়। তখন তিনি রাষ্ট্রপতির দ্বারস্থ হন। কিন্তু দেশের রাজারা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়ে রাষ্ট্রপতির ‘প্রোক্ল্যামেশন’-এর বিরোধিতা করেন। সুপ্রিম কোর্ট রাষ্ট্রপতির ‘প্রোক্ল্যামেশন’ খারিজ করে দেয়।
আর তার পরেই ’৭১ সালে তিনি অন্তর্বর্তী নির্বাচনের ডাক দেন। বিরোধীরা যখন বললেন, ‘ইন্দিরা হঠাও’, ইন্দিরা গর্জে উঠলেন, ‘গরিবি হঠাও’। ইন্দিরা ’৭১-এর নির্বাচনে নিজেই নিজেকে ভোটের ইস্যু করে তুললেন। ৪৩ দিনে ৩৬ হাজার মাইল তিনি পরিভ্রমণ করেন। ৩০০টি বড় জনসভা করেন। ২ কোটি মানুষ তাঁর বক্তব্য শোনেন। ৩৫২টি আসনে ইন্দিরার কংগ্রেস জেতে। ’৬৭ সালের নির্বাচনী বিপর্যয়ের বিপরীত ঘটনা ছিল সেটি। ’৭১ সালের ১৮ মার্চ তৃতীয় বারের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হন।
ভারতের রাজনীতিতে এর পর অনেক উথালপাতাল হয়েছে। জঙ্গি আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন ইন্দিরা গাঁধী। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যতই বদল আসুক, সেই বামপন্থী রাজনীতি বা রাজনৈতিক পপুলিজমের ধারাটি অব্যাহত থেকেই গেছে। ’৯১ সালে নরসিংহ রাওয়ের জমানায় মনমোহন সিংহ আর্থিক উদারবাদের ঝড় তোলেন এ দেশের মাটিতে। তখন বিশ্ব জুড়েই আর্থিক উদারবাদের ঝড়। মনমোহন যথাসময়ে ভারতের লাইসেন্স-পারমিট যুগকে উদার ও মুক্ত অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে যান। তবু সব শেষে ভারতের রাজনীতিতে জয় হয় ‘রিফর্ম উইথ হিউম্যান ফেস’-এর তত্ত্ব। সংস্কারের এই মানবিক মুখ দেখেছি মনমোহনের ইউপিএ জমানাতেও। সনিয়া গাঁধী নিজে জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদের চেয়ারপার্সন হয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলেন। সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে দারিদ্র দূরীকরণের কথাই বলা হয়।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন ক্ষমতায় এলেন বিজেপিকে বিপুল ভোটে জিতিয়ে, তখনও অনেকে ভেবেছিলেন, এ বার হয়তো ভারতে রিপাবলিকান দলের এক ভারতীয় সংস্করণ দেখা যাবে। জগদীশ ভগবতীর লাইনে বৃদ্ধির ইঞ্জিন দৌড়বে দক্ষিণপন্থী সংস্কারের পথে। তিন বছর অতিবাহিত হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, ভর্তুকি নির্ভর বামপন্থী পপুলিজম-কে পরিত্যক্ত করার রাজনৈতিক সাহস প্রদর্শনের ক্ষমতা নরেন্দ্র মোদীরও নেই।
ইন্দিরার সেই বামপন্থী পথের প্রাসঙ্গিকতা ভারতের রাজনীতিতে তবে থেকেই গেল?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy