Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

শিনা-মিখাইলের বাবা সিদ্ধার্থই, বলছেন ঠাকুমা

অসমের করিমগঞ্জ শহরের তস্য গলি। রাস্তার নাম বনমালী রোড। সেখানেই সাদামাঠা একতলা বাড়িতে দেখা মিলল মায়ারানি দাসের। শিনা বরা হত্যাকাণ্ডে ধৃত ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথম’ স্বামী সিদ্ধার্থ দাসের মা।

শীর্ষেন্দু শী
করিমগঞ্জ শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৬
Share: Save:

অসমের করিমগঞ্জ শহরের তস্য গলি। রাস্তার নাম বনমালী রোড। সেখানেই সাদামাঠা একতলা বাড়িতে দেখা মিলল মায়ারানি দাসের। শিনা বরা হত্যাকাণ্ডে ধৃত ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রথম’ স্বামী সিদ্ধার্থ দাসের মা। চোখের জল সামলে বছর সত্তরের বৃদ্ধা আনন্দবাজারকে জানালেন, শিনা আর মিখাইল তাঁরই নাতি-নাতনি। সিদ্ধার্থের পুত্র-কন্যা।

শিনা-মিখাইলের পিতৃপরিচয় নিয়ে গত কয়েক দিনে জলঘোলা কম হয়নি। দু’দিন আগেই শিনার জন্মের একটি শংসাপত্র প্রকাশ্যে আসে। তাতে দেখা যাচ্ছে শিনার বাবা হিসেবে নাম রয়েছে উপেন্দ্রকুমার বরার। যিনি আবার ইন্দ্রাণীরও বাবা। কিন্তু মিখাইল সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছিলেন, তিনি এবং শিনা ইন্দ্রাণীরই সন্তান। এই দাবির সমর্থনে পুলিশকে নথি দিয়েছেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এর পরেই সামনে আসে ১৯৯৩ সালে পেশ করা ইন্দ্রাণীর হলফনামা। সেখানে ইন্দ্রাণী জানিয়েছিলেন, তিনি শিনা ও মিখাইলকে দত্তক দিচ্ছেন। দত্তক নিচ্ছেন তাঁর মা দুর্গারানি বরা। ওই হলফনামায় শিনা ও মিখাইলের বাবা হিসেবে নাম ছিল জনৈক এস দাসের।

যদিও উপেন্দ্রবাবু এর আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, তিনি শিনার বাবা নন দাদু, এবং বাবা হলেন সিদ্ধার্থ দাস, তবু হলফনামায় উল্লেখিত এস দাসই সিদ্ধার্থ কি না, সেই জটিলতা কাটছিল না। কারণ, সাংবাদিকরা উপেন্দ্রবাবুকে যখন প্রশ্ন করেছিলেন, অন্য কারও বাবা হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, তখন তিনি ধোঁয়াশা বাড়িয়ে জবাব দেন, ‘সেটা খতিয়ে দেখতে হবে’।

সেই ধোঁয়াশা মোটের উপর কাটিয়ে মায়ারানি দাস আজ জানিয়ে দিলেন, তাঁর ছেলে সিদ্ধার্থই শিনা-মিখাইলের বাবা। সিদ্ধার্থ বেঁচে আছেন কি না, তা নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছিল। মায়ারানি আজ জানিয়েছেন, তাঁর ছেলে জীবিত, কলকাতায় থাকেন। ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদের বেশ কয়েক বছর পরে তিনি বিয়েও করেছেন বলে জানিয়েছেন মায়ারানি। তবে ছেলের বর্তমান ঠিকানা নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি। স্থানীয় সূত্রের খবর, কালীঘাট এলাকায় সিদ্ধার্থের বাড়ি। মায়ের সঙ্গে তাঁর বিশেষ যোগাযোগও নেই।

সিদ্ধার্থ-ইন্দ্রাণীর বিবাহিত জীবন সম্পর্কে কী বলছেন মায়ারানি?

মায়ারানি দাস জানাচ্ছেন, বাবুল (সিদ্ধার্থর ডাক নাম) একটা সময় শিলং-এর একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে ইন্দ্রাণীর আলাপ। ইন্দ্রাণীর ডাক নাম ছিল পরী। বিয়ের পর সিদ্ধার্থ তিন বছর গুয়াহাটির শ্বশুরবাড়িতেই ছিলেন বলে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সূত্রের দাবি। শিনার প্রথম জন্মদিন অবশ্য সিদ্ধার্থের বনমালী রোডের বাড়িতেই পালিত হয়। করিমগঞ্জে সিদ্ধার্থের মামাবাড়ি। সেখানকার অনেক বন্ধু সেই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বলে দাবি মায়ারানির। পারিবারিক সূত্রের খবর, সিদ্ধার্থের বাবা অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে বাড়ি থেকে চলে যান। তার পরেই দুই ছেলে এবং এক মেয়েকে মানুষ করার জন্য করিমগঞ্জে নিজের পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন মায়ারানি। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের পূর্ত বিভাগে চাকরি করতেন। পরে বনমালী রোডে জমি কিনে সেখানেই বাড়ি করেন। ছোট ছেলে শান্তনু মায়ের সঙ্গেই থাকেন।


(উপরে) ১৯৯৭ সালের ভোটার তালিকায় সিদ্ধার্থ ও তাঁর মা মায়ারানির নাম।
এবং (নীচে) ২০১৪ সালের সচিত্র ভোটার তালিকায় মা ও ভাইয়ের নাম থাকলেও নেই সিদ্ধার্থের নাম।—নিজস্ব চিত্র।

নাতনির খুন হওয়ার খবর শুনেছেন? মুহূর্তে ম্লান হয়ে গেল বৃদ্ধার মুখটা। জানালেন, নাতনিকে শিনাই বলে ডাকতেন। তার খুনের খবর শোনা থেকে বড় কষ্টে আছেন। ব্যস ওই পর্যন্তই। এ নিয়ে আর বেশি মুখ খুলতে চান না। কেন? ৭০ বছর বয়সে আর নতুন কোনও ঝামেলায় জড়াতে চাই না, আকুতি বৃদ্ধার। যে কারণে বহু অনুরোধেও নিজের তো বটেই, এমনকী বাড়ির ছবিও তুলতে দিলেন না।

মায়ারানি নিজে মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও পরিবার এবং সিদ্ধার্থের বন্ধুস্থানীয় একাধিক ব্যক্তির দাবি, বিয়ের কিছু দিন পর থেকেই ইন্দ্রাণী শাশুড়ির সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার শুরু করেন। সেই কারণে কিছু দিন পরেই সিদ্ধার্থ মায়ের থেকে আলাদা হয়ে গুয়াহাটিতে শ্বশুরবাড়ি চলে যান। সিদ্ধার্থের ঘনিষ্ঠ জনদের বক্তব্য, ইন্দ্রাণী অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী ছিলেন। শাশুড়ির সঙ্গে দূরত্ব বাড়ানোর পরে সিদ্ধার্থর সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করতে শুরু করেন তিনি। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়লে বিয়ের তিন বছরের মাথায় দু’জনের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় বলে দাবি মায়ারানির। যদিও ১৯৯৩ সালে ইন্দ্রাণীর পেশ করা হলফনামা অনুযায়ী, ‘পরস্পরের সম্মতিতে’ তিনি স্বামীর থেকে আলাদা থাকেন।

ইন্দ্রাণীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পরে সিদ্ধার্থ অরুণাচলপ্রদেশে একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ নিয়ে চলে যান বলে জানালেন মায়ারানি। তার কয়েক বছর পরে কলকাতায়। সেখানে কয়েক বছর পরে তিনি বিয়েও করেছেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ছেলের যোগাযোগ বিশেষ নেই। কেন? মায়ারানি জানান, ইন্দ্রাণী-পর্বের তিক্ততা ভুলতে পারেননি বলেই তিনি ছেলের দ্বিতীয় বিয়ের সময় বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। আগে ফোনে ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলেও এখন তা-ও নেই বলে দাবি মায়ারানির। যদিও ১৯৯৭ সালের ভোটার তালিকায় ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ক্রমিক নম্বর ৯৫৯-তে উল্লেখ রয়েছে মায়া দাসের। স্বামী সিতাংশুশেখর দাস। ৯৬০ নম্বরে সিদ্ধার্থ এবং ৯৬৩-তে বাবলি দাসের নাম রয়েছে। বাবলির স্বামী হিসেবে সিদ্ধার্থ দাসের নাম রয়েছে সেখানে।

মায়ারানি দেবীর ছেলে সিদ্ধার্থই সরকারি ভাবে ইন্দ্রাণীর প্রথম স্বামী বলে জানা গেলেও একটি সূত্রের দাবি, সিদ্ধার্থের আগেও একাধিক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তাঁর। এর মধ্যে এক জনের সঙ্গে ইন্দ্রাণী পালিয়ে কামাখ্যা মন্দিরে বিয়েও করেছিলেন বলে ওই সূত্রটির দাবি। যদিও সেই বিয়ে আইনত বৈধ নয়। মন্দিরে বিয়ে করা সেই ‘স্বামী’র বাবা অসম সরকারের পদস্থ কর্তা ছিলেন। তাঁদের প্রতিবেশীদের বক্তব্য, ইন্দ্রাণী নয়, পরী নামেই ওই মেয়েকে চিনতেন তাঁরা। ওই বয়সেই পরী উদ্দাম জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলেও দাবি তাঁদের অনেকের।

(সহ-প্রতিবেদন রাজীবাক্ষ রক্ষিত)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE