সোজা পথে প্রশ্নের কাঁটা। সাংসদদের বেতন বাড়াতে তাই এ বার ‘নিরপেক্ষ’ বেতন-ভাতা কমিশন আনতে চাইছে কেন্দ্র।
এত দিন সাংসদরাই ঠিক করতেন, তাঁদের বেতন ও পেনশনের অঙ্কটা কেমন হবে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশ ছিল, এক ধাক্কায় বেতন ও অন্যান্য ভাতা দ্বিগুণ করে দেওয়া হোক। তখনই প্রশ্ন ওঠে, দেশে আর কেউ নিজের বেতন নিজেই ঠিক করেন না। তা হলে সাংসদরা ব্যতিক্রম কেন? চাপের মুখে পড়েই কেন্দ্র তাই এ বার সাংসদদের বেতন বৃদ্ধিতে স্বাধীন কমিশন তৈরির প্রস্তাব আনল।
এখন কী কী সুযোগ-সুবিধা পান সাংসদরা? সূত্রের খবর, মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন পান তাঁরা। সঙ্গে অফিস চালানোর খরচ ও নির্বাচনী কেন্দ্রে কাজের ভাতা বাবদ আরও ৬০ হাজার টাকা। এই ৬০ হাজার টাকা পুরোপুরি আয়কর-মুক্ত। অর্থাৎ মাসে অঙ্কটা পৌঁছয় ১ লক্ষ ১০ হাজারে। সঙ্গে আরও নানা সুযোগ-সুবিধা! সাংসদরা কিন্তু বলছেন, বেতনটা খুবই কম। ২০০৯-এর পরে বেতন বাড়েনি। অথচ মূল্যবৃদ্ধি সীমা ছাড়িয়েছে। সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা দফায় দফায় বেড়েছে। কিন্তু সাংসদদের ‘স্যালারি-স্লিপ’ সেই আগের মতোই!
এই অভিযোগ মাথায় রেখেই সাংসদদের নিয়ে তৈরি সংসদীয় কমিটি তাই সুপারিশ করে, বেতন, অফিস খরচ ও ভাতার অঙ্কটা দ্বিগুণ করা হোক। ২০ হাজার থেকে পেনশন বাড়িয়ে ৩৫ হাজার টাকা করারও দাবি ওঠে। বিতর্কের সূত্রপাত এখান থেকেই। বিতর্কে ঘি ঢালে সংসদের ক্যান্টিনে ঢালাও ভর্তুকি।
চাপ এড়াতেই তাই এ বার সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রক তিন সদস্যের স্বাধীন বেতন-ভাতা কমিশন তৈরির প্রস্তাব তৈরি করেছে। আগামী সপ্তাহে বিশাখাপত্তনমে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সচেতকদের দু’দিনের সম্মেলন বসছে। সেখানেই এই প্রস্তাবে সিলমোহর বসবে বলে সূত্রের খবর।
তাতে লাভ কী? মন্ত্রকের বক্তব্য, ‘‘নিজেদের বেতন সাংসদরা নিজেরাই ঠিক করছেন বলে যে সমালোচনা শুরু হয়েছে, এই কমিশন তৈরি হলে আশা করি তা বন্ধ হবে।’’ পাশাপাশি, সাংসদদের বেতন যাতে উচিত হারে বাড়ে, তা-ও এই কমিশন নিশ্চিত করবে বলে জানানো হয়েছে। সূত্রের খবর, এ জন্য ১৯৫৪ সালের সাংসদ বেতন, ভাতা ও পেনশন আইনের সংশোধন করতেও তৈরি মোদী সরকার।
কিন্তু কোন নীতি মেনে সাংসদদের বেতন ঠিক করবে কমিশন?
প্রস্তাবিত কমিশন এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় মাথায় রাখবে। প্রথমত, সাংসদদের যথাযথ বেতন। কারণ, বেতন কম হলে অন্য কেরিয়ার ছেড়ে কেউ সংসদে না-ও আসতে পারেন। আবার বেতন বেশি হলেও বিপত্তি। তখন শুধু টাকার লোভেই সবাই সাংসদ হতে চাইবেন, বলে আশঙ্কা থাকছে।
দ্বিতীয়ত, সাংসদদের কী কী দায়িত্ব সামলাতে হয়, তা মাথায় রেখেই বেতন ঠিক করতে হবে। আর তৃতীয়ত, যাঁদের বাইরের কাজে আগ্রহ রয়েছে, তাঁরাও যাতে সংসদে আসতে উৎসাহী হন, ভাববে কমিশন। ভাবা হবে সংসদীয় রাজনীতিতে সর্বক্ষণের কর্মীদের যথোচিত মূল্য দেওয়ার বিষয়টিও।
সাংসদদের বেতন ঠিক করতে নিরপেক্ষ এই কমিশন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়ে মোদী সরকার কার্যত ব্রিটেনের পথেই হাঁটল বলে মনে করছে কূটনীতিকদের একাংশ। ব্রিটেনের হাউস অফ কমন্সের বেতন স্বাধীন সংস্থাই ঠিক করে। ব্রিটেন ছাড়া ভুটান ও নামিবিয়াতেও একই প্রথা চালু রয়েছে। অধিকাংশ দেশে অবশ্য উল্টো নিয়মই চালু। ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সমীক্ষা অনুযায়ী, ১০৪টি দেশের ১৩৮টি আইনসভার মধ্যে ৬৯টিতে সদস্যরাই ঠিক করেন, তাঁদের বেতন কত হবে। ৩১টি ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের বেতনক্রম অনুযায়ী সাংসদদের বেতন ঠিক হয়।
কিন্তু এ দেশের সাংসদদের বেতন কি কম? সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রকের তেমনটাই দাবি। কেন্দ্র বলছে, বিশ্বে মাত্র ছ’টি দেশের সাংসদদের বেতন এ দেশের সাংসদদের থেকে কম। সেগুলি হল তিউনিশিয়া, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, হাইতি ও পানামা। কাজেই ভারতীয় সাংসদদের বেতনবৃদ্ধির দাবি একেবারেই অমূলক নয়।
কারণ যা-ই হোক। বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সংসদীয় কমিটির সুপারিশেই সম্প্রতি সাংসদদের বেতন ও পেনশন বৃদ্ধির দাবি ওঠে। এখন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যোগ দিতে এলে সাংসদরা বিমান ভাড়ার সিকি ভাগ ভাতা হিসেবে পান। ওই কমিটির সুপারিশ ছিল, ট্রেনে যাতায়াত করলেও ওই ভাতা দেওয়া হোক। বছরে বিমানের টিকিটের সংখ্যা ৩৪ থেকে বাড়িয়ে ৪৮ করার দাবিও ওঠে। সাংসদদের জন্য আবাসন, গৃহ ঋণ, সরকারি গাড়ি, রাজ্যের রাজধানীতে অতিথিশালা, সংসদ ভবনেই কেবিন ও কাজের জায়গা, রাস্তার টোল মকুব, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য আলাদা ক্যান্টিনের মতো এক গুচ্ছ সুপারিশও ছিল তাতে।
ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়েই সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রক তা মেনে নেয়নি বলে সূত্রের খবর। এ বার বেতন-ভাতা কমিশন কী সুপারিশ করে, মুখিয়ে সাংসদরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy