প্রদ্যোত মাণিক্য।—নিজস্ব চিত্র।
মহারাজা আসছেন...
মহারাজা আসছেন...
দোসরা ফাল্গুনের এই রাতের আকাশে অমাবস্যা। তবুও, তারই মধ্যে সিল্যুয়েট হয়ে দাঁড়িয়ে উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ। নিকষ আঁধার ভেদ করেও তার সাদার ছটা ছড়িয়ে পড়ছে আড়ালে থাকা স্বাতী নক্ষত্রের দিকে।
আগরতলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের সদর দেউড়ি ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে এসে প্রশস্ত প্রাঙ্গন। তার পরে মূল বাড়িতে ঢোকার আগে আরও এক ইমারত। দাঁড়িয়ে আছি সেই প্রাঙ্গনে। ভিতরে বসার আমন্ত্রণ ছিল। তবু, এই অমাবস্যা রাতের ক্যানভাসে ভারতের একদা ‘প্রিন্সলি স্টেট’ ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদ দেখার আকর্ষণ তীব্রতর হচ্ছিল। রাজপ্রাসাদের অন্দরমহলের অন্তর-বার্তা ক্ষণিকের অতিথির কানে যাওয়ার নয়। তবু, ভিতরবাড়ির সার সার ঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে আসা আলোর রেখা যেন কত কিছু বলে যাচ্ছিল। এই প্রাসাদেরই একটা বড় অংশ এখন সরকারের হাতে। সেখানে আগে বিধানসভা ভবন ছিল। পরে নিজস্ব বিধানসভা ভবন হওয়ার পরে ওই অংশে হয়েছে মিউজিয়াম। প্রাসাদের আরও একটি ছোট অংশে রয়েছে পর্যটন দফতরের অফিস।
‘মহারাজা আসছেন...’, রাজবাড়ির এক কর্মচারী ছুটে এসে বলে যাওয়ার মুহূর্তেই লাল রঙের এসইউভি এসে দাঁড়াল প্রশস্ত পোর্টিকোয়। নেমে এলেন মহারাজ। পরনে ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবির উপরে জহর কোট। জিনস। পায়ে কালো বুট। মহারাজা প্রদ্যোত বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মণ। ‘‘আপনি এসে গিয়েছেন? সভায় দেরি হয়ে গেল। আসুন আসুন।’’ হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন প্রদ্যোত মাণিক্য। ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান মুখ।
অতীত আজও বহমান।
‘রাজমালা’ কাব্যগ্রন্থের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে ত্রিপুরার রাজাদের গুণকীর্তন। সেখানেই রয়েছে ১৭৯ জন রাজার নাম। প্রদ্যোৎ মাণিক্যের পূর্বপুরুষ তাঁরা। প্রদ্যোতের বসার বিশালাকার ঘরেও তারই ভূরি ভূরি নিদর্শন। প্রাসাদের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আমআদমির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। নেমেছিলেন রাজনীতিতে। প্রদ্যোতের বাবা মহারাজ কিরীট বিক্রম এবং মা বিভু কুমারী দেবী, দু’জনেই কংগ্রেস রাজনীতি করেছেন। ১৯৬৭ সালে মহারাজা কিরীট বিক্রম লোকসভা নির্বাচনে হারিয়েছিলেন বামপন্থী নেতা দশরথ দেবকে। এর পর ’৭৭ ও ’৮৯ সালেও কিরীট বিক্রম লোকসভা ভোটে জয়ী হন।
আরও পড়ুন : ত্রিপুরা: শেষ অঙ্কের পর্দা ওঠার আগে শেষ মুহূর্তের অঙ্ক কষা চলছে
প্রদ্যোতের মা মহারানি বিভু কুমারী দেবী ১৯৮৩ এবং ’৮৮-র বিধানসভা নির্বাচনে যথাক্রমে মাতাবাড়ি ও আগরতলা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে জয়ী হন। আগরতলায় তিনি সিপিএমের মানিক সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন মাত্র ৮১ ভোটের ব্যবধানে।
ঐতিহ্যের স্মৃতি আজও অমলিন।
প্রদ্যোত অবশ্য ‘সিরিয়াস পলিটিক্স’-এ বিশ্বাস করেন। আনন্দবাজার ডিজিটাল-কে প্রদ্যোত বলেন, ‘‘ছোটখাটো জয়-পরাজয় নয়, মানুষের জন্য সততার সঙ্গে রাজনীতি করাটা অনেক বেশি দরকারি।’’ তা হলে তাঁর নিজের রাজ্যে কংগ্রেসের এই হাল কেন? তাঁর কথায়: ‘‘অপেক্ষা করুন। চাকা ঘুরবেই। দিল্লিতে বিজেপি ক্ষমতায় আছে বলে এখানে ওদের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু ২০১৯-এ দেখবেন কী হয়। তার পর এ রাজ্যেও কংগ্রেসের পালে হাওয়া লাগবে। আর বিজেপির নিজস্ব সংগঠন বলতে কী আছে? সবই তো এ দল-ও দল ভাঙানো।’’
প্রাসাদ ছেড়ে জনতার ভিড়ে মিশে যেতে কেমন লাগে তাঁর? ফুটবল ভক্ত প্রদ্যোত বলেন, ‘‘এটা তো আমার কাছে নতুন নয়। আমার মা-বাবা সক্রিয় রাজনীতি করেছেন। আমিও এখন করছি। কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে আমরা মিশে আছি। সবাই আমার ত্রিপুরাবাসী। রাজনীতি যে যাঁর নিজের মতো করেন। তবে স্রেফ বিরোধিতা করার জন্য বিরোধিতা চাই না। চাই হৃদয়কে আরও প্রসারিত করতে।’’
আরও পড়ুন: ‘নীতি থাকলে কি এমন জোট করত বিজেপি?’
এই নির্বাচনী রাজনীতিতে থেকেও হৃদয়ের প্রসারণ? ‘‘কেন নয়? দেখুন, আমি আমার এলাকা ছেড়ে যাইনি। আমার পড়াশোনা এই উত্তর-পূর্বে। পরে লন্ডনে যাই, আমেরিকায় নয়। আমি পোলো খেলিনি, ফুটবল খেলেছি। আমার কাছে দিল্লি নয়, আমার এলাকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’’ প্রদ্যোত অবশ্য নিজেকে সাংবাদিক বলতেও ভালবাসেন। তার কারণ, তিনি উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে প্রকাশিত একটি ইংরেজি সাময়িকপত্রের প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক। সাংবাদিকতা নিয়ে কথা বলাটা তাঁর একটা ‘প্যাশন’।
এখনও অকৃতদার ৩৯ বছর বয়সী প্রদ্যোত। আগরতলা-শিলং-কলকাতা মিলিয়ে তিনি একাই থাকেন। কখনও একা লাগে না তাঁর? এই উজ্জয়ন্ত প্রাসাদে ঘুরে বেড়ানোর সময় গ্রাস করে না একাকিত্ব? ‘‘করে বইকি। একা মানুষ। ১৯০টা ঘরের রাজপ্রাসাদে একা তো লাগতেই পারে!’’ তা হলে? আভিজাত্য বোধ থেকে অতিথিকে এগিয়ে দিতে নিজেই বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন প্রদ্যোত। হাসেন তিনি। নীরব হাসি সে মুখে, ‘‘আসবেন আবার। এখন তো ভোটের সময়। পরে ভাল করে আড্ডা দেওয়া যাবে।’’ দাঁড়িয়ে থাকেন মহারাজ।
ফ্রেম-বন্দি অতীত।
দূরে ‘স্টাফ’ করা বাঘ-সিংহের মাথা। দেওয়ালে শোভা পাচ্ছে ফ্রেম-বন্দি অতীত, তেলরং আর ওয়াটার কালার তুলির আঁচড়ে। প্রশস্ত সে বারান্দা মিশেছে নীচে নামার সিঁড়িতে। প্রাসাদের বনেদি সিঁড়ি আবার অতিথিকে নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে মাটির কাছাকাছি।
আরও পড়ুন: সিপিএমের কায়দাতেই ত্রিপুরার বুথে বুথে ঘুঁটি সাজাচ্ছে বিজেপি
রাত বেড়েছে। ফাল্গুনি অমাবস্যা রাত উজ্জয়ন্ত প্রাসাদকে করে তুলেছে যেন আরও মায়াবী। আভোগীর সুর ভেসে আসে না রাজপ্রাসাদ থেকে। তবু, এই নিকষ রাতেও প্রাসাদকে দূর থেকে দেখতে কেমন লাগে মহারাজ?
না, এ কথা আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি মহারাজা প্রদ্যোত বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মণকে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy