এ বারে যেন অন্য রকম! অতীতে বারেবারেই দেখা গিয়েছে, সন্ত্রাসবাদী হামলা নিয়ে ভারতের যাবতীয় অভিযোগ বেমালুম উড়িয়ে দেওয়াটাই পাকিস্তানের অভ্যেস। এ বারে কি না মিলল সহযোগিতার আশ্বাস! পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আজ নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে আশ্বাস দিয়েছেন, পাঠানকোট হামলার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেবে তাঁর সরকার। এ যাত্রায় ভারতও অবশ্য তড়িঘড়ি আঙুল তোলেনি পাক সরকারের দিকে। পাঠানকোটের হামলায় পাক-যোগ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে বা সামরিক বাহিনীগুলির বিবৃতিতে যা-ই বলা হোক না কেন, নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু সরাসরি পাক সরকারকে দায়ী করার পথে হাঁটেনি। যদিও এ নিয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে বিরোধীদের, এমনকী শিবসেনার মতো শরিকদের সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে মোদীকে। একই সঙ্গে এই প্রশ্নটিও উঠে আসছে যে, তবে কি অভিযোগ আর অস্বীকারের বাঁধা গত ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে প্রতিবেশী দুই দেশের সরকার?
বিষয়টিকে এতটাই সরল বলে মনে করছে না বিদেশ মন্ত্রক। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে নওয়াজের ফোনকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা। মূলত দু’টি কারণে। এক, এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, পাঠানকোট হামলার পরে পাকিস্তানের ‘স্টেট অ্যাক্টর’ তথা নির্বাচিত সরকার ও প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়েই চলছে মোদী সরকার। দুই, আপাত ভাবে বেনজির সাহস দেখিয়ে নওয়াজও আইএসআই তথা পাক সেনার চিরাচরিত অবস্থানকে অগ্রাহ্য করলেন। নিজে ফোন করলেন মোদীকে। তা-ও এমন একটি ঘটনা নিয়ে, যার সঙ্গে পাক জঙ্গিপনার সংযোগের অভিযোগ উঠে আসছে বিভিন্ন সূত্র ও তথ্যের ভিত্তিতে। ফোন করে সমবেদনা জানিয়েই থামেননি নওয়াজ। মোদী যেমন ফোনে নওয়াজকে পাঠানকোটের নাশকতার সঙ্গে যুক্ত জঙ্গি এবং সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন, তেমনই নওয়াজও তাঁকে জানিয়েছেন জঙ্গিদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার ‘দ্রুত নির্ণায়ক ভূমিকা’ নেবে।
এ দিন পাক নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেনারেল নাসির খান জানজুয়াও ফোন করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালকে। পাঠানকোট-হামলা নিয়ে ‘সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর’ কিছু তথ্যও বিনিময় হয়েছে দু’জনের মধ্যে। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, পাঠানকোটে সন্ত্রাসের জেরে ভারত-পাক আলোচনার প্রক্রিয়াটি যাতে ফের হিমঘরে না ঢুকে যায় তার জন্য গত দু’দিন ধরে নওয়াজ-প্রশাসনের সঙ্গে যৌথ ভাবে কৌশল রচনা করে যাওয়া হয়েছে গোপনে। লক্ষ্যণীয় ভাবে সঙ্ঘের নেতারাও পাক সরকারকে তুলোধোনা করতে সে ভাবে মুখ খোলেননি এ যাত্রা। সাউথ ব্লকের এক কর্তার মতে, ‘‘পাকিস্তানের জঙ্গি তথা ‘নন স্টেট অ্যাক্টর’দের বিচ্ছিন্ন করতে নওয়াজ প্রশাসনকে শক্তিশালী করাটা খুবই প্রয়োজন। নওয়াজ যদি দুর্বল হয়ে যান, তবে তা নয়াদিল্লির নিরাপত্তার দিক থেকে খুবই আশঙ্কাজনক।’’
অতীতে মনমোহন সিংহ ঠিক এই যুক্তিতেই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনা চালানোর পক্ষে সওয়াল করেছেন। দেশে রাজনৈতিক বিরোধিতা উপেক্ষা করে পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছেন শর্ম-এল-শেখে। প্রধানমন্ত্রীর কুর্শিতে বসার পর, মোদীও এই নীতি নিয়েই চলতে শুরু করেন। প্রথমেই শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান নওয়াজকে। পরে ঘরোয়া রাজনৈতিক আবেগ ও বাধ্যবাধকতার জন্য অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয় দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক। কিন্তু গত জুলাই থেকে বৈঠকের বন্ধ দরজাকে খুলতে সক্রিয় হন মোদী। ফের মোদী-শরিফ কথা শুরু হয় রাশিয়ার উফায়। এর পর প্যারিসের জলবায়ু সম্মেলনে, ব্যাঙ্ককে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকে, এবং সম্প্রতি শরিফের জন্মদিন ও নাতনির বিয়ে উপলক্ষে মোদীর লাহৌরযাত্রায় আলোচনার প্রক্রিয়াটিই ধাপে ধাপে এগিয়েছে। কেন্দ্র চায়নি, মোদী লাহৌর ঘুরে আসার পরই সেই সফরের মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিক পাঠানকোট। আর তাই নওয়াজকে সঙ্গে নিয়ে চলার কথাই ভাবা হয়।
কূটনীতিকদের একটি অংশের বক্তব্য, নওয়াজ নিজে থেকে এই ফোনটি করায়, এবং সন্ত্রাস দমনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায়, কাজটা ভারতের পক্ষেও সহজ হয়ে গেল। বিরোধীদের আক্রমণের জবাব দিতে গিয়ে বা জাতীয় আবেগকে মর্যাদা দিতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারকে বিদ্ধ করার দায়টা অন্তত রইল না।
তবে শরিফের আশ্বাসের উপরে তেমন আস্থা রাখতে নারাজ ভারতীয় কূটনীতিকদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, এর আগে ২৬/১১-র ঘটনাতেও দোষী পাক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছিল ইসলামাবাদ। কিন্তু ৭ বছর গড়িয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, ভারত চাইল, আর নওয়াজও আইএসআই, সেনাবাহিনী ও দেশের মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে নিজে থেকে মোদীকে ফোন করে ফেললেন, এটা কী ভাবে সম্ভব হল? পাক রাজনীতির ডিএনএ-তেই সন্ত্রাস দমনে সহযোগিতার কোনও চিহ্ন কখনও ছিল না।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এর একটি বড় কারণ হল, মার্কিন চাপ। অতীতে এ ভাবেই সে দেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফকে শান্তি আলোচনায় সামিল করিয়েছে হোয়াইট হাউস। এরই সঙ্গে পাক সেনাকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেই নওয়াজ এই ফোন করেছেন— এমন একটি সম্ভাবনার কথাও কিন্তু উঠে আসছে। এর আগে দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্যায়ের বৈঠকের পিছনে পাক সেনার প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। পাক সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জানজুয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তবে সে ক্ষেত্রে, পাক সেনার সঙ্গে নওয়াজের কী মর্মে বোঝাপড়া হয়েছে, বা আদৌ হয়েছে কি না, এ বার সেটাই বুঝতে চাইছে নয়াদিল্লি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy