ইমেল আর হোয়াটসঅ্যাপের দুনিয়ায় চিঠি লেখার দিন গিয়েছে কবেই। কিন্তু প্রতি বছর পুজোর আগে পোস্টকার্ডের চাহিদা বাড়ে রাঁচির রিনপাসে।
রিনপাস মানে রাঁচি ইনস্টিটিটিউট অব নিউরো সাইকিয়াট্রিক অ্যান্ড অ্যালায়েড সায়েন্স। আমজনতা যাকে মানসিক রোগের হাসপাতাল বলে জানে।
সেই হাসপাতালেই বহু বছর ধরে রয়ে গিয়েছেন ওঁরা। রিনপাসের অধ্যাপক আমূল রঞ্জন বললেন, কমপক্ষে ৩০ জন তো বটেই। এঁরা অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু এঁদের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কেউ নেই। বাড়ির লোকে তাঁদের কোনও খোঁজখবর নেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। বছরের পর বছর কেটে যায়। কিন্তু পুজো এলেই মনটা টনটন করে। নাছোড় আশা বুক ঠেলে উঁকি দিতে থাকে! দেখাই যাক না একটা চিঠি লিখে! যদি কেউ আসে! ওঁরা তাই পোস্টকার্ডের খোঁজ করতে থাকেন। প্রতি বছরই হয় এ রকম। চিঠি লেখা, উত্তরের অপেক্ষায় থাকা, উত্তর না আসা...। তার পর আবার পরের বছর পুজোয় ভাবা, আর এক চেষ্টা করে দেখা যাক! হয়তো এ বার সাড়া দেবে! যদি পুজোর সময়টা বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হয়! মনের মধ্যে ভিড় করে আসে সুসময়ের স্মৃতি— পরিবারের ওম, ঠাকুরের মুখ, ঢাকের আওয়াজ!
১২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ওমপ্রকাশ বর্মা যেমন। গত ২৫ বছর ধরে রিনপাসে রয়েছেন। বাড়ি বিহারের কাটিহারে। বললেন, ‘‘পুজো এলে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ে। তাই পুজোর আগে বাবাকে চিঠি লিখি। জানি না বাবা বেঁচে আছে কি না।’’ ওমপ্রকাশের বাড়ির ঠিকানায় হাসপাতালের তরফেও অনেক বার যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু জানা গিয়েছে, সেই ঠিকানায় এখন আর কেউ থাকেন না।
বাড়ির পথে বিলাস।-নিজস্ব চিত্র।
আমূলবাবু বলেন, যাঁরা এই রোগীদের এখানে রেখে গিয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই ভুল ঠিকানা লিখে গিয়েছেন। ফোন নম্বরও ভুল। আর এক চিকিৎসক সিদ্ধার্থ সিনহা বলেন, ‘‘ওঁরা স্মৃতি থেকে জায়গার যা বর্ণনা দেন, সেখানেও অনেক সময় ওঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই ওঁদের পরিজনদের খুঁজে পাওয়া যায় না।’
তবে একটি ব্যতিক্রম হয়েছে এই বছর। ২১ বছর পরে বাড়ি যেতে পেরেছেন বিহারের সিতামঢ়ীর বাসিন্দা বিলাস প্রতিম। বয়স এখন ষাট পেরিয়েছে। রিনপাসের মনোবিদ অঞ্জলি সিংহ বলেন, ‘‘বিলাসও প্রতি বছর পুজোর আগে বাড়ির ঠিকানায় চিঠি লিখতেন। কিন্তু উত্তর পেতেন না। এ বার মিরাকল ঘটল।’’ কী রকম? যে ঠিকানায় প্রতি বার চিঠি দিতেন বিলাস, সেখান থেকেই এ বার একটি চিঠি এল। সেখানে জানানো হয়েছে, বিলাসের পরিজনরা বেশির ভাগই বেঁচে নেই। তাই ওঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়ার মতোও কেউ নেই। তবু একটা হদিস তো মিলল! রিনপাসের এক কর্মীর মাধ্যমেই বিলাসকে ওই ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ি চিনে যেতে পেরেছেন বিলাস।
ভুবনেশ্বর কুমার বা সহদেবরাও রয়েছেন বহু বছর ধরে। বিলাসকে বাড়ি যেতে দেখে তাঁদের মনেও আশা জেগেছে। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, ভুবনেশ্বর বা সহদেবদের চিঠির কোনও উত্তর আসে না। তাঁদের বাড়ির ঠিকানায় লোক পাঠিয়েও লাভ হয়নি।
তবু প্রতি বছর পুজোর আগে আসে পোস্টকার্ড। কাঁপা হাতে অনেকখানি সাহস জমিয়ে দু’ছত্র লিখতে বসা। ক’দিন পরেই অবধারিত ভাবে হতাশায় কুঁকড়ে যাওয়া। চিকিৎসকরা স্বীকার করলেন, ওঁদের দেখতে দেখতে মাঝে মাঝেই গুলিয়ে যায় সব। ওঁদের মনে হয়, আসলে মানসিক ভাবে অসুস্থ কে? এই রোগীরা নাকি তাদের পরিজনেরা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy