কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। —ফাইল চিত্র।
গুরুতর অভিযোগ দলের সাংসদের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তৃণমূলের অবস্থান কী? কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে সংসদে ‘টাকা নিয়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগের প্রথম দিকে দূরত্বই বজায় রেখে আসছিল তৃণমূল। তবে বৃহস্পতিবার মহুয়া এথিক্স কমিটির বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসার পর সাংসদের পাশে একে একে দাঁড়ালেন তাঁর দুই সতীর্থ। তাঁদের মধ্যে এক জন তৃণমূলের লোকসভার নেতা স্বয়ং। এ বার কি মহুয়াকে নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করছে তৃণমূল? মহুয়ার নিজের দাবি, দল তাঁর পাশে ২০০ শতাংশই আছে। কিন্তু এই লড়াইটা তাঁর নিজের। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ দুরমুশ তিনি একাই করবেন। বস্তুত, প্রথম থেকে তৃণমূলও তাই বলে এসেছে। দলের রাজ্যসভার নেতা ডেরেক ও’ব্রায়ান জানিয়েছিলেন, এথিক্স কমটির বৈঠকের পর মহুয়া সংক্রান্ত যা পদক্ষেপ করার করবে দল। এথিক্স কমিটর বৈঠকের মাঝপথে মহুয়া বেরিয়ে আসার পর তাঁর পক্ষ নিলেন সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শতাব্দী রায়।
নগদ অর্থ এবং উপহারের বিনিময়ে সংসদে আদানিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে জড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মহুয়া— তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে এমনই অভিযোগ এনেছেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। তাঁর দাবি, শিল্পপতি দর্শন হীরানন্দানি এবং মহুয়া মিলে গৌতম আদানির তথা আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র’ করেছেন। এই মর্মে তিনি লোকসভার স্পিকার এবং লোকপালকে চিঠি লেখেন। দাবি করেন, কোথায় কবে, কত টাকা নিয়েছেন মহুয়া— সে সব প্রমাণও হাতে রয়েছে তাঁর। এমনকি, সেই ঘুষের অঙ্ক দু’কোটি টাকা বলেও দাবি করেছেন দুবে। অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার এথিক্স কমিটির বৈঠকে হাজির হন মহুয়া। কিন্তু বৃহস্পতিবার এথিক্স কমিটির বৈঠক অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়েন মহুয়া। তার পর সন্ধ্যায় লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লাকে তিন পাতার একটি চিঠি লিখেছেন কৃষ্ণনগরের সাংসদ। তাতে এক ডজন পয়েন্ট উল্লেখ করে তাঁর অভিযোগ, যে কায়দায় তাঁকে প্রশ্ন করেছেন এথিক্স কমিটির চেয়ারম্যান, তা মর্যাদাহানিকর। তিনি এ-ও জানান, তাঁকে অপ্রাসঙ্গিক এবং ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা হয়। কমিটির পাঁচ সদস্য তাতে আপত্তি জানান। কিন্তু সে সবে কর্ণপাত না করে চেয়ারম্যান ধারাবাহিক ভাবে প্রশ্ন করতে থাকেন বলে দাবি করেছেন মহুয়া। বৈঠকের মাঝপথে বেরিয়ে সংবাদমাধ্যমকে মহুয়ার মন্তব্য, ‘‘এটা কী ধরনের বৈঠক? ওঁরা নোংরা প্রশ্ন করছেন।’’
চিঠিতে কৃষ্ণনগরের সাংসদ লিখেছেন, তিনি গত রাতে কার সঙ্গে, কত বার ফোনে কথা বলেছেন, তার কল রেকর্ডের বিস্তারিত তথ্য জানতে চান কমিটির চেয়ারম্যান। লোকসভার স্পিকারের উদ্দেশে মহুয়া লিখেছেন, ‘‘দেশের শীর্ষ আদালত বলেছে, ব্যক্তিগত বিষয় গোপন রাখা নাগরিকের অধিকার। সেখানে আমায় ব্যক্তিগত বিষয় নিয়েই জানতে চাওয়া হয়।’’ তিনি তাঁর প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন বলেও চিঠিতে উল্লেখ করেছেন সাংসদ। এ নিয়ে শুক্রবার একটি টিভি চ্যানেলকে তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ জানিয়েছেন, বৈঠক ত্যাগ করে বেরিয়ে আসা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না মহুয়ার। তিনি এ-ও জানান, মহুয়া তাঁর দলের ঠিক করা রাস্তাতেই এগিয়েছেন। মোদী সরকার এবং আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ানোয় মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘প্রতিহিংসামূলক আচরণ’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। সুদীপের কথায়, ‘‘বিজেপিকে এটাকে (টাকা নিয়ে প্রশ্ন করার অভিযোগ) বড় ভাবে নিয়েছে। কারণ আদানি এবং মোদীর বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে বলে আসছে মহুয়া।’’ তিনি এ-ও বলেন, ‘‘দলের রাস্তা মেনে উচ্চতর পর্যায়ে সুর চড়া করে ও। সাংসদ হিসেবে ও (মহুয়া) সুনাম অর্জন করেছে। দলতন্ত্র মেনেই কাজ করেছে।’’ পাশাপাশি এথিক্স কমিটি ‘প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ’ করেছে বলে অভিযোগ করেছেন সুদীপ। তিনি বলেন, ‘‘এই অবস্থায় বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া মহুয়ার কোনও উপায় ছিল না।’’ আর শতাব্দীর দাবি, ‘‘মহুয়ার জনপ্রিয়তা বেশি। তাই তাঁকে নিশানা করছে বিজেপি।’’
তৃণমূল কি প্রথম থেকেই মহুয়ার পাশে?
এর আগে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ এথিক্স কমিটির ‘তোড়জোড়’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মহুয়া এক জন সাংসদ। সবে পুজো মিটেছে। তাঁর কেন্দ্রে ১০ খানা কর্মসূচি থাকতে পারে। এক বার চিঠি দিয়ে জানানোর পর ফের তাঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’’ কিন্তু, মহুয়া-প্রসঙ্গে তৃণমূল বা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সাংসদের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দিলেন না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা হয়। আর এ নিয়ে গত ২২ অক্টোবর ডেরেক বলেছিলেন, ‘‘এ বিষয়ে ‘সংবাদমাধ্যমে যে রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয়েছে, তা দেখেছে দল। তদন্তের পর যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মহুয়ার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করার পরামর্শ দিয়েছে দল। মহুয়া ইতিমধ্যেই তা করেছেন। যে হেতু এই ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন এক জন নির্বাচিত সাংসদ, তাই এই নিয়ে আগে তদন্ত করুক সংসদীয় প্যানেল। তার পরেই উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেবে দল।’’ কিন্তু মহুয়াকে নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে দুই সুর শোনা গিয়েছে তার পরও। যেমন, রাজ্যের মন্ত্রী তথা কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম জানিয়ে দেন, আদানি গোষ্ঠী এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে প্রশ্ন তোলার জন্য বিজেপির কোপে পড়েছেন সাংসদ। শুক্রবার প্রায় একই বক্তব্য উঠে এসেছে সুদীপের কণ্ঠে।
মহুয়া-বিতর্কের শুরু যেখানে
বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে অভিযোগ করেন, টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন তুলে মহুয়া মৈত্র লোকসভার স্বাধিকার ভঙ্গ করেছেন। তাঁর দাবি, এই অভিযোগের সপক্ষে প্রমাণ দিয়েছেন আইনজীবী জয় অনন্ত দেহাদ্রাই। যিনি এক সময়ে মহুয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। মহুয়াকে সংসদ থেকে অবিলম্বে বরখাস্ত করার জন্য লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে আবেদন জানান নিশিকান্ত। আবার আইনজীবী অনন্ত দেহাদ্রাই মহুয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে চিঠি দেন সিবিআই প্রধানকেও।
তার পর ওই দু’জনেই অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ী দর্শন হীরনন্দানির থেকে অর্থ, উপহার নিয়ে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মহুয়া কথা বলেছেন। সেই সঙ্গে মহুয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নাম জড়িয়েছেন।
মহুয়ার পাল্টা মামলা
দিল্লি হাই কোর্টে মানহানির মামলা করেন মহুয়া। তৃণমূল সাংসদের হয়ে প্রথমে মামলা লড়ছিলেন আইনজীবী গোপাল শঙ্করনারায়ণ। কিন্তু আদালত জানতে পারে আইনজীবী তাঁর মক্কেল এবং বিবাদী পক্ষের আইনজীবী দেহাদ্রাইয়ের মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেছেন। ওই অভিযোগ মেনে নিয়ে মামলা থেকে সরে দাঁড়ান আইনজীবী শঙ্করনারায়ণ। ৩১ অক্টোবর মানহানির মামলার শুনানিতে তৃণমূল সাংসদের আইনজীবী ছিলেন সমুদ্র ষড়ঙ্গী। তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি সচিন দত্তকে জানান, সংবাদমাধ্যমগুলির উপর করা মানহানির মামলায় কোনও ক্ষতিপূরণ চান না মহুয়া। তবে জারি থাকবে বিজেপি সাংসদ দুবে এবং আইনজীবী দেহাদ্রাইয়ের বিরুদ্ধে করা মানহানির মামলা। যদিও পুরো বিষয়টিকে মহুয়ার ‘ইউটার্ন’ বলে খোঁচা দেন নিশিকান্ত।
‘শিষ্টাচার ছাড়িয়েছেন মহুয়া’
এথিক্স কমিটির বৈঠক থেকে মহুয়ার বেরিয়ে আসা নিয়ে পাল্টা কটাক্ষ করলেন বিজেপি সাংসদ অপরাজিতা ষড়ঙ্গী। সংসদের এথিক্স কমিটির সদস্য বিজেপি সাংসদ অপরাজিতার দাবি বৈঠকে ‘শিষ্টাচার’-এর মাত্রা ছাড়িয়েছিলেন তৃণমূল সাংসদ। অপরাজিতার দাবি, মহুয়াই ব্যক্তিগত বিষয়েই বেশি কথা বলে যাচ্ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘চেয়ারম্যান যখন হলফনামার উপর ভিত্তি করে কিছু প্রশ্ন করেন, তখন মাথা গরম করে ফেলেন মহুয়া। চেয়ারম্যান এবং প্যানেলের সদস্যদের বিরুদ্ধে নোংরা কথা বলেন। উনি হাবেভাবে খুবই উদ্ধত ছিলেন। উনি ভুয়ো বক্তব্য তৈরি করে দেশের মানুষকে ভুল পথে চালিত করার চেষ্টা করেছেন। নিজেকে হেনস্থার শিকার হিসাবে তুলে ধরেছেন।’’
শুক্রবার পাল্টা একটি টুইটে তৃণমূল সাংসদ জানিয়েছেন এথিক্স কমিটির বৈঠকে যে সব প্রশ্ন করা হয়, তার প্রতিবাদে ৫০ শতাংশ সদস্যই বৈঠক ছাড়েন। এরই মধ্যে বাংলার বিজেপি নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা জানিয়েছেন, মহুয়ার বিরুদ্ধে তাঁরা এক লক্ষ সই সংগ্রহ করতে নেমেছেন। সই সংবলিত ওই চিঠি যাবে লোকসভার স্পিকারের কাছে। তাতে রয়েছে, সিবিআই তদন্তের দাবি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy