প্রচারে রাজা। নিজস্ব চিত্র
হাঁটু পর্যন্ত গোটানো দুধসাদা ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট। দলে দলে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন সকলে। মাথায় ফুলের মালা জড়ানো প্রৌঢ়ারা হোঁচট খেতে খেতেও হাঁটছেন হনহন করে। ‘‘রাসা-রাসা’’ চিৎকারে কান পাতা দায়। ভিড় নিয়ন্ত্রণে নাজেহাল পুলিশ। জনতার গন্তব্য একটাই, উটি কালেক্টরেট অফিস।
তামিলনাড়ুর নীলগিরি কেন্দ্রের ডিএমকে প্রার্থী আন্দিমুথু রাজার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ঘিরে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষের ভিড় আর গাড়ির চাপে আজ দুপুরে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল উটি। কালেক্টরেট অফিসের আশপাশে অন্তত ঘণ্টা তিনেক নড়াচড়া করতে পারেনি প্রায় কোনও গাড়িই।
তামিলে ‘রাসা’ শব্দের অর্থ রাজা। উটির আনাচকানাচে আজ একটাই স্লোগান, ‘তিরিম্বি বরুমপোথ রাজা’। অর্থাৎ রাজা ফিরছেন। টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির পরে এক বছর জেলে কাটানো রাজা ২০১৪-র নির্বাচনে নীলগিরিতে বড়সড় ধাক্কা খেয়েছিলেন। ২০১৭ সালে সব অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পান প্রথম ইউপিএ সরকারের প্রাক্তন এই টেলিকম মন্ত্রী। তার পর? মনোনয়নপত্র পেশের পরে নীলগিরির সাংসদ-অফিসে বসে স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্ন থামিয়ে দিয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিককে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
‘‘টু-জি রাজাকেই দেখতে অত দূর থেকে এসেছেন তো? আমি আপনাকে বলছি, লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অতীতের সমস্ত অপমান ঝেড়ে ফেলে লোকটা এখন হাসছে। আগামী দিনেও হাসবে।’’
এতটা আত্মবিশ্বাস?
গুণমুগ্ধদের তরফে পরিয়ে দেওয়া খান চারেক মোটা মালার ভারমুক্ত হয়ে রাজা বললেন, ‘‘দেখলেন তো নিজের চোখেই।’’
নীলগিরি লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্র। যার অর্ধেক পাহাড় এবং অর্ধেক সমতল। পাহাড়ে রাজার জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত হলেও সমতল নিয়ে কিছুটা চিন্তিত তাঁর অনুগামীরা। উটির বাজারে, চা বাগানে ঘুরে রাজা অনুরোধ করলেন, পাহাড়ের ভাইবোনেরা সমতলকে বোঝাক যে ‘রাসা’ তাঁদেরই লোক।
টু-জি কেলেঙ্কারির কালি যখন দলকে পুরোদস্তুর বেকায়দায় ফেলেছিল, সেই সময় অর্থাৎ ২০১৪-তেও ডিএমকে প্রধান করুণানিধি দুই অভিযুক্ত এ রাজা এবং দয়ানিধি মারানকে টিকিট দিয়েছিলেন। রাজ্য জুড়ে ভরাডুবি হয়েছিল ডিএমকের। রাজার দাবি, ‘‘এ বার ছবিটা বদলে গিয়েছে। এডিএমকের দুর্নীতির ফাঁসে হাঁসফাঁস করা সাধারণ মানুষ কেন্দ্র এবং রাজ্য— দু’জায়গাতেই বদল চাইছেন।’’ একই সঙ্গে সংযোজন, ‘‘সাধারণ মানুষ মোদীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। বিজেপির সঙ্গে হাত মেলানোয় তামিলনাড়ুর মানুষ তাই এডিএমকের থেকেও মুখ ফেরাবে।’’
কোয়ম্বত্তূর থেকে কুন্নুরের দূরত্ব গাড়িতে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। গাড়ির চালক বিনোদ, রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানের বিনু, ফুলের মালার পসরা নিয়ে বসা মায়া— অনেকের মুখেই এ বার বদলের কথা। এডিএমকে-র কট্টর সমর্থক বিনোদ বলেছেন, ‘‘যত দিন জয়ললিতা ছিলেন, তত দিন তবু কিছু কাজ হত। এখনকার নেতারা শুধুই দু’হাতে টাকা লোটার জন্য ক্ষমতায় আছেন। তামিলনাড়ুর কোনও কাজে তাঁদের মন নেই।’’ ওই কাজে মন না থাকার কথা শোনা গিয়েছে নীলগিরির গত বারের জয়ী প্রার্থী এডিএমকের সি গোপালকৃষ্ণন সম্পর্কেও। এ বার টিকিট পাননি। নতুন প্রার্থী ত্যাগরাজন যতই নিজের জেতা নিয়ে একশো ভাগ নিশ্চিন্ত থাকার কথা বলুন না কেন, কুন্নুর ও উটির বহু এলাকা ঘুরে তাঁর সম্পর্কেও শুধু দীর্ঘশ্বাসই শোনা গিয়েছে। গোপালকৃষ্ণন না কি নিজের নির্বাচনী এলাকাতেই যেতেন না। তাই নতুন প্রার্থী ত্যাগরাজনের সঙ্গে প্রচারে গোপালকৃষ্ণন থাকায় এডিএমকে নেতাদের বিভিন্ন এলাকায় শুনতে হয়েছে যে, ‘‘আমাদের দরকারে আপনাদের পাই না। তাই আপনাদের দরকারেও আমরা নেই।’’
অন্য দিকে, রাজার ব্যাপারে এক বাক্যে অনেকেই বলেছেন, রাজা ক্ষমতায় থেকেও এলাকার মানুষের কাছে যেতেন তিনি। যখন ক্ষমতায় ছিলেন না তখনও তার ব্যতিক্রম ঘটত না। প্রশ্ন হল, এতই যদি রাজার প্রতি ভালবাসা, তবে গত লোকসভা ভোটে তাঁকে এক লক্ষেরও বেশি ভোটে হারতে হয়েছিল কেন?
সেই যুক্তি অবশ্য তৈরি রয়েছে ডিএমকে নেতাদের কাছে। তাঁরা বলছেন, গত বার জয়ললিতা উঠেপড়ে লেগেছিলেন রাজাকে হারাতে। এক দিকে দুর্নীতির অভিযোগ, অন্য দিকে আম্মার বাড়তি তৎপরতা— এই দুইয়ের ওভারডোজে ধরাশায়ী হন পেরামবুলুর থেকে তিন বার এবং নীলগিরি থেকে এক বার জেতা সাংসদ। এ বার সে ভয় নেই।
তবে কি মনোনয়ন পেশের দিন থেকেই রাজাকে নিয়ে নিশ্চিন্ত ডিএমকে? বিরোধীরা বলছেন, ভালমন্দ খাইয়ে এবং নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে ভিড় বাড়ানো বড় ব্যাপার নয়। আর দলের নিন্দুকেরা জনান্তিকে বলছেন, ‘না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’ ২০১৪ তে রাসা-রাসা করে চেঁচিয়েও ভোট পড়েছিল অন্য দিকে। তাই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী না হয়ে বাড়তি সাবধানী হওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy