Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
মেয়ে খুনে কাঠগড়ায় মা

দিদি বলতে পারব না, মাকে বলেছিলাম

সালটা ২০১২। শিনা বরা-র ফোন পেয়েছিলেন তাঁর এক বান্ধবী। শিনা ফোনে বলেছিলেন, তাঁকে পাগল সাজিয়ে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে আটকে রেখেছেন তাঁর মা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়! এর কিছু দিন পরেই উধাও হয়ে যান শিনা। আসলে খুন হয়ে যান।

মিখাইল বরা।

মিখাইল বরা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

সালটা ২০১২। শিনা বরা-র ফোন পেয়েছিলেন তাঁর এক বান্ধবী। শিনা ফোনে বলেছিলেন, তাঁকে পাগল সাজিয়ে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে আটকে রেখেছেন তাঁর মা ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়!

এর কিছু দিন পরেই উধাও হয়ে যান শিনা। আসলে খুন হয়ে যান।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিনার ওই বান্ধবী জানিয়েছেন, গুয়াহাটিতে এসে তাঁর বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন শিনা। ফোনের ঘটনাটা তার পরের। ওই ফোন পাওয়ার পর তাঁর সেনা অফিসার স্বামী একটা চেষ্টা করেছিলেন রিহ্যাব থেকে শিনাকে ছাড়িয়ে আনার। কিন্তু বাদ সাধেন শিনার ভাই মিখাইল। পারিবারিক ব্যাপারে তাঁদের নাক গলাতে বারণ করেন। বান্ধবী ও তাঁর স্বামী এর পর হাল ছেড়ে দেন।

কেন বারণ করেছিলেন মিখাইল? আজ বারবার মিখাইল বোঝাতে চেয়েছেন, দিদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। তা হলে কেন দিদিকে সাহায্যের ব্যাপারে বাধা দিয়েছিলেন? কেউ কেউ বলছেন, পরিবারের কেচ্ছা ফাঁস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেছিলেন মিখাইল। যদিও শিনার স্কুলজীবনের এক প্রেমিকের দাবি, ইন্দ্রাণী যে আসলে শিনার মা, সে কথা তাঁরা অনেকেই জানতেন। ইন্দ্রাণীকে তাঁরা ‘ইন্দ্রাণী আন্টি’ বলতেন। ইন্দ্রাণীর গুয়াহাটি আসার কথা থাকলেই শিনার চোখেমুখে উত্তেজনা দেখতেন তিনি। এমনকী শিনা মুম্বইয়ে চাকরি করার সময়েও তাঁরা যখন সিনেমায় যেতেন, তখন ইন্দ্রাণী নাকি এই ছেলেটিকে বলতেন, সময়মতো তাঁর মেয়েকে যেন বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।

এই প্রেমিকও ‘নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক’। তবে প্রণয় বরা নামে শিনার এক সহপাঠী জানান, স্কুলে বরাবর দাদু-দিদিমাই শিনাকে নিতেআসতেন। শিনা যখন একাদশ শ্রেণিতে ফ্যাকাল্টি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন, তখনই নাকি প্রথম বার স্কুলে আসেন শিনার মা। তিনিই পরে শিনাকে মুম্বই নিয়ে যান।

অর্থাৎ দায়িত্বশীল ‘মা’ হিসেবেই ইন্দ্রাণীকে দেখেছেন শিনার বন্ধুদের একাংশ। সেই মা কী করে খুন করবেন মেয়েকে? উত্তরটা দিচ্ছেন মিখাইল। বলছেন, তাঁর মায়ের পক্ষে ‘সবই সম্ভব’। তাঁর কথায়, ‘‘আমার কাছে অনেক তথ্য রয়েছে। মা পুলিশকে কী বলে দেখি। আমি ৩১ অগস্টের পরে মুখ খুলব।’’

মিখাইলের দাবি, রীতিমতো চুক্তি করে ইন্দ্রাণী তাঁদের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছিলেন। চুক্তিটা হল, দিল্লি-মুম্বইয়ের হাই প্রোফাইল সমাজে তিনি ছেলে-মেয়ের পরিচয় দেবেন নিজের ভাই ও বোন বলে। তখন শর্তে রাজি হয়েও মিখাইল নাকি বলেছিলেন, মাকে ‘দিদি’ বলে ডাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাবার পরিচয় নিয়ে অবশ্য মুখ খুলতে চাননি তিনি।

গুয়াহাটির সুন্দরপুর ২ নম্বর বাই লেনের ৮ নম্বর বাড়ি ‘চাণক্যনীড়ে’ বসে আজ মিখাইল বলেন, ‘‘দিদি ১৯৮৯ সালে ও আমি ১৯৯০-এ জন্মেছি। পিঠোপিঠি হওয়ায় আর জীবনে এমন একটা অধ্যায় থাকায় আমরা দু’জন ছিলাম দু’জনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবা-মাকে দেখিনি। দাদু-দিদিমার কাছেই মানুষ। যখন আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন খবরে প্রথম দেখি, ইন্দ্রাণী বরার সঙ্গে পিটার মুখোপাধ্যায়ের বিয়ে হচ্ছে। সেই সময়ে দাদু ওই চ্যানেলের দফতরে যোগাযোগ করে মাকে চিঠি পাঠান। ২০০৫ সালে কলকাতায় প্রথম মাকে দেখি আমি আর দিদি।’’

মিখাইলের দাবি, এর পরেই ছেলে-মেয়ে ও বাবা-মায়ের সঙ্গে ‘চুক্তি’টা করেন ইন্দ্রাণী। বলেন, তাঁদের দেখভাল, বাপের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ ও মিখাইল-শিনার পড়ার খরচ তিনি চালাবেন। বদলে বর্তমান জগতে ছেলেমেয়ের পরিচয় দেবেন তাঁর ভাই-বোন হিসেবে। মিখাইলের কথায়, ‘‘নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। উচ্চশিক্ষার আশায়, বাঁচার তাগিদে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু মাকে বলে দিই, আমরা দিদি বলে তোমায় ডাকতে পারব না। ‘সোনা’ বলে ডাকব।’’

পিটার মুখোপাধ্যায়ের ছেলে রাহুলের সঙ্গে শিনার সম্পর্ক নিয়ে তাঁর সঙ্গে এক বার পিটারেরও কথা হয়েছিল বলে জানান মিখাইল। বলেন, ‘‘দিল্লিতে সে বার পিটারের সঙ্গে তাঁদের মেয়েও ছিল। (কে এই মেয়ে, তা স্পষ্ট নয়)। পিটার খুবই ভদ্রলোক। আমি তাঁকে বলেছিলাম, পরিবারের মধ্যে এমন ব্যাপার ঘটছে। আপনারা বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঠিক করুন। আমি দিদির সম্পর্ক ভাঙার চেষ্টা করিনি।’’ তবে মিখাইল জানান, ইন্দ্রাণীর সঙ্গে শিনার মনোমালিন্য লেগেই থাকত। ফলে শিনা আলাদা ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকতেন। শিনা-হত্যায় সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ আছে কি না, খতিয়ে দেখছে পুলিশ। যদিও মিখাইলের বক্তব্য, দিদি বা তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি কিছু নেই। বাড়িটিও দিদিমার নামে। কাজেই এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে ‘অন্য কারণ’ রয়েছে বলেই তাঁর মত।

গত বছরের মাঝামাঝি বাবা-মায়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে শেষ বার গুয়াহাটি এসেছিলেন ইন্দ্রাণী। মিখাইলের কথায়, ‘‘মা বলেছিল, আমি দাদু-দিদার যত্ন না নেওয়াতেই তাঁদের শরীর খারাপ হয়েছে। ওঁদের মুম্বইয়ে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে রাখবে বলেছিল। কিন্তু রাজি হইনি। এখন মনে হচ্ছে, ভালই হয়েছে। যে মা নিজের স্বার্থের জন্য পেটের মেয়েকে খুন করতে পারে, সে বুড়ো মা-বাবাকেও মেরে ফেলতে পারত।’’ মিখাইল জানালেন, দাদু-দিদাকে দেখভাল করার কেউ নেই বলে তিনি লুফৎহানসা বিমান সংস্থার চাকরি ছেড়ে ২০১২ থেকে গুয়াহাটিতে রয়েছেন। সেপ্টেম্বর থেকে ইন্দ্রাণী তাঁদের টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কোনও রকমে সংসার চলছে বাড়িভাড়ার টাকায়।

শয্যাশায়ী দাদু-দিদার কথা ভেবেই বাড়িতে খবরের কাগজ ঢুকতে দিচ্ছেন না মিখাইল। বন্ধ টিভিও। কিন্তু বাড়ির বাইরে সর্বদাই ইতস্তত কৌতূহলী চোখ। মিখাইলের আক্ষেপ, ‘‘বনিবনা না হলে শিনাকে এখানে পাঠিয়ে দিতে পারত। মেরে ফেলল কেন?’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE