আলাদা রাজ্য। আলাদা পরিস্থিতি। দু’রাজ্যেই বিধানসভা নির্বাচন সামনে। পরিস্থিতি বিচার করে কংগ্রেস-প্রশ্নে দুই রাজ্যে আলাদা কৌশল নিয়ে এগোতে শুরু করল সিপিএম।
কেরলে সদ্য পঞ্চায়েত ও পুরভোটে বিপুল সাফল্য পেয়েছে সিপিএমের নেতৃত্বাধীন এলডিএফ। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন শাসক ফ্রন্ট ইউডিএফের চেয়ে আসন এবং মোট ভোটও বেশি পেয়েছে বামেরা। নির্বাচনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘুষ-কাণ্ডে কেরল হাইকোর্টের রায় গিয়েছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। তার প্রেক্ষিতে ইস্তফা দিতে হয়েছে শাসক ফ্রন্টের শরিক দল কেরল কংগ্রেস (এম) নেতা কে এম মানিকে। এই ঘটনাপ্রবাহ মাথায় রেখেই মুখ্যমন্ত্রী উম্মেন চান্ডির পদত্যাগের দাবি আরও জোরালো করে তুলে আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেরল সিপিএম। দলের রাজ্য নেতৃত্বের সাফ যুক্তি, এর পরে আর কংগ্রেস সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনও নৈতিক অধিকার নেই!
কিন্তু এর ঠিক উল্টো পথে চলছে বঙ্গ রাজনীতির সমীকরণ! বিধানসভা ভোটের আগে এ রাজ্যে বরং কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক আদানপ্রদান বাড়িয়ে দিচ্ছে আলিমুদ্দিন। সাম্প্রদায়িক বিভাজন এবং অসহিষ্ণুতার পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতে শনিবার কলকাতায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর স্মরণে আলোচনাসভায় প্রতিনিধি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের কথায়, ‘‘অসহিষ্ণুতার এই পরিবেশে নেহরুর ঐতিহ্যকে স্মরণ করা সময়োপযুক্ত বলেই আমরা মনে করি। উদ্যোক্তারা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক থাকলেও অনুষ্ঠানের গুরুত্ব বিচার করে সেখানে আমাদের তরফে অংশগ্রহণ করা হবে।’’ শনিবারের অনুষ্ঠানে বক্তা তালিকায় নাম আছে লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, সমাজকর্মী তিস্তা শীতলওয়াড়, ইতিহাসবিদ হোসেনুর রহমান প্রমুখের। সভাপতিত্ব করার কথা স্বয়ং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর। সে ক্ষেত্রে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সংহতি জানানোই সিপিএমের বর্তমান ও প্রাক্তন সাংসদদের তিন জনের প্রতিনিধি দলের কাজ হবে।
রাজ্যের শাসক তৃণমূল বা কেন্দ্রের শাসক বিজেপি-র অভিযোগ, দু’রাজ্যে সিপিএমের দু’রকম মনোভাব আসলে দ্বিচারিতা! বামফ্রন্ট এবং বৃহত্তর বাম ঐক্যের শরিকদের মধ্যেও এই নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমোদন নিয়ে দু’রাজ্যের সিপিএম নেতারা এই পথে পা বাড়িয়েছেন সচেতন ভাবেই। বাংলায় তৃণমূলের মোকাবিলায় বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হয়ে সিপিএমের ভিতরে-বাইরে এই প্রশ্নই সাম্প্রতিক কালে বারবার দেখা দিয়েছে যে, একই দল একই সময়ে দু’টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে নিয়ে দু’রকম অবস্থান কী ভাবে নেবে? কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গেই মূল লড়াই হবে। আবার বাংলায় তাদের সঙ্গেই সমঝোতা কী ভাবে সম্ভব? সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্ব এখনকার কর্মসূচি থেকেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন, পরিস্থিতিমাফিক দুই রাজ্যের অগ্রাধিকারও তাঁদের কাছে আলাদা। দলের এক পলিটব্যুরো সদস্যের কথায়, ‘‘নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা। এ তো কার্ল মার্ক্স দেখিয়ে গিয়েছেন! নতুন কথা তো কিছু নয়!’’ তাঁরা উদাহরণ দিচ্ছেন, কেন্দ্রে ইউপিএ-১ যখন বামেদের সমর্থনে চলছে, তার মধ্যেই ২০০৬ সালে কংগ্রেসকে হারিয়ে কেরলে ক্ষমতায় এসেছিল বামেরা। সেটা যদি সম্ভব হতে পারে, তা হলে এখনই বা রাজ্য ভেদে ভিন্ন কৌশল চলবে না কেন?
সিপিএমের কেরল রাজ্য সম্পাদক কোডিয়ারি বালকৃষ্ণন তাই পরিষ্কার বলে দিচ্ছেন, ‘‘ঘুষ-কাণ্ডে নিরপেক্ষ তদন্তে মুখ্যমন্ত্রী বারবার বাধা দিয়েছেন। এর মধ্যে পঞ্চায়েত ও পুরভোটে কেরলের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, চান্ডি সরকারের উপরে তাঁদের কোনও আস্থা নেই। এখন চান্ডি সরকারের আর গদিতে থাকার অধিকার নেই!’’ বালকৃষ্ণনেরা জানেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের দাবি না মানলেও বিধানসভা ভোটের আগে কয়েক মাসে এই নিয়ে রাজনীতি সরগরম রাখা যাবে! আর অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে যখন দেশ জোড়া প্রতিবাদ, তখন বাংলায় শাসক দলকে একই হাতিয়ারে বিদ্ধ করা নেহরু স্মরণের উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্য। লক্ষ্য অভিন্ন হওয়ায় সেখানে সেতু বাঁধতে এগিয়ে যাচ্ছে আলিমুদ্দিনও।
এর মানে অবশ্যই এমন নয় যে, বঙ্গে কংগ্রেস-সিপিএম জোট বা প্রত্যক্ষ কোনও আঁতাঁত সম্ভব। কিন্তু পরোক্ষ বোঝাপড়া যে হতে পারে, কংগ্রেস নেতারাও তা মানছেন। কেউ কেউ অবশ্য প্রশ্ন তুলছেন, কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিওয়ালির শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন! প্রদেশ কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার জবাব, ‘‘ওটা তো সৌজন্য। দেশ জুড়ে বিভিন্ন দলের নেতাদেরই সনিয়াজি শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন। তার সঙ্গে রাজ্যের সমীকরণ এক করে দেখা উচিত নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy