Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪

ইন্দিরা থেকে মোদী, ‘গরিবি হঠাও’-এর উত্তরাধিকার

ভারতে উন্নয়নের ভাষ্যকে অসাম্য থেকে দারিদ্রে নিয়ে আসাই সম্ভবত ইন্দিরা গাঁধীর জমানার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। লিখছেন অমিতাভ গুপ্ত।ভারতে উন্নয়নের ভাষ্যকে অসাম্য থেকে দারিদ্রে নিয়ে আসাই সম্ভবত ইন্দিরা গাঁধীর জমানার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। লিখছেন অমিতাভ গুপ্ত।

ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ১৮:৩০
Share: Save:

ইন্দিরা গাঁধীকে মনে রা‌খবেন কেন? তাঁর ইতিহাসে যদি ১৯৭৫ সাল না থাকত, যদি ইন্দিরা বললেই ‘জরুরি অবস্থা’-র স্মৃতি জেগে না উঠত, তবে এই প্রশ্নের ভিন্নতর উত্তর দেওয়া সম্ভব হত। কেউ হয়তো বাংলাদেশ যুদ্ধের কথা উল্লেখ করতেন। কারও মনে পড়ত ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের কথা। আমায় প্রশ্ন করলে যেমন আমি বলতাম একটা স্লোগানের কথা— ‘গরিবি হঠাও’। ভারত থেকে গরিবি সম্পূর্ণ দূর হয়নি। কিন্তু, এই একটা স্লোগান বদলে দিয়েছিল ভারতীয় রাজনীতির ভাষ্যকে। ইন্দিরা মিলিয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের পাতায়, কিন্তু ভারতের উন্নয়ন-নীতির গতিপথ তাঁর স্লোগানের ধারাতেই বয়েছে। এবং, অনেকটাই শুধু কথায়, তাঁর ‘গরিবি হঠাও’-এর মতোই।

কিন্তু, তাঁর কথায় যাওয়ার আগে জওহরলাল নেহরুর আমলটাকে ছুঁয়ে যেতেই হবে। নেহরুর উন্নয়ন ভাবনার একটা অবিচ্ছেদ্য দিক ছিল অসাম্য কমিয়ে আনা। দারিদ্র দূরীকরণ নয়, অসাম্য কমানো। দুটো ধারণার মধ্যে ফারাক রয়েছে বিস্তর। অসাম্য কমানো ব্যাপারটা আপেক্ষিক। একটা ছোট গোষ্ঠীর মানুষের হাতে অনেক সম্পদ, আর অনেক মানুষের হাতে নেহাত দিন চালানোর মতো টাকাকড়ি, এই ছবিটাকে বদলানো হল অসাম্য কমানোর প্রথম কথা। তার জন্য কোনও এক ভাবে বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টন প্রয়োজন— এত দিন যে ভাবে চলে এসেছে, সব দিক থেকেই সে পথে চলতে থাকলে অসাম্য কমানো যায় না। দারিদ্র দূর করার মধ্যে এই আপেক্ষিকতা নেই। সেখানে ধনী আরও ফুলেফেঁপে উঠলেও আপত্তির কারণ নেই, শুধু দরিদ্ররাও ভাগে পেলেই হল। অর্থাৎ, দুটো লক্ষ্যের রাজনীতি আলাদা। নেহরু জমানার শুরুটা অন্তত প্রথম লক্ষ্যে হয়েছিল।

দারিদ্র দূরীকরণ বিপ্লবের দাবি করে না। বণ্টনের কোনও বৈপ্লবিক অদলবদল চায় না। দারিদ্র দূরীকরণের একটাই দাবি, গরিব মানুষের জন্য আরও কিছু ব্যবস্থা হোক। সেই দাবি পূরণ করা রাষ্ট্রের পক্ষে অপেক্ষাকৃত সহজতর, কারণ সেখানে গরিবকে ‘এজেন্সি’ দেওয়ার— তাকে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়ার— আবশ্যকতা নেই। গরিবকে শুধু পাইয়ে দিলেই হয়। পাইয়ে দিতে রাষ্ট্রের আপত্তি নেই। পুঁজিরও না, অন্তত যত ক্ষণ সেই পাইয়ে দেওয়ায় পুঁজির স্বার্থে ঘা না লাগে। ট্রিকল ডাউন থিয়োরির চুঁইয়ে পড়া উন্নয়নেও দিব্য দারিদ্র দূর করার কাজ হয়। কিন্তু, তাতে অসাম্য কমে না। আগের তুলনায় অনেক মানুষ দারিদ্রসীমার ওপরে উঠে আসেন বটে, কিন্তু ধনীরা আরও অনেক বেশি ধনী হয়ে ওঠেন। অসাম্য কমানো আর দারিদ্র দূরীকরণের রাজনীতি, অতএব, তেল আর জল। তাতে মিশ খায় না।

ভারতে উন্নয়নের ভাষ্যকে অসাম্য থেকে দারিদ্রে নিয়ে আসাই সম্ভবত ইন্দিরা গাঁধীর জমানার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান বিপুল সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু, সেই সাফল্যের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি এটা দেখা যে গরিবি দূর করার ভাষ্য উন্নয়নের নীতি থেকে মুছে দিয়েছিল অনেক কিছুই— যার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল সম্ভবত একটি নৈতিকতার বোধ: যে দেশে বিপুল সংখ্যক মানুষ কষ্টে থাকেন, সেখানে অল্প কিছু মানুষের প্রবল বৈভব আসলে ঘোর অশ্লীল। নেহরু এই কথাটা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। একাধিক বার। ইন্দিরা গাঁধী সেই বৈভবের পক্ষে সওয়াল করেননি, কিন্তু তার অনৈতিকতাকে আলোচনার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। কারণ, অসাম্য যখন আর প্রশ্ন নয়, তখন শুধু নীচের দিকে তাকালেই চলে। তলানি খানিক ওপরে উঠে এল কি না, দারিদ্র কমানোর জন্য সেটাই তো বিবেচ্য। এখানে একটা কথা বোধ হয় পরিষ্কার করে বলা ভাল। দারিদ্র কমানোর কাজটা অত্যন্ত জরুরি। আর্থিক অসাম্য দূর করার জন্য, আরও বেশি মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দেওয়ার জন্য দারিদ্র দূরীকরণের কথা ভাবতেই হবে। কিন্তু, অসাম্যের প্রশ্নটা একটু আলাদা। সেখানে নীচের মানুষ কতখানি উঠে এলেন, তা-ই একমাত্র প্রশ্ন নয়। ওপরের সঙ্গে তার ব্যবধান কমল কি না, কতখানি কমল, এই প্রশ্নগুলোও সমান জরুরি। এই প্রশ্নগুলোকে আলোচনা থেকে সরিয়ে দেওয়াই রাজনীতি। পুঁজির পক্ষে রাজনীতি।

ইন্দিরা যখন ‘গরিবি হঠাও’ স্লোগান নিয়ে এসেছিলেন, তখন জনৈক নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী বছর বিশেকের যুবক। দিল্লির তখ্‌ত সম্ভবত তখন তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। প্রায় অর্ধশতকের ব্যবধানে তিনি ঘোষণা করলেন, পাঁচ বছরের মধ্যে ভারত উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশ হয়ে উঠবে। এই দাবির অসম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা করা অবান্তর। কিন্তু, একে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিলে ‘গরিবি হঠাও’-এর উত্তরাধিকারটাকে দেখা হবে না। ‘উন্নত দেশ’ বলতে মোদী ঠিক কী বোঝেন, সেই তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ধরে নেওয়া যায়, ঝাঁ চকচকে রাস্তা, সুউচ্চ অট্টালিকা, শপিং মল ছাপিয়ে প়়ড়া পণ্যের সম্ভার, বিপুল বিনিয়োগ, প্রবল শিল্পায়ন— সব মিলিয়েই উন্নতি। শুধু মোদী নন, দেশের বেশির ভাগ মানুষ ‘উন্নত দেশ’ বললে এই ছবিটাই দেখবেন। এখানেই অসাম্যের বিরুদ্ধে জেহাদকে পথের পাশে ফেলে আসার সাফল্য। এই উন্নতির আখ্যানে প্রশ্ন উঠবে না, কার ভাগে কতখানি পড়ল। কেউ জানতে চাইবে না, দারিদ্র যতখানি কমল, কিছু লোকের সমৃদ্ধি তার তুলনায় কত গুণ বাড়ল। বরং, কেউ পাল্টা বলতেই পারেন, অম্বানিরা আরও বড়লোক হলে যদি কিছু মানুষের দারিদ্র কমে, তা নিয়ে আপত্তি করব কেন?

সেই আপত্তির সত্যিই আর প্রশ্ন নেই। গত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছরে সেই আপত্তির রাজনীতিটাই যে ভারত পিছনে ফেলে এসেছে। ইন্দিরা গাঁধীর জমানায় সেই পিছনে ফেলার শুরু।

প্রসঙ্গত, ভারত নামক রাষ্ট্রটি যে ‘সমাজতান্ত্রিক’, ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে এই কথাটা লিখেছিলেন ইন্দিরা গাঁধীই। ১৯৭৭ সালে। রাজনীতির মহিমা!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE